নতুন বইয়ের গন্ধ কি আপনার হৃৎপিণ্ডে কাঁপন ধরায়? আপনি কি স্থানীয় বইয়ের দোকানে থরে থরে সাজানো বইয়ের তাকগুলোর সামনে দীর্ঘ সময় ব্যয় করেন? দুটি প্রশ্নের যে কোনও একটির উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়ে থাকে, সময় নষ্ট না করে দ্রুত আপনি আপনার পাসপোর্টটি বগলদাবা করুন এবং বিশ্বের কয়েকটি চমকপ্রদ বইয়ের দোকানে ঢুঁ দেবার উদ্দেশে আমাদের সঙ্গে ভার্চুয়াল ভ্রমণের সঙ্গী হোন।
এল অ্যাটেনিও গ্র্যান্ড স্প্লেন্ডিড, বুয়েনস আইরেস, আর্জেন্টিনা:
প্রথমে আমরা যে দোকানটিতে থামছি, সেটা আদতে একটা থিয়েটার হিসেবে একশ বছর আগে যাত্রা শুরু করেছিল। এর নির্মাণ কাল ১৯১৯। এল অ্যাটেনিও গ্র্যান্ড স্প্লেন্ডিড গতানুগতিক ধারার থিয়েটার ছিল না; যেখানে শুধুমাত্র চলচ্চিত্র, নাটক বা অপেরার যে কোনো একটির প্রদর্শন চলতো। ঐতিহ্যবাহী থিয়েটারের লাইভ পারফরম্যান্সের মঞ্চ, পাশাপাশি চলচ্চিত্র প্রদর্শনের হল, বা সিনেমা আর্জেন্টিনায় যেমনটা বলা হয়, সেইভাবে এল অ্যাটেনিওকে দ্বৈতভাবে ব্যবহার করা হতো। সেসময় নির্মিত অন্যান্য থিয়েটারের মতো কিছু একটা তৈরিতে না ঝুঁকে, অনিন্দ্য সুন্দর এবং আড়ম্বরপূর্ণ একটি বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণের ইচ্ছা নিয়ে এল অ্যাটেনিওর ডিজাইনারেরা বাইরের দুনিয়াতে দৃষ্টি দিয়েছিলেন। গঠন রীতিতে বৈশিষ্ট্য আনতে এর ব্যালকনিগুলোকে ডিম্বাকৃতির আকার দেয়া হয় যেখানে বসে থাকা দর্শকদের চারপাশটা চকচকে সোনালী অলঙ্করণে সাজানো; আর এর প্রতিটি স্তর একেকটি অনন্য সাধারণ নকশাযুক্ত এবং পুরো সিলিং ফ্রেস্কো ডিজাইনে আবৃত।
এল অ্যাটেনিওর কেন্দ্রে রয়েছে একটি মঞ্চ, যেটি যে কারো দৃষ্টি আকর্ষণের ক্ষমতা রাখে। থিয়েটারটিকে যখন বইয়ের দোকানে রূপান্তরিত করা হয় তখন এই মঞ্চ এবং তাকে ঘিরে থাকা লালভেলভেটের পর্দা অক্ষত রাখা হয়। বইয়ের দোকানে আগত আধুনা পাঠক-ত্রেতা, ক্যাফেতে বসে দর্শক হিসেবে বিগত দিনে কীভাবে প্রথমবার আসরে নামার আগে অভিনেতারা পর্দার ফাঁকে উপস্হিত দর্শকদের উঁকি দিয়ে দেখে মঞ্চে আত্মপ্রকাশের জন্য প্রস্তুতি নিতেন তার একটা কাল্পনিক ভাবনায় ভাসতে পারেন দিব্যি।
বর্তমানে এল অ্যাটেনিও আর্জেন্টিনার একটি অন্যতম এবং গর্ব করার মতো ঐতিহাসিক স্থাপত্য। চলচ্চিত্র প্রেমীদের গমগমে উপস্হিতির বিপরীতিতে থরে থরে সাজানো বই শান্ত-শিষ্ট হয়ে তাকগুলোতে পাঠক-ক্রেতার অপেক্ষায় থাকে। এল অ্যাটেনিও গ্র্যান্ড স্প্লেন্ডিডে কম বয়ষ্ক পাঠকদের কথা মাথায় রেখে তাদের জন্য আলাদা একটা বিভাগ আছে। বর্ণিল নানা জীব- জঙ্গলের দৃশ্যাবলী আর বিশাল বইভাণ্ডারে সেটা সাজানো। যা আগত প্রতিটা পাঠক-ক্রেতার মন ভরাতে সক্ষম। তবে আপনার ভাবনায় যদি এমন চিন্তা হানা দেন, একটা থিয়েটার হলের সবচে’ উপযুক্ত রূপান্তর হতে পারে বইয়ের দোকান- তবে আপনাকে আরো একবার ভাবতে অনুরোধ করছি।
এরপর আমরা যেখানে থামতে যাচ্ছি, নিঃসন্দেহে সেটা আপনাকে বই দুনিয়ার আরো গভীরে ডুব দেবার সুযোগ করে দেবে।
