একজন পড়ুয়ার চোখে কবি আহসান হাবীব
আহসান হাবীবের রাজনীতি-চেতনা শুদ্ধতায় পরিস্নাত। রাজনীতিকে তিনি কবিতার উপাদান হিসেবে গ্রহন কিংবা ব্যবহার করেননি। কেননা তিনি কবিতাকে রাজনীতির হুল্লোড়-মুখর অঙ্গন হিসেবে দেখতে চাননি।
সমাজ জীবনের সমগ্রতাকে ধারণ করেন কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী। কিন্তু তার পূর্ণাঙ্গ রূপায়ণ করতে পারেন না কেউই। একটি খণ্ডাংশকে যথার্থভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন মাত্র। আর শিল্পীর এই সমগ্রতার চেতনা আসে তাঁর আবেগ, বুদ্ধি, ইতিহাস, ঐতিহ্যবোধ, সমাজলগ্নতা, দেশপ্রেম, রাজনীতিচেতনা এবং জীবনদর্শন থেকে। চল্লিশের দশকের প্রধান কবি আহসান হাবীব (১৯১৭-৮৫) সমসাময়িক সামাজিক, আর্থনীতিক ও রাজনৈতিক ঘটনা পেয়েছেন। দেশের প্রতি তিনি ছিলেন স্বগত স্বাগত। দেশমাতা যখনই বিপদগ্ৰস্ত হয়েছে তখনই তার চেতনা হয়েছে অধিক সচেতন; কণ্ঠ হয়ে উঠেছে উত্তাল, উচ্চকিত । আহসান হাবীবের কবিতা তাই দেশপ্রেমে ও রাজনীতি চেতনায় অত্যন্ত প্রোজ্জ্বল ।
প্রথম মহাযুদ্ধপরবর্তী পরিবর্তিত সমাজ ও রাজনীতিক আবহে লালিত আহসান হাবীবের শৈশব এবং কৈশোর। এক প্রবল অস্থিরতা ও আবেগের যুগে বেড়ে উঠেছেন তিনি। অতঃপর যৌবনের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যন্ত্রণা অনিশ্চয়তা, আর সম্ভাবনাকে ধারণ করেছেন আপন সত্তায়। এবং সেই সময়ে তিনি সমাজ ও রাষ্ট্রকে যন্ত্রণার পঙ্কিলতা থেকে উত্তরণের শপথ নিয়েছিলেন। তিনি যুগের সমগ্র অসংলগ্নতা, অপরিচ্ছন্নতার অন্তরালে মানবতার রুচিশীল অগ্রগমন প্রত্যাশা করেছিলেন। এদেশের মানুষকে ভালোবেসেছেন আহসান হাবীব; অনুভব করেছেন সমগ্র জাতীয় সত্তা ও জীবন সংকটকে । কাব্যক্ষেত্রে তাঁর আবির্ভাব এই প্রবণতার আশ্রয়েই।
আহসান হাবীব কাব্যসাধনার শুরু থেকেই দেখে এসেছেন দেশের অস্থিতিশীল যন্ত্ৰণাবিক্ষুব্ধ অবয়ব। কাব্যচর্চার মধ্যগগনে দেশের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ শিল্পিত বোধে উন্নীত । ’৬৬, ’৬৯, ’৭০-এর স্বাধিকার আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের পেষণে অস্থিতিশীল, সংশয়ের দিনে তিনি স্বদেশকে উপলব্ধি করেছেন আত্মার উজ্জ্বল আভায়। মূলত আহসান হাবীবের কবিতায় রাজনীতিক অনুষঙ্গ এসেছে সযত্মে। এবং আধুনিকতার মঞ্চে তা অনিবার্যও বটে।
আহসান হাবীবের রাজনীতি-চেতনা শুদ্ধতায় পরিস্নাত। রাজনীতিকে তিনি কবিতার উপাদান হিসেবে গ্রহন কিংবা ব্যবহার করেননি। কেননা তিনি কবিতাকে রাজনীতির হুল্লোড়-মুখর অঙ্গন হিসেবে দেখতে চাননি। আর এ নিয়ে হৈচৈ করাও পছন্দ করতেন না তিনি। ব্যক্তিজীবনে যেমন ছিলেন নির্বিবাদী তেমনি প্রচারবিমুখ রাজনীতির পক্ষে ছিল তাঁর সচেতন অবস্থান। রাজনীতি তিনি বুঝেছেন, এর সংঘাত উপলব্ধি করেছেন। কিন্তু কবিতাকে কখনো