তিনি এসেছিলেন ঝড়ের পরে। সাতাত্তরের এপ্রিলে। মাত্র তিন মিনিটে একটি শহর লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। আমাদের টিউকলটি একটি নারিকেল গাছে স্প্রিংএর মতো পেঁচিয়ে গিয়েছিল। টিনের ঘরগুলো কাগজের মতো হাওয়ায় উড়ছিল। আর অনেকের মতো আমাদের হারুনকাকুকে পাওয়া গিয়েছিল নদীর অন্যপাড়ে। সকালে তিনি গাছপালা-ঘরবাড়ি উজিয়ে এলেন। আমরা দুভাই, মেঝ বোনটি আর বাবা—নিঃসহায়ের মত বসে আছি। মা গেছে মামাবাড়ি। তার কোনো সংবাদ তখনো পাইনি। তিনি এলেন আর বাবা উঠে দাঁড়াল।
তিনি হাত ধরে নিয়ে গেলেন সারা শহরে। ঘুরে ঘুরে দেখালেন—প্রবল ঝড়ের পরে মানুষ জেগে ওঠেছে। আবার দাঁড়িয়ে যাচ্ছে মানুষের ঘরবাড়ি আর ঠিকানা। তার কাছে আঁক কষি। এর ফাঁকে ফাঁকে পড়ে শোনাতে হয় মহাভারত আর তিনি শোনান রবীন্দ্রনাথ স্মরণ থেকে। তিনি বলেন আর লিখি বড় বড় কাগজে শাপলার অপার গুণের কথা। মোড়ে মোড়ে দেওয়ালে দুজনে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেই। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শহরের হাটে হাটে বলতে হয় শুষণি শাকের কথা। মাঝে মাঝে শেলফ থেকে বের করে আনেন একটি ছোট ডাইরি। লিখেছেন তার ছোট ছেলে।এই ছেলেটি রবীন্দ্রনাথ হবেন এই শুধু আশা। তার একটি কবিতার বই বেরিয়েছে— যুগশিখা। তিনি রবীন্দ্রনাথ হলে আমাদের মন খুশি হবে।
আমার নিজের দাদু বছর দুয়েক আগে নাই হয়ে গিয়েছেন। তাই এই দাদুটির সঙ্গে আমার দিন কাটে। বিকেলে গরুটি নিয়ে বের হন নদীর পাড়ে। শুভ্র চুল—ওড়ে শ্মশ্রুদল। এক হাতে চোখের সামনে খোলা বই। পড়ছেন। আর অন্য হাতে গাভিটির দড়ি—নীরবে ঘাস খাচ্ছে। প্রতিদিন লোকজন দেখছেন—ধুতি পাঞ্জাবি পরা ধীরেণ মাস্টার ক্রমশ দেবপ্রতিম। দূর থেকে তাকে সালাম জানিয়ে যাচ্ছেন নীরবে। কে একজন বুড়ি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছেন--ঈশ্বর মানুষের বেশে হেঁটে বেড়ান। এখানকার হাওয়া মধুময়। এই হাওয়ায় আমি ঘুমিয়ে পড়ি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগে আমরা দুজনে মিলে বাড়ি ফিরি।
মাঝে মাঝে তিনি বলছেন আর একটি খাতায় লিখছি বাংলা বাগধারার ইতিবৃত্তটি। সহজ সরল গদ্য। বলেন, যা বলতে চাও তা সহজ করে বল হে। পড়ে প্রাণ টানে। খাতাটি ভরে গেলে তিনি উপরে বড় বড় করে লিখলেন—মণিকোষ। বের হলো বাংলা একাডেমি থেকে।