লাইব্রেরিয়া অ্যাকোয়া আলতা, ভেনিস, ইতালি:
এমন একটা বইয়ের দোকানের কথা ভাবুন, আক্ষরিক ভাবেই যেখানে বইয়ের সমুদ্রে সাঁতার কাটা যায়। লাইব্রেরিয়া অ্যাকোয়া আলতা হচ্ছে সেই বই সমুদ্র, যা আপনাকে সেই সুযোগটি দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। যেটি লুকিয়ে আছে পৃথিবীর অন্যতম জাদুর শহর ইতালির ভেনিসে। অনিন্দ্য এই শহর একটা হ্রদ বা খালের উপর নির্মিত, গন্ডোলায়(বিশেষ ধরনের নৌকা) চড়ে আপনাকে শহরের একস্হান থেকে অন্যস্হানে যেতে হবে। এই নৌকা বিশেষভাবে তৈরী করা হয়েছে যাতে শহরের আঁকাবাঁকা খালগুলোর মধ্যে সহজেই বাঁক নিয়ে ঘুরতে পারে। আমরা সেই গন্ডোলায় চড়ে লাইব্রেরিয়া অ্যাকোয়া আলতার দিকে যাচ্ছি।
লাইব্রেরিয়া অ্যাকোয়া আলতার অবস্হান খাল বরাবর অপার্থিব এক স্হানে। আপনি যখন দরজার সামনে দিয়ে হেঁটে যাবেন, তখন বইগুলো একধরনের জোয়ারের মতো ঢেউ তুলে আপনাকে স্বাগতম জানাবে। বইয়ের এই ঢেউ পাহাড়ের চেয়েও উঁচু; এবং এই লাইব্রেরির প্রত্যেকটা কোণে আপনার অপেক্ষায় আছে নতুন আবিষ্কারের চমকদার নানা উৎস। সাজ- সজ্জার উপকরণে রয়েছে পুরনো জাহাজের চাকা, ভেনিসিয়ান খালের চিত্রকর্ম, উৎসবের নানা মুখোশ। দোকানের মাঝখানে আছে একটা গন্ডোলা, যার সম্পূর্ণটা সাজানো হয়েছে ক্যান্ডি স্ট্রিপ পোল আর গন্ডোলার টুপি দিয়ে। গন্ডোলাটি বই দিয়ে একেবারে ঠাসা। আশপাশে এমন আরো অনেক গান্ডোলা বা নৌকা, এমনকি বাথটাব পর্যন্ত বই দিয়ে বোঝাই করা।
আপনার মনে হয়ত প্রশ্ন উঁকি দেবে নৌকার ভেতর কেন বই রাখা হবে? দোকানের নামের মধ্যেই সেই রহস্যের সন্ধান রয়েছে। ইতালিয়ান ভাষায় অ্যাকোয়া আলতা’র অর্থ হচ্ছে বিপুল জলরাশি। খাল-হ্রদের শহর হিসেবে ভেনিসের রয়েছে বন্যাক্রান্ত হওয়ার প্রাচীন ইতিহাস। সেই ঐহিত্যকে উপস্হাপন করতেই এই অভিনব বইয়ের দোকান। যেন গান্ডোলা বন্যার গ্রাসে পড়েছে; নৌকার ভেতর বইগুলো নিরাপদে রেখে সংরক্ষণের চেষ্টা চলছে। দোকানটি যখন ভাসমান থাকে না, আপনি তখন বাতিলকৃত বই দিয়ে তৈরি সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়ে খালের আশেপাশের অনিন্দ্য সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।
আপাতত আপনাকে গান্ডোলা থেকে অবতরণ করে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ইউরোপ এবং এশিয়ার দিকে যাত্রার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
পপলার কিডস রিপাবলিক, বেইজিং, চায়না:
একটা ছবি যদি হাজার শব্দ বলে দেবার সম্ভাবনা দেখায়, একটা ছবির বই কি তাহালে লক্ষ শব্দে নিজের ভেতরটা উপস্হাপনের সম্ভাবনা দেখায়? এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই, তবে আমরা এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি পুরদস্তুর ছবিতে ভরপুর বই আপনি ঠিক কোন দোকানটিতে খুঁজে পাবেন। চীনের রাজধানী বেইজিং সৃজনশীল এবং অত্যাধুনিক স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত। পপলার কিডস রিপাবলিক সেরকম একটা মনোমুগ্ধকার নির্মাণ, যা ২০০৫ সালে শিশু-কিশোরদের বইয়ের দোকান হিসেবে নির্মিত হয়েছে।
