সেই কোন ছোট্টবেলায়, বাবার বইয়ের তাক খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গিয়েছিলাম এক বই- ছেলেদের রামায়ণ। তখন আমি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি বোধহয়। বইয়ের শিরোনামের ‘ছেলেদের’ শব্দটা যদিও আমাকে অনেক ভুগিয়েছিল (ভেবেছিলাম বোধহয় সেই বইটা ‘মেয়েদের নয়’ সেই অর্থে লেখা) সাদাকালো ছবির সাথে সহজ করে লেখা রাম-সীতা-রাবণের গল্প আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে দিয়েছিল। কয়েকদিনেই পড়ে শেষ করেছিলাম বইটা। আর বাবাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলাম প্রশ্নের পর প্রশ্নে। এর পরপরই আমার হাতে এসেছিল ভবেশ রায়ের ‘বিশ্বজয়ের কথা’। উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু, নায়াগ্রা জলপ্রপাত, মেরুভালুকদের গল্পের সাথে সাথে আমার চোখে ছবি আঁকা হয়ে গিয়েছিল লিভিংস্টোন, স্ট্যানলি, ক্যাপ্টেন কুক নামের মানুষদের! এই বইটা আমি কতবার যে পড়েছি বড়ো হতে হতে! এই দুটো বই পড়তে গিয়েই আমি বোধহয় আবিষ্কার করেছিলাম যে বই এমন এক আনন্দের জগত যার কোনো শেষ নেই। সেই শুরু, তারপর থেকে আমার স্কুল আর খেলার বাইরে যে সময়টা ছিল পড়াশোনার, তাতে নিজের ক্লাসের পড়া আর কতটুকুই বা, সব পড়ারা যেন লুকিয়ে থাকত বাবার মোটা মোটা ঢাউস বইয়ের পাতায়। কত বিচিত্র নামের, বিচিত্র আকারের সেইসব বই আমাকে নিয়ে গেছে কত শত জায়গায়, কত শত চরিত্রের কাছে।
বাবার বইগুলো থরে বিথরে সাজানো ছিল তার বইয়ের তাকে, কিছু আলমারিতে। সেখান থেকে আমরা সবাই পড়তাম। অত ছোটোবেলায় বড়োমানুষদের বই পড়তাম বলে বাবা কোনোদিন রাগ করেনি, নিষেধ করেনি পড়তে। মনে আছে, ক্লাস ফোরে তখন, দাদু আমার হাতে একটা বই দেখে বলেছিলেন- “তুই নভেল পড়িস এই বয়সে?”
তখন আমি নভেল শব্দের অর্থ জানি না। দাদু ভালো বললেন কি খারাপ তা জানার জন্য বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাবা হেসে বলেছিল- “বেশ তো। দাদু এরপর জিজ্ঞেস করলে বলিস, দাদু, বাবাই আমাকে নভেল পড়েতে বলেছে।” তো আমি সেই বয়সেই জেনে গিয়েছিলাম, আর যাই হোক, নভেল পড়া মোটেই খারাপ কিছু নয়, কক্ষণো নয়।
বাবার সংগ্রহে বাচ্চাদের বই ছিল না বলতে গেলে। আমাদের জন্য বাবা কিছু বই কিনেছে পরে, কিন্তু তারপরও আমাদের আগ্রহ ছিল বাবার নিজের বইগুলোতেই। কারণ শিশুতোষ সেসব বই খুব দ্রুত শেষ হয়ে যেত কিন্তু বাবার কেনা উপন্যাস, গল্প সংকলন, নাটকের বইগুলো যেন ঘোরের জগত। কত ব্যাপ্তি সেগুলোর! কত চরিত্র, কত জায়গা, কত ঘটনা!