যেদিন স্কুল থেকে অবসরে গেলেন—তারপর থেকে তিনি বলছেন আর আমি লিখছি চিঠি। মাজেদ—তোমাদের কাছে কখনো গুরু দক্ষিণা চাইনি। কিন্তু কিছু বই চাই। প্রাপক মাজেদ অথবা আলী নূর। কোন এক মোসাব্বির পাঠিয়ে দিচ্ছেন ডাকে কিছু টাকা। আমরা দুজনে মিলে বুক লিস্টি বানাতে লেগে যাই। আর চিঠি লিখি মুক্তধারায়, বাংলা একাডেমিতে—জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনীতে। কাউকে লিখি—ভিক্টর হুগোর অমনিবাস আমাদের দরকার। একদিন লিখতে দেওয়া হল একটি সাইনবোর্ড –সুভদ্রা স্মৃতি গ্রন্থাগার।
একদিন সাতপাড়ের আগে নৌকা চলে গেল আরও ভিতরের গ্রামে। টুঠামান্দ্রা-- অজ পাড়াগাঁ। একটি স্কুলঘরের পাশে একটি টিনের ঘর উঠেছে। ভেতরে কয়েকটি ঝকঝকে আলমারি। কাঁচের ভিতরে হাসছে আমাদের দুজনের বুক লিস্ট থেকে উঠে আসা বইগুলি। এই তাঁর জীবনের স্বপ্ন পূরণ।
সুভদ্রা তাঁর মা। এককালে তার মা ছিলেন এই গ্রামে। তাকে শাপলা রেঁধে খাইয়েছিলেন কতবার আর তালের পিঠে। তার জন্য এই বুড়ো ছেলেটি চাকরির সব টাকা আর দক্ষিণা খরচ করে মায়ের গ্রামে গড়েছেন গ্রন্থাগার। সেদিন তৃপ্তি ভরে আমাকে ধরে হেসে উঠেছিলেন। কিরে—ভাল লাগছে না!
ভাল না লেগে পারে! এই ভাল লাগা নিয়ে আজো বেড়ে উঠি।
আহা, এই বই-দাদুর নির্মল হাসিটি মাঝে মাঝে দেখা যায় ঈশ্বরের মুখে।
কোনো কোনো মানুষ আছেন নিজের ভেতর বুঝি একটা আস্ত পাঠাগার ধারণ করেন- স্বাচ্ছন্দ্যে; অপার্থিব আনন্দে। দেখুনদারির ধার ধরার বালাই না রেখেই বই অন্তপ্রাণ মানুষ ডবে থাকেন তার পরাণের গহীনে থাকা একান্ত পাঠাগারটিতে।
ময়েনউদ্দিন স্যার। আমার হাই স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক। ক্লাশে ঢুকেই বলতেন, এক চাইতে ১০ নম্বর অংকগুলো করো। অথবা চোখের সঙ্গে ক্যামেরার ছবিসহযোগে তুলনা করো।
তারপর তিনি বসতেন চেয়ারে। সামনে টেবিল। বসে বসে নিমিশে তিনি ডুব দিতেন অন্য কোনো জগতে। কখনো তিনি মিটি মিটি হাসছেন। কখনো গম্ভীর হচ্ছেন। কখনোবা গভীর বিষাদ তার মুখে ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা ১ চাইতে ১০ নম্বর অঙ্ক করতে করতে, চোখের সঙ্গে ক্যামেরার তুলনা আঁকতে আঁকতে সেই মুখের নানা ভঙ্গিমায় এসে থেমে যেতাম।
আমার পাশ থেকে আলী কদর খান কনক বলে উঠত, স্যার এখন রাজশেখর বসু পড়ছেন। পড়তে পড়তে হাসছেন। পথের পাঁচালী পড়ছেন বলে মুখটি গম্ভীর। স্যার এখন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে পড়তে পড়তে দেখছেন, সোনা অর্জুন গাছে লিখে রেখে যাচ্ছে--আমরা চলিয়া গেলাম।
জ্যাঠামশাইয়ের খোঁজ নেই। স্যারের মুখটা বিষাদে ভরে গেছে। কান্না লুকোতে স্যার ক্লাশ রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে গেছেন। সেখানে অলখে রুমাল দিয়ে চোখ মুছবেন।