কাজেই বোঝা যাচ্ছে এটা যেনতেন কোনো দোকান নয়। এই দোকানে শুধুমাত্র ছবিওয়ালা বই বিক্রিবাটা চলে। দোকানের সাজ সজ্জায় রঙধনুর সাত রঙের ব্যবহার চোখে পড়বে যা দোকানে আগতদের জাদুময় এক জগতে টেনে নেবার পাশাপাশি মনের ভেতর বর্ণময় ভাবনাও উস্কে দেবে। দোকানের দেয়াল, মেঝে এবং সিলিংয়েও রয়েছে উজ্জ্বল রঙের উপস্হিতি। রঙধনু রঙা একটি কক্ষ আপনাকে হাতছানিতে ডাকবে সেখানে খানিক বসে নতুন নতুন বইয়ের ছবি উপভোগের জন্য। বই রাখার খোপগুলো হলো পড়াশোনায় ডুবে থাকার জগত যেখানে আপনি আয়েশ করে এলিয়ে বসে পড়তে পারেন। বইয়ের তাকগুলো যেন সেখানে রঙধনু বেষ্টিত পাহাড় এবং উপত্যকার সৃষ্টি করেছে, প্রিয় গল্পগুলো পড়ার জন্য এর চেয়ে উত্তম স্থান আর হয় না।
এখনও কী মনে হচ্ছে আরো কিছু বাকি থেকে গেল? তবেই নিজেকে পূর্ণ মনে হবে আপনার? এই জাদুময় ভ্রমণ তালিকায় আরো একটি স্টপেজ বাকি রয়েছে যেখানে গেলে নিজেকে পরিপূর্ণ হিসবে ভেবে তৃপ্তি পাবেন - আপনি সত্যিই মন্ত্রমুগ্ধ হবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
লিভারিয়া কাল্টুরা, সাও পাওলো, ব্রাজিল:
এটা সর্বতোভাবে স্বীকৃিত যে ব্রাজিল নামের দেশটিতে বিভিন্ন আকর্ষণীয় প্রাণীর নিবিড় এক সন্নিবেশ ঘটেছে। পিঙ্ক রিভার থেকে শুরু করে জাগুয়ার পর্যন্ত বন্যপ্রাণী জীবন দেশটির মতোই অনন্য। তবে লিভারিয়া কাল্টুরা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আপনাকে অপ্রত্যাশিত এক পাওয়ার আনন্দে ভরিয়ে দেবে একথা হলফ করে বলা যায়। এখানে আপনি পৌরাণিক ও প্রাগৈতিহাসিক বিভিন্নতার দারুণ এক সম্মিলনের সন্ধান পাবেন।
এই অভিনব দোকানটির সামনে দিয়ে হাঁটবার সময় প্রচুর পরিমাণের কাঠের তৈরি ড্রাগনের মাধ্যমে আপনাকে স্বাগতম জানানো হবে। মনে হবে কোনো রূপকথার বই থেকে বুঝি ওরা বেরিয়ে এসেছে।
যথাযথ বই বাছাইয়ের তাগিদে আপনি যখন সিঁড়ি বেয়ে দোকানের উপর তলায় যাবেন আপনার মনে হবে সদ্য পরিচয় হওয়া বন্ধুরাও যেন আশপাশ থেকে আপনাকে সঙ্গ দিচ্ছে। শিশুদের জন্য এখানে যে বিভাগটি রয়েছে সেখানে ঘাপটি দিয়ে থাকা ডায়নোসরটি আপনার মাধ্যমে আবিষ্কৃত হওয়ার অপেক্ষায় আছে। একদম ভয় পাবেন না, সে আপনাকে কামড়াবে না। আপনি চাইলে ভেতরে হামাগুড়ি দিতে পারেন, কিংবা আরামদায়ক একটা বিনব্যাগ টেনে নিয়ে ডুবে যেতে পারেন আপনার কোনো প্রিয় বইয়ের পাতায়।
আপনি হয়ত কোনো বেস্টসেলার অথবা পুরনো কোনো বইয়ের গন্ধে বুঁদ হওয়ার সন্ধানে আছেন; সেরকমটা হলে অন্তর্জালে বই জগতের বিশাল সমুদ্রে ভ্রমণের জন্য কিছু সময় ব্যয় করার অনুরোধ থাকলো। এমন ভ্রমণে আপনি হয়ত পেয়ে যাবেন মনোলোভা কোনো বই দোকানের সন্ধান- তেমনটা হলে আমাদের সঙ্গে আপনার ভ্রমণান্দের গল্পটি ভাগাভাগি করে নেবার আমন্ত্রণ রইল।
কৃতজ্ঞতাঃ প্রথম আলো