অভিধান
‘অভিধান' শব্দটিতেই তার আত্মপরিচয় বিধৃত আছে। শব্দের অভিধা বা বাচ্যার্থ নির্দেশই তার প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু বাচ্যার্থই তো শব্দের একমাত্র অর্থ নয়--লক্ষণা-ব্যঞ্জনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে আমাদের দেশে
অভিধান বলতে আমরা সাধারণত বুঝি শব্দকোষ। কিন্তু সুসংকলিত অভিধান শুধু শব্দ আর তার অর্থের তালিকামাত্র নয় ; সেখানে শব্দের ব্যুৎপত্তি, পদ পরিচয়, সমার্থশব্দ, বিভিন্ন অর্থ, বিশিষ্ট প্রয়োগ, লিঙ্গ নির্ণয়রীতি—সবই থাকে। আনুমানিক খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে সংকলিত আমাদের দেশের প্রাচীনতম অভিধান অমরকোষ এর একটি প্রকৃষ্ট নিদর্শন। রাজশেখর বসুর আধুনিক চলন্তিকা-ও (১৯৩০) যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির বিচারে, শুধু অভিধান বা শব্দকোষ নয় তা একটি ‘সংক্ষিপ্তসার ব্যাকরণ'। এই নিরিখে বিচার করলে “নিঘন্টু’ নামের প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থটিকে যথার্থ অভিধান বলা যায় না, তা বৈদিক শব্দের তালিকামাত্র।
‘অভিধান' শব্দটিতেই তার আত্মপরিচয় বিধৃত আছে। শব্দের অভিধা বা বাচ্যার্থ নির্দেশই তার প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু বাচ্যার্থই তো শব্দের একমাত্র অর্থ নয়--লক্ষণা-ব্যঞ্জনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে আমাদের দেশের প্রাচীন নন্দনশাস্ত্রে। আনন্দবর্ধন বলেছেন, ব্যঞ্জনা কোনো প্রতিশব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যায় না; তবে অভিধার ভেতর তার অন্তর্ভাব নিহিত থাকলেও থাকতে পারে। উৎকৃষ্ট অভিধানে শব্দের বহুলার্থের ইঙ্গিতও উদাহরণসহ দেওয়া থাকে ; যেমন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতুলনীয় বঙ্গীয় শব্দকোষ, দুই খণ্ড (১৯৬৬ খ্রিঃ)। প্রসঙ্গত হরিচরণ ৩৬ বছরের অনলস পরিশ্রমে এই শব্দকোষ সংকলন করে, ১৩৪০-র থেকে প্রায় দশ বছর ধরে তা খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশ করেন নিজ অর্থে। ১৯০৬ সালে প্রকাশিত সুবলচন্দ্র মিত্রর সরল বাঙ্গলা অভিধান পূর্ণাঙ্গ এবং নানা আনুষঙ্গিক তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানে (১৯৩৭) কিছু ভুলভ্রান্তি থাকলেও শব্দের উৎপত্তি এবং বিশিষ্ট প্রয়োগের উদাহরণ তিনিও সাধ্যমতো দিয়েছেন। তবে অক্সফোর্ড চেম্বার্সের মতো অভিধান বাংলায় এখনও সংকলিত হয়নি। কালানুক্রমিক পরিবর্ধনের বিচারেও কোনো বাঙলা অভিধান এখনও অক্সফোর্ডের সমতুল্য হয়ে উঠতে পারেনি। ১৯৮০-র দশকে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ অভিধান রচনার যে- বিশাল প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন, কোনও রকমে একটি খণ্ড প্রকাশ করেই তা অকাল পরিসমাপ্ত হয়েছে। সমার্থ শব্দকোষ এবং পরিবর্ধিত আয়তনের অভিধান প্রকাশ করে এক সাহিত্য সংসদই কিছুটা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। রাজ্য বাংলা আকাদেমির অভিধানে বানানরীতি ছাড়া, অন্য ক্ষেত্রে নতুনত্ব বিশেষ নেই।
