বিয়োগরেখা
পৃথিবীবিচ্ছিন্ন ইলোরা বসে আছে। নিঃস্ব। শূন্য ইলোরা। যেন খুব প্রিয় একটা কিছু হারিয়ে গেছে, চলে গেছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে-বুকের গভীরে শূন্যতার তীক্ষ্ণ একটা তীর বিঁধে আছে শুধু।
খত্বিক ঘটকের সুবর্ণরেখা পড়েছি অনেকদিন হলো। সবিনয়ে বলে রাখি, আমি সমালোচক নই। যা পড়ি, যা ভালোলাগে তাই লিখি। সম্প্রতি পড়লাম সাদিয়া সুলতানার বিয়োগরেখা। নারী জীবন যারা চিরকাল বঞ্চিত হয়ে এসেছে সেসব মানুষগুলির মর্মন্তুদ জীবন কাহিনীই তাঁর বিয়োগরেখায় নিপুণভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে। নারী জীবনের রোমান্স তাঁর গল্পে স্থান পেতে পেতেও পায় না, জীবনবাস্তবতার নির্মম চিত্রণে তিনি লেখাকে সমৃদ্ধ করেন। সবকিছু নিয়েই তাঁর গল্প তৈরি হয়, রান্না বান্না বাস অফিস বাড়ি ঘর পিরিয়ড থেকে গল্প বলা বা কথা রচা। পাতায় পাতায় ছবি দিয়ে গল্প ও কথার নজির হাজির করেন সাদিয়া সুলতানা। W. W. Robson তাঁর "The definition of Literature" গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন— "We are now in a period of crisis. Every man, who is acutely alive is acutely wrestling with his own soul." এখানে শুধু man কে পাল্টে Woman করে নিলেই বিয়োগরেখার মূল সুরটি ধরা দেবে। বিয়োগরেখা উপন্যাসে নারীর সংকট ও সংকটের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার এক দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষার কথাই বলা হয়েছে। তাঁর গল্পের নারী চরিত্র দুঃস্বপ্ন দেখতে চায় না। নিজের মুখোমুখি হতে চায় না। পালাবার পথ খোঁজে, আঁধারে, আলোতে। সমাজের হাতে দীর্ণ হতে হতে লোরা একটু স্বস্তি খোঁজে। কিন্তু স্বস্তি কি এতই সোজা? পথ নেই, চারদিকে গোলকধাঁধা। পাঠককে সেই গোলকের মধ্যে পুরে ছুঁড়ে ফেলেন সাদিয়া। পাঠক সেই গোলকের মধ্যে গড়িয়ে গড়িয়ে চলে। গল্পের ইলোরা স্বস্তিলাভের আশায় ঘুরে বেড়িয়েও স্বস্তি তার স্বপ্নই থেকে যায়। স্বস্তিলাভের আশায় সমাজের নির্দেশ অমান্য করে নিজের শরীরের সঙ্গে ঘর বাঁধে ইলোরা… বাবার মিষ্টি ডাক লোরা। আদরের লোরা, ভালোবাসার লোরা।
আমি বিয়োগরেখা পড়ে ব্যাথিত হয়েছি। লোরাকে স্বান্তনা দিতে চেয়েছি। সকলেই খারাপ নয়, কেউ কেউ খারাপ। যে ব্যাধির আখ্যান সাদিয়া লিখেছেন, সেই ব্যাধির শিকার সমগ্র রাষ্ট্র ব্যবস্থা। স্বল্পদীর্ঘ উপন্যাসটির ভাষা কি চমৎকার। "…পৃথিবীবিচ্ছিন্ন ইলোরা বসে আছে। নিঃস্ব। শূন্য ইলোরা। যেন খুব প্রিয় একটা কিছু হারিয়ে গেছে, চলে গেছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে-বুকের গভীরে শূন্যতার তীক্ষ্ণ একটা তীর বিঁধে আছে শুধু।" এই কথাগুলি তো কবিতা হতে পারতো? এমন;
পৃথিবীবিচ্ছিন্ন ইলোরা বসে আছে
শূন্য ইলোরা
যেন খুব প্রিয় একটা কিছু
হারিয়ে গেছে, চলে গেছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে
বুকের গভীরে শূন্যতার তীক্ষ্ণ
একটা তীর বিঁধে আছে শুধু
সাদিয়ার গল্প গল্পের বাঁধনে বাঁধা থাকে না। আমার মধ্যেও প্রবেশ করে। আমার বিয়োগরেখা পড়া ফুরোয়, কিন্তু রেশ ফুরোয় না। আমি ও ইলোরা হাঁটতে হাঁটতে দুজনে সেই জীবনে পৌঁছে যাই, যেখানে কোনো ক্লেদ নেই, নেই কোনো বিষাদ। আমার ইচ্ছে করে লোরার বিয়োগরেখাগুলি সমুদ্রের বুকে লীন করে দেই।