স্যার সব সময়ই পড়ার মধ্যেই আছেন। হাঁটতে হাঁটতে পড়ছেন। বাজার করতে করতে পড়ছেন। প্রাত:কালে নদীতে স্নান করতে করতেও পড়ছেন। এ সময়কালে হাতে কোনো বই নেই। মনের মধ্যে বই আছে। সেগুলোকে মন থেকে বের করে পড়ে চলেছেন। পড়া ছাড়া জগতে আর কোনো অমৃত নেই। অমৃতই জীবন।
ভোর হলে আমরা বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ি। ঘুম ভরা চোখ নিয়ে পথের উপরে চলে আসি। দেখতে পাই --দেখতে চাই, স্যার নদী থেকে স্নান সেরে ফিরছেন। পরনে পাঞ্জাবি। সাদা লুঙ্গি। পায়ে সাদা স্যান্ডেল। একজন সফেদ মানুষ হেঁটে চলেছেন। সূর্য উঠছে। গাছে ভেতরে ছায়া ফুঁড়ে আলো ঝিকমিকিয়ে আসছে। তখন তাকে আর কোনো মানুষ মানুষ মানুষ লাগে না। দেবদূতের মতো লাগে। আমার পাগল ঠাকুরমা তাকে দেখিয়ে বলে উঠতেন, সরস্বতী ঠাকুরুনের পুত্রঠাকুর যাচ্ছেন।
তাঁর কাছেই আমার ঠাকুরদা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন আমি ক্লাশ টু। রোগা। মাঠে খেলতে দিতে ঠাকুরদার ভয়। তার ভয়, ফুটবলের সঙ্গে আমি উড়ে যেতে পারি।
তিনি আমাকে দেখলেন। তারপর আমার জন্য একটি আলমারি খুলে দিলেন। সেখানে সন্দেশ, শুকতারা-- বাঁধানো পত্রিকাগুলো আছে। তিনি পড়তে দিলেন অবন ঠাকুরের বুড়ো আংলা।
'রিদয় বলে ছেলেটা নামেই হৃদয়, দয়ামায়া একটুও ছিল না। পাখির বাসায় ইঁদুর, গরুর গোয়ালে বোলতা, ইঁদুরের গর্তে জল, বোলতার বাসায় ছুঁচোবাজি, কাকের ছানা ধরে তার নাকে তার দিয়ে নথ পরিয়ে দেওয়া, কুকুর-ছানা বেরাল-ছানার ল্যাজে কাঁকড়া ধরিয়ে দেওয়া, ঘুমন্ত গুরুমহাশয়ের টিকিতে বিচুটি লাগিয়ে আসা, বাবার চাদরে চোরকাঁটা বিঁধিয়ে রাখা, মায়ের ভাঁড়ার-ঘরে আমসির হাঁড়িতে আরশোলা ভরে দেওয়া— এমনি নানা উৎপাতে সে মানুষ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, সবাইকে এমন জ্বালাতন করেছিল যে কেউ তাকে দু’চক্ষে দেখতে পারত না।'
আমি প্রতিদিনই স্কুল থেকে সোজা লাইব্রেরিতে যাই। এর মধ্যে স্যারও চলে এসেছেন। নজরুল পাবলিক লাইব্রেরির দরোজাগুলো খুলছেন। আমিও গুটি গুটি পায়ে ঢুকে পড়ি। ব্যাগ রেখে আলমারি থেকে বই বের করি। পড়তে শুরু করি। তিনিও চেয়ারে হেলান দিয়ে পড়তে শুরু করেছেন। বাইরে ফুরফুরে হাওয়া বইছে। কয়েকটি সেগুনগাছের বড়ো বড়ো পাতা সড়সড় করছে। স্টেডিয়ামে খেলা হচ্ছে। আমরা দুজনে শুধু অন্য জগতে চলে গেছি।
এই লাইব্রেরিটি ময়েনউদ্দিন স্যার পেয়েছিলেন এক হিন্দু বাবুর কাছ থেকে। তখন অনেক হিন্দু ছিল শহরটিতে। লাইব্রেরিটির নাম ছিল দি করোনেশন লাইব্রেরি। সাত চল্লিশে হিন্দু লাইব