নৈতিকতার পুনর্নির্মাণ: এআই যুগের চ্যালেঞ্জ
আমার কথায় হয়তো মনে করবেন আমি পাগল হয়ে গেছি! তবে নিশ্চিত থাকুন একটুও হইনি। আমাদের চিরপরিচিত পৃথিবী আর আগের অবস্থায় নেই, একদমই নেই। আমরা অনেকেই ব্যাঙের মতো জীবন কাটিয়েছি, পানি গরম হচ্ছিল, কিন্তু আমরা কিছুই টের পাইনি। হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম সবকিছু কত দ্রুতগতিতে বদলে যাচ্ছে, বিশেষ করে ২০২০ সালের অতিমারি আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিল আমরা কতটা অসহায়!
অতিমারি'র কথা মনে করলে এআই-এর দ্রুত উত্থান একই রকম মনে হবে। প্রথম প্রথম ১০০, ১০০০, এমনকি ১০,০০০ জন হলেও আমরা খুব একটা চিন্তিত ছিলাম না, যখন এই সংখ্যা মিলিয়নে পৌঁছালো তখন বুঝতে পারলাম বিপদ কত বড় ! এআই-এর ক্ষেত্রেও একই রকম হচ্ছে। আপনি যদি এআই-কে গুরুত্ব না দেন, তবে এটা আপনার জন্য অদৃশ্যই থেকে যাবে।
স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, আমাদের পৃথিবী বদলে যাচ্ছে আর এই পরিবর্তনের মূল কারণ— এআই । অনেকেই হয়তো ভাবেন এআই এখনও ভবিষ্যতের বিষয়, কিন্তু ইতিমধ্যেই আমাদের জীবনে এআই-এর প্রবেশ ঘটেছে। এই পরিবর্তন চ্যাটজিপিটির আগেই শুরু হয়েছিল। ২০০৯ সালে গুগলে আমরা দেখেছিলাম একটা মেশিন নিজ থেকে ইউটিউব ভিডিও দেখে বিড়াল চিহ্নিত করতে শিখে গেছে। যা ছিল মেশিন লার্নিংয়ের একটা বড় উদাহরণ। মেশিন নিজে নিজে শিখতে শুরু করেছে।
তারপর থেকে এআই মানুষের চেয়ে অনেক দ্রুতগতিতে এগিয়েছে। আজ এআই— মেশিন কোড লিখতে পারে, ছবি আঁকতে পারে, গান রচনা করতে পারে, এমনকি দাবার মতো জটিল খেলায় জয়ী হতে পারে; এখন প্রায় সব কাজেই মানুষকে ছাড়িয়ে গেছে এআই। আমার মনে হয়, বর্তমানে আমরা একটা বিশেষ সময়ে এসে পৌঁছেছি— যেখানে সবকিছু এত দ্রুত বদলাবে (বদলাচ্ছে) যে পৃথিবী আর আগের মতো থাকবে না।
কেউ কেউ হয়তো ভাববেন, “এর মানে কি পৃথিবীর ধ্বংস?” না, আসলে তা না। কিন্তু এআই পৃথিবীকে এমনভাবে বদলে দেবে যে আমরা কল্পনাও করতে পারি না। যেমন আমরা বিদ্যুৎ ব্যবহার করে বহু কাজকর্ম করি, ঠিক তেমন করে আমরা এআই ব্যবহার করে আমাদের বুদ্ধি বাড়াতে পারবো। বুদ্ধিমত্তার প্রাচুর্য্যের ভবিষ্যত-পৃথিবী যে কেমন হবে তা নিশ্চিত করে এখনও বলা যাবে না।
একটি অন্ধকার দিকও কিন্তু আছে। নতুন প্রযুক্তি সবসময় ক্ষমতাবানদের আরো ক্ষমতাবান করে তোলে। এআইও তাই করবে। যারা এআই ব্যবহার করতে শিখবে তারা অন্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকবে। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মানুষে-মানুষে সম্পর্ক (আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক)। এআই এখনই আমাদের মতো আচরণ করতে পারে। চ্যাটজিপিটির মতো এআই আমাদের সাথে কথা বলতে, হাসতে, এমনকি গানও করতে পারে। একদিন হয়তো আমরা আর বুঝতেই পারবো না যে আমরা আসলে যার সাথে কথা বলছি, সে আসল-মানুষ নাকি কৃত্রিম মানুষ।