রাজনৈতিক মঞ্চ হতে দেননি। সব সময় এ বিষয়টি থেকে অন্তরালে থেকেছেন । তবে আহসান হাবীব কবিতাকে করতে চেয়েছেন সুষ্ঠু রাজনীতির প্রেরণাশক্তি । তিনি মনে করতেন কবিতা রাজনীতি নিয়ে হৈচৈ না করে বরং আড়ালে থেকে এর চর্চায়, চাষে দেবে নির্মোহ প্রেরণা ও অবাধ উৎসাহ উদ্দীপনা। তাইতো শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘বিদীর্ণ দর্পণে মুখ’ (১৯৮৫) এর ‘পরিক্রম ও অবস্থান প্ৰসঙ্গ’-এ লিখেছেন— ‘কবিতাকে রাজনৈতিক বক্তৃতা করে তোলার পক্ষপাতী নই। বরং কবিতা হোক রাজনৈতিক মঞ্চের বিশুদ্ধ প্রেরণা ।’
আহসান হাবীবের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রিশেষ’(১৯৪৭)-এ শ্লোগান-চারিত্র্যের প্রকাশ ছিলো। রাজনীতি বিষয়ে সে-সময়ে তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল কিছুটা উচ্চকিত। অবশ্য যুগ-যন্ত্রণার প্রভাবে তা অনিবার্যতা দেশ-ভাগের সমসাময়িক স্বদেশ এবং বিশ্ব রাজনীতির পরিবেশ নানাবিধ জটিলতায় হয়ে পড়েছিল সংঘাতময় । আহসান হাবীব স্বদেশের রাজনীতির আবাহকে শিল্পে রূপ দিয়েছেন বাস্তবতার নিরিখে। তাঁর ভাষায়—
‘অরণ্যে আগুন জ্বলে, সে আগুন প্রান্তরে ছড়ায়।
আকাশ-সীমান্ত থেকে ভেসে আসা বেনামী হাওয়ায়
সে আগুনে পৃথিবী নগরী ও গ্রাম
এক সাথে জ্বলে
সে আগুন ধূমায়িত পৃথিবীর হৃদপিণ্ডতলে।’
(আগুন : রাত্ৰিশেষ)
আবার তিনি রাজনীতির প্রবল বেগ এবং আবেগের সমন্বয় করেছেন এভাবে—
‘হে বাঁশরী অসি হও তুমি
কেননা দুর্গের দ্বারে হানা দিল হায়েনা নয়ন
কেননা উদ্যত আজ শানিত নখর বহু
শিবিরের উলঙ্গ আকাশে’
(হে বাঁশরী অসি হও : রাত্ৰিশেষ)
পরবর্তীসময়ে আহসান হাবীব শ্লোগান-সর্বস্বতা থেকে তাঁর কবিতাকে সরিয়ে রেখেছেন নিশ্চিত দূরত্বে। তিনি জানতেন চীৎকারের প্রাধান্য কবিতাকে ম্লান করে দিতে পারে। আর সেকারণেই তিনি কবিতায় আরোপ করলেন রাজনৈতিক চেতনা-প্রবাহের উজ্জ্বল প্ৰাণশক্তি ।
আহসান হাবীবের কবিতা শান্ত স্নিগ্ধ সুরে সংগ্রামের ডাক দিয়ে যায়। অত্যাচারী শাসকের শোষণে ‘নীড়হারা শান্তিহারা’ মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে তাঁর কবিতা যুগিয়েছে ভাষা। আর দিয়েছে অফুরন্ত প্রেরণা—
‘আমার সৈনিক প্রেম
শপথের স্বাক্ষর করে দান ।
নীড়হারা শান্তিহারা মানুষের বিশীর্ণ নয়নে,
দেহের কঙ্কালে তার
আর তার মনোরাজ্যে
কে জ্বেলেছে নতুন মশাল,
আর তার হাতে সংগ্রামের ঘোষণা এবার।’
(প্রেম নারী মানুষ ঘোষণা : ছায়া হরিণ)
তাঁর কবিতায় অনুষঙ্গে ‘মিছিল’ এসেছে একাধিকবার। কিন্তু তা চীৎকার সর্বস্বতার মাধ্যম হয়ে নয়; বরং আন্দোলন ও প্রতিবাদের জীবন্ত প্রতীক হিসেবে । একটি মিছিলের উদ্দামতা যেন দেশের নিপীড়িত, শোষিত মানুষকে নতুন প্ৰত্যাশায় উদ্ভাসিত করে তোলে—
‘মিছিলের মুখ দেখো
দেখো তার যারা মুখে দেখো
দেখো লক্ষ জনতার প্রাণ