বাবার কাছেই হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ, হাসান আজিজুল হক, মমতাজউদ্দীন আহমদ, শংকর, বিমল মিত্র, সুনীল, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, জীবনানন্দ দাশ, রবীন্দ্রনাথের নাম জেনেছিলাম। গীতবিতান পড়তে খুব ভালো লাগত আমার। আমাদের বাড়িতে গানের চর্চা ছিল না কিন্তু কবিগুরুর গান ঐ সময়েই এত ভালো লাগত! ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ও পড়ে ফেলেছিলাম প্রাইমারি স্কুলে থাকতেই। পড়েছিলাম বিবেকানন্দের ‘বেদান্ত: মুক্তির বাণী’। বলা বাহুল্য কিছুই বুঝিনি সেসবের, যেসব বই ছোটোবেলায় পড়েছি, সেই সমস্ত বইই বড়োবেলায় পড়েছি আবার, কোনো কোনোটা আবারও একাধিকবার। বাবা নিশ্চয়ই জানত তার অতটুকু মেয়ে ঐসব মলাটবন্দী কালো অক্ষরগুলোর এক বর্ণও বোঝে না কিন্তু কোনোদিন নিষেধ করেনি পড়তে। বাবা বলতো- “হাতের কাছে যা আসে, সব পড়বি। তাহলে একদিন কাউকে বলে দিতে হবে না কোন বইটা পড়তে হয় আর কোনটা নয়।”
বই নিয়ে বলা বাবার কথাগুলো এই এত বছরেও আমি ভুলে যাইনি। কী আশ্চর্য! কতকিছু ভুলে গেছি এ জীবনে! বোধহয় বাবা সব সময় পড়তে উৎসাহ দিত বলে, বোধহয় বাবা কখনো ‘আউটবই’ পড়ে তার ছেলেমেয়েরা বখে যাবে সেকথা বিশ্বাস করত না বলে, বোধহয় বাবা চাইত তার ভেতরের পড়ুয়া সত্ত্বাটা তার ছেলেমেয়েদের মধ্যে থেকে যাক বলে- আমি এখনো সেই কথাগুলো বুকের ভেতর নিয়ে বেড়াই। এখনো বইয়ের দোকান গেলেই আমার ছোট্ট মেয়েটার জন্য অবশ্যই একটা বই কিনি।
ক্লাস ফোরে থাকতে বাবা আর আমি আমাদের পাশের হাউস্কুল লাইব্রেরির সদস্য হয়েছিলাম। দাদা তখন ঐ স্কুলেই পড়ে, সেও সদস্য ছিল। আমরা তিন জনে একেক বছর সেই লাইব্রেরির ‘শ্রেষ্ঠ পাঠক’ হতাম। একবার বাবা আর আমি দুজনেই একসাথে শ্রেষ্ঠ পাঠক হয়েছিলাম, কী যে ভালো লাগার ঘটনা ছিল সেটা আমার জন্য! বাচ্চাদের বই আমি সবচেয়ে বেশি পড়েছি এই লাইব্রেরিতেই। রূপকথার গল্প, ঈশপের গল্প, পাগলা দাশু, হযবরল সবার সাথে পরিচয় এখান থেকেই। ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কু, শার্লক হোমস, কাকাবাবুর সাথে অবশ্যই প্রচুর নাটক, উপন্যাস পড়া হতো তখনো।
বাবার বেতনের দিন মানেই বাড়িতে অন্তত একটা নতুন বইয়ের আগমন। পরে অবশ্য দ্বিতীয় স্ট্রোকের পর বাবার চোখের বেশ ক্ষতি হওয়ার কারণে বই কেনার এই নিয়মটা বন্ধ হয়ে যায়। মনে আছে বাবা শেষবার কিনে এনেছিল ‘বঙ্কিম উপন্যাসসমগ্র’। আমি তখন ক্লাস সিক্সে। বাবা, দাদা আর আমি পালাক্রমে সেই বই পড়তাম যার যখন সময় হতো। সে কী একটা সময়! ঐ বয়সের চোখ দিয়ে আয়েশা, বিক্রমসিংহ, রজনী, চন্দ্রশেখরদের দেখার সে কী অভিজ্ঞতা!
চোখের সমস্যাটা বেড়ে যাওয়াতে তারপর বাবার বই কেনা বন্ধ হয়ে গেল। স্কুল লাইব্রেরির বইগুলো স্কুল ছুটির পথে আমার সঙ্গে বাড়ি আসত। ততদিনে অনেক লেখকের সাথেই নতুন করে পরিচয় হয়ে গেছে। আগের পড়া লেখকদের অন্যান্য বইও পড়া হয়ে গেছে। প্রায় সময়েই আমি বইগুলো বাবাকে দেখাতাম। প্রচুর গল্প করতাম আমরা বই নিয়ে।
বাবার সাথে এখনো বই নিয়েই সবচেয়ে সহজভাবে আর স্বচ্ছন্দে কথা বলা যায়। বড়ো হতে হতে ছোটোবেলার সেইসব দিন ছেড়ে এসেছি একটু একটু করে। কেবল সেইসব আনন্দময় ক্ষণ, সেইসব নতুন পুরনো বইয়ের গল্পমাখা দিন আর একটা ভীষণ আদুরে বাবার স্মৃতিময় ঘ্রাণ আমি বুকপকেটে করে নিয়ে ঘুরি আজও।