অভিধানে একই শব্দের প্রতিশব্দ, বিভিন্ন অর্থ, বিবিধ ব্যবহার, বিশিষ্ট গুণ বা ‘পর্যায় শব্দ’- —সবই থাকে। ইংরেজিতে তাই অভিধানের শব্দকে বলা হয় ‘লেক্সিম’--শুধু শব্দার্থ নয়, শব্দ ব্যবহারের প্রকার-প্রকরণও তার সঙ্গে দেওয়া থাকে ; যেমন ‘গো’ শব্দের সঙ্গে গোয়িং, ওয়েন্ট, গন ইত্যাদি। কিন্তু তা সত্ত্বেও অভিধানে শব্দার্থ প্রায় স্থির নির্দিষ্ট। শব্দ সেখানে কখনোই সুর হয়ে বাজে না। ‘শ্রবণ' শব্দটির অর্থ শোনা এবং কান দুই'ই হয় ; অভিধানে তা বলাও আছে ; কিন্তু ‘ডালগুলি তার রইবে শ্রবণ পেতে’—রবীন্দ্রনাথের গানের এই অংশে শ্রবণ শব্দের যে অর্থ-ব্যঞ্জনা, অভিধানে তা পাওয়া যাবে না। শিরীষশাখা অলখজনের চবণশব্দে উৎকর্ণ হয়ে আছে--এতটা কাব্য কল্পনার সামর্থ্য অভিধানের নেই।
বলা হয়, অভিধানের শব্দার্থ স্থিতিশক্তি, তা গতি পায় সাহিত্যের অনুষঙ্গে। সমস্ত ভাষা সম্পর্কেই অবশ্য এ কথা প্রযোজ্য। দার্শনিক লুডভিগ হিটগেটস্টাইন আমাদের বার বার মনে করিয়ে দিয়েছেন, ভাষার অর্থকে পাওয়া যায় তার ব্যবহারের ভেতর দিয়ে। আমাদের দেশের নন্দনশাস্ত্রীরাও তা জানতেন। ফার্দিনান্দ সোসুরের অনেক আগেই ভর্তৃহরি বলে গিয়েছিলেন, শুধু বর্ণসমষ্টি কোনো অর্থ প্রকাশ করে না। সারা জীবন শব্দের কারবার করে রবীন্দ্রনাথও বুঝেছিলেন। শব্দের ক্ষমতা সীমিত ; বাংলা-ভাষা পরিচয়-এ তা নিয়ে চমৎকার আলোচনাও আছে।
একটি শব্দের অর্থ তার প্রতিবেশী শব্দের দ্বারা অনুভাবিত, নিয়ন্ত্রিত, এমনকী ‘স্থগিত’-ও হয়ে থাকে। ‘সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো, পাগল ওগো' কিংবা ‘পাগলা মন্টারে তুই বাঁধ’- এইসব মহৎ উচ্চারণের সঙ্গে আমরা যারা পরিচিত, তারা এটা একরকম বুঝি। এর জন্য জ্যাক দেরিদার শরণ না নিলেও চলবে। 'প্রেম বিকশিত হল' যখন বলি, 'বিকশিত' শব্দটির আভিধানিক অর্থ ব্যবহার করি না ; কিন্তু তা-তে কথাটির অন্তরার্থ বুঝে নিতে কোনো অসুবিধা হয় না।
শব্দের ব্যুৎপত্তি এবং আভিধানিক অর্থও অমোঘ, অবিসংবাদী নয়। জ্ঞানেন্দ্রমোহন ‘তে- তালা' শব্দের একটি অর্থ দিয়েছিলেন : বাদ্যের চালবিশেষ। যোগেশচন্দ্র রায় তা অনুমোদন করেননি। আবার যোগেশচন্দ্র ‘গুলো' শব্দের যে নিরুক্তি-নির্দেশ করেছিলেন, সে সম্পর্কে হেমন্তকুমার সরকারের বক্তব্য : 'তাহা ঠিক মনে হয় না।' যোগেশচন্দ্র বিশ্বাস করতেন, অভিধানে শব্দের অর্থ এবং বানান যথাসম্ভব সুনির্দিষ্ট হওয়া উচিত ; কিন্তু তিনি নিজে লিখতেন : ‘শব্দকোশ’। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং মুহম্মদ শহীদুল্লাহের ব্যবহৃত কিছু কিছু বানানও আমাদের বেশ অদ্ভুত মনে হয়। আবার কালচার অর্থে ‘কৃষ্টি' শব্দটি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কেন যে যোগেশচন্দ্র রায়ের সঙ্গে অত বিবাদ করেছিলেন, তা বুঝে উঠতে পারি না।