আমি মনে করি, সবকিছুর পর এআই আমাদের শত্রু নয়। আসল সমস্যা হলো আমরা কীভাবে এআই ব্যবহার করবো। এআই একটা শিশুর মতো, যার রয়েছে অনেক ক্ষমতা; সুপার পাওয়ার। মানুষের ব্যবহারের পরই এটা সুপারম্যান বা সুপারভিলেন হতে পারে। প্রযুক্তি নিরপেক্ষ, আমরা কীভাবে এটাকে ব্যবহার করি তা-ই গুরুত্বপূর্ণ। ভিন্ন যেকোন প্রযুক্তির মতো আমরা এটাকে ভালো কাজে বা খারাপ কাজেও লাগাতে পারি। এআই ব্যবহারে আমাদের এমন নীতি তৈরি করতে হবে যাতে এটি মানবতার সাথে-সাথে সব প্রাণীর কল্যাণেই কাজ করে।
যখন আমি এআই সম্পর্কে ভাবি তখন আমার মনে মানুষে-মানুষে মধ্যকার সম্পর্কের (আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক) কথা আসে। মেশিন অনেককিছুই পারে, সাথে পারে মানুষের মধ্যে যে গভীর সম্পর্ক গড়ার ক্ষমতা তা লোপ করতে। যারা ব্যবসা, চাকুরী বা ব্যক্তিগত জীবনে মানুষের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়তে পারবেন, তারাই এই নতুন যুগে সফল হবেন। এআই যত বিস্তার লাভ করবে, আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক (মানুষে মানুষে সম্পর্ক) ততই মূল্যবান হয়ে উঠবে।
তাহলে আমাদের কী করতে হবে?
প্রথমত— নতুন এই প্রযুক্তি শিখতে হবে। এআই এখন জীবনের অংশ, তাই এর প্রতি আমাদেরও অগ্রসর হতে হবে। এআই টুল ব্যবহার করে কাজ-কর্ম স্বল্পসময়ে সুসম্পন্ন করা শিখে নিতে হবে ।
দ্বিতীয়ত— আমাদের সত্যানুসন্ধানী হতে হবে, অর্থাৎ 'সত্য' খুঁজে বের করা। বর্তমানে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য খুব সামান্য, তাই কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা আমাদের তা জানতে, বুঝতে হবে।
শেষত— অন্য যেকোনো সময়ের চাইতে মানুষে-মানুষে সম্পর্ক গড়ে তোলা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সুসম্পর্ক মানুষকে মানবিক আর সুস্থ থাকতে সবচেয়ে শক্তিশালী নিয়ামক। সুসম্পর্কের বন্ধন এমন একটা বিষয় যা শুধুমাত্র মানুষই পারে, মেশিন/এআই কখনোই করতে পারবে না।
সংক্ষেপে, সময়টা বিরাট পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে। এআই আমাদের জীবনকে সম্পূর্ণ বদলে দিতে পারে, এ ক্ষমতা তার রয়েছে; যে কোনো দিকেই হতে পারে এই বদল— ভালো বা মন্দ। শুধুমাত্র আমাদের সিদ্ধান্তেই নির্ভর করছে এআই কেমন করে গড়বে আমাদের ভবিষ্যৎ। এটা কেবলমাত্র প্রযুক্তি-বিপ্লব নয়, নৈতিক বিপ্লবও। আপনার ভবিষ্যৎ আপনার সিদ্ধান্তে— পছন্দ আপনার।