অমর দীপ্তিতে জ্বলে মিছিলের সারামুখে দেখো ।
মিছিলে অনেক মুখ
আর সেই মুখের আভায়
পথের ধুলোয় দেখো আগুন জ্বলে’
(মিছিলে অনেক মুখ : আশায় বসতি)
প্ৰবল মনোবলকে আশ্রয় করে যেমন তিনি অসুস্থ স্বদেশের সঙ্গে স্থাপন করেছেন নৈকট্য;
তেমনি অগণিত জনতার সংমিশ্রিত হার্দিক ভাবাবেগ তিনি জমে উঠতে দেখেছেন একান্ত প্ৰেমে ও প্রজ্ঞায় । সন্তান-সম্ভবা মায়ের প্রসব বেদনার মত আসন্ন নবজন্মের ইঙ্গিত বহন করে তাঁর এই বোধ । সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে সমবেত প্রচেষ্টায় একটি ভূখণ্ডকে নিয়ে যেতে পারে শৃঙ্খলমুক্ত মুক্ত বাতাস সমৃদ্ধ কাঠামোতে। আহসান হাবীব এখানে অপরাজিত দেশসত্তার মূর্ত প্রতীক। অবশ্য তিনি দেশাত্মবোধকে অহমিকার উঁচু তাকে যত্নে তুলে রাখেননি। তিনি মা, প্ৰেয়সী আর দেশকে একটি সরল সমীকরণে আবদ্ধ করেছেন— ‘মাকে আর প্ৰেয়সীকে আর এই দেশকে / আমি ভালোবাসি এই ছোট কথাটি প্রত্যহ / নানা রঙে / এঁকেছি তোমার বিচিত্র রঙের তুলি হাতে নিয়ে।’
(তোমাতে অমর আমি : ছায়া হরিণ)। হৃতগর্ব দেশের অসহায়ত্ব সচেতন মানুষকে বিস্মিত করে, নাড়া দেয় আমূল চেতনায়। প্ৰবল আত্মসচেতন কবি আহসান হাবীবও তার মানবিক বোধে সুসজ্জিত। এবং তাঁর এই সচেতন আত্মা সর্বোপরি সমৰ্পিত দেশের হৃৎপিণ্ডের গহ্বরে ।
আহসান হাবীব উপলব্ধি করেছেন ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় অর্থহীন, বিত্তহীনদের অসহায়ত্বের সীমা নেই। এই পৃথিবী, তাদের আপন দেশ, এমনকি সংসার, স্ত্রী-সন্তানাদি সবই তৈরি করে এক দুর্ভেদ্য ভেদরেখা। যা তারা শত চেষ্টায়ও ছিন্ন করতে পারে না, আপন ভাবতে পারে না বস্তুবিশ্বের কোন বস্তুকে । আহসান হাবীব দেখেছেন ‘নেই জগতের / সব বাসিন্দারা সঙ্গী হয়ে / নতুন মাটি কাটছে।’ কেননা তারা এখন রাজনৈতিক সামাজিক বৈষম্যকে অতিক্রম করে সাম্যবাদী সমাজ তথা রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়। কবি লিখেছেন—
‘সবাই মিলে
নতুন নতুন শহর গড়ব
নতুন নতুন গ্রাম বানাব
সবই নতুন
নতুন পথ আর নতুন বাহন
চলাফেরার এক ব্যবস্থা।’
(আমার আমার ; মেঘবলে চৈত্রে যাবো)
এমন আন্তরিকভাবে, এমন স্বতঃস্ফুর্তভাবে বলার ভঙ্গি ও কৌশল বাংলা কবিতায় খুব পাওয়া যায় না। শান্ত অথচ কী কঠোর, তীক্ষ্ম ঘোষণা! অন্যায়ের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে এ এক নিখাদ জোরালো প্ৰতিবাদ । যেন রাজনৈতিক বিপ্লবসাধনের মন্ত্র উচ্চারণ। যদিও আহসান হাবীবের কবিতা সমগ্র জাতির প্রাণে প্রবল আলোড়ন তুলতে পারেনি। কিন্তু তবু তাঁর প্রত্যাশা এবং উত্তরণের অঙ্গীকার ও আহ্বান সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি সচেতন মানুষের প্ৰাণে আবেগ ও সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। জাতীয় মহাসংকটের যুগে এ আশাবাদ কম আবেদনের নয়। যখন কবি সাহিত্যিকদের একটা বড় অংশ নিমজ্জিত নিরাশা আর হতাশায় তখন আহসান হাবীবের—‘ভগ্নস্তুপে তবু বাঁধলাম নীড়’—এক অমোঘ মন্ত্রের মতোই শোনায়।
এক বলিষ্ঠ প্ৰত্যয় ছিল কবি আহসান হাবীবের সত্তায় । তিনি অস্তিত্বের প্রতি ছিলেন সদা সতর্ক। সর্বোপরি মননশীল শিল্পবোধ প্রবহমান ছিলো তাঁর চিন্তার গভীরতায়। প্রবল শক্তির কাছে কখনো মাথা নত করেন নি। ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের পেষণে বিলীন হবার পক্ষপাতী ছিলেন না তিনি। সময়ের দাবিতে ঔপনিবেশিকতার ছায়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা অসম্ভব—এও তিনি জানতেন। তবে নিজস্ব সত্তা বিকাশেও ছিলেন সমান সচেতন । তিনি শাসকদের শোষণ থেকে শিক্ষা নিয়েছেন এবং সর্বদা আপন ভাবনায় ও অস্তিত্বের শিকড়ে থেকেছেন অবিচল, অনড়। ব্যক্তিত্ব অটুট রাখার এক দৃঢ়কঠিন শর্তে স্থিতধী তিনি। মূলত আহসান হাবীব নিজস্বতা রক্ষার প্রতিজ্ঞায় সীমাহীন সাহসী । তিনি লিখেছেন—
‘আমাকে বিশাল কোনো সমুদ্রের ঢেউ হতে বলো।
হতে পারি যদি এই প্রতিশ্রুতি দিতে পারো
সমুদ্রের ঢেউ
হারায় না সমুদ্রের গভীরে এবং
ফিরে আসে শৈশবে নদীর আশ্রয়ে।’
(সমুদ্র অনেক বড় ; ছায়া হরিণ)
দেশের প্রতি এক প্রগাঢ় নিবিষ্টতায় আহসান হাবীব ছিলেন আত্মগত। এই সমাজ ও সংস্কৃতির সমকালের সন্তান তিনি। এই সমাজের ঐতিহ্যেই শিকড়ায়িত। এই ভূখণ্ডের মাটির গন্ধ, তার শরীর ও সত্তায় নিবিড়ভাবে মিশে আছে। তিনি এদেশের আত্মার পরম আত্মীয়। আগন্তুক ছিলেন না আহসান হাবীব। কোন অভ্যাগত নন। এই মাটি, নদী, গ্রাম, নগর এবং সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি তাঁর অস্তিত্বের সংগঠন প্রক্রিয়ার মূলীভূত প্রেরণা। স্বদেশের সন্তান কবি আহসান হাবীব তাই দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেন অস্তিত্বের দাবি।
‘আসমানের তারা সাক্ষী
সাক্ষী এই জমিনের ফুল, এই
নিশিরাইত বাঁশবাগান বিস্তর জোনাকি সাক্ষী
সাক্ষী এই জারুল, জামরুল সাক্ষী
পুবের পুকুর আর ঝাঁকড়া ডুমুরের ডালে স্থিরদৃষ্টি
মাছরাঙা আমাকে চেনে।
আমি কোনো অভ্যাগত নই
খোদার কসম আমি ভিনদেশী পথিক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই।’
(আমি কোনো আগন্তুক নই ; দু’হাতে দুই আদিম পাথর)
এখানে তাঁর প্রবল দেশপ্রেমই প্রকাশিত হয়ে ওঠে। এমন দৃঢ় দেশলগ্নতা বিরল। এই বোধ হাবীবের মজ্জাগত। তাঁর সত্তায় নিয়ত দেশের প্রতি এক অসীম অকৃত্রিম মমতাবোধ ক্রিয়াশীল বলেই এমন প্ৰকাশ সম্ভব ।
দেশপ্রেম এবং রাজনীতিবোধ আহসান হাবীবের সত্তায় গ্রথিত। যে মাটি তাঁকে লালন করেছে। বিষয় বৈচিত্র্যে হাতে তুলে দিয়েছে অপার প্রেরণা যে-মাটি সর্বদাই তাঁর কাছে উজ্জ্বল আভায় উদ্ভাসিত । আবার নিজ সমাজ ও দেশের সংকটময় মুহুর্তে তাঁর রাজনীতি-সচেতন মানস আন্দোলিত হয়ে ওঠে অতি সহজেই।