ভাষা ব্যাপারটাই মনগড়া, বা সোসুর যাকে বলেন ‘আরবিট্রারারি'। একই শব্দের এমন সব অর্থ হয় যাদের মধ্যে কোনো সম্বন্ধই নেই। বাংলায় 'রতি' বলতে মৈথুন এবং ওজনের একটি একক দুই-ই বোঝায়। ইংরেজি ‘পেন' শব্দটির দুটি অর্থ : কলম আর খোঁয়াড়। আর আঞ্চলিক শব্দ নিয়ে হিসেব করলে যে থই পাওয়া যাবে না তা পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান-এর (১৯৬৪) মতো শব্দ সম্ভারটি হাতে নিলেই বুঝতে পারি। পশ্চিমবঙ্গে আমরা এরকম কোনো সংকলন এখনও রচনা করে উঠতে পারিনি ; এক্ষেত্রেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রয়াসের অকালপ্রয়াণ ঘটেছে বলে জানি। তবে বিভিন্ন অঞ্চলের কিছু শব্দকোষ প্রকাশিত হয়েছে। কামিনীকুমার রায়ের লৌকিক শব্দকোষ দুই খণ্ড (১৯৬৯-৭০) এক অতি মূল্যবান সংকলন।
অমরকোষ থেকে রাধাকান্ত দেবের শব্দকল্পদ্রুম পর্যন্ত ধরে হিসেব করলে এদেশে অভিধান-রচনার এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে বলা যায়। বাংলায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংকলিত শব্দসংগ্রহ তাঁর মৃত্যুর পর সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, (১৩০৮-র ২য় সংখ্যা) ; তবে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির বাঙ্গালা শব্দকোষ-কেই (১৯১৫ খ্রিঃ) বোধহয় আমরা বাংলাভাষার প্রথম অভিধান বলতে পারি। ইংরেজি ভাষার অভিধান সংকলিত হয়েছিল সপ্তদশ শতকে। তার আগে মূলত গ্রিক এবং হিব্রু ভাষার শব্দ-সংকলনকে বলা হতো ‘লেক্সিকন’। ‘ডিকশনারি' শব্দটিও খাঁটি ইংরেজি নয় ; মধ্যযুগে (১২২৫ খ্রিঃ) লাতিন শব্দকোষ অর্থে Dictionarius থেকে উদ্ভূত। ভিক্টোরীয় যুগে তাই দাবি উঠেছিল, ওটার বদলে ‘ওয়র্ড বুক' লেখা হোক।
অভিধান রচনার ইতিহাস পাঠক যে-কোনো বিশ্বকোষে পেয়ে যাবেন। এখানে শুধু এইটুকু স্মরণ করিয়ে দিই অভিধান বা ব্যাকরণ কোনো নিরপেক্ষ বস্তু নয় ; তা অনেক সময়েই সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ বা উচ্চবর্গ আধিপত্যের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। স্পেন শুধু লাতিন আমেরিকা দখলই করেনি, তার নিজের ভাষার ব্যাকরণটাও চাপিয়ে দিয়েছিল সেখানে। ব্রিটেনে ইংরেজি অভিধানেরও আগে প্রকাশিত হয়েছিল টমাস এলিয়টের ল্যাটিন-ইংলিশ ডিকশনারি (১৫৩৮ খ্রিঃ)। আমরা বাংলায় পেয়েছিলাম রোমান লিপিতে লিসবন থেকে ছাপা পর্তুগিজ- বাংলা শব্দ কোষ (১৭৪৩ খ্রিঃ)।
অভিধান আমাদের দেশে শাস্ত্রকে শাসন করে। লোকায়ত দর্শন লিখতে গিয়ে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে তাই বার বার নিরুক্ত'-কার যাস্কর শরণ নিতে হয়েছে। সংস্কৃত ব্যাকরণ এবং অভিধানের অনুশাসন থেকে আমাদের বাংলা ভাষা এখনও সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারেনি। তবে অভিধান আমাদের অপরিহার্য সঙ্গী হলেও তা থেকে ভাষা শেখা যায় না। রবীন্দ্রনাথ অনেক আগেই লিখে গেছেন, পাণিনি-অমরকোষের ওপর নির্ভর না করে মানুষ ‘নিজের বর্ণনার ভাষা নিজেই’ তৈরি করে নিয়েছে।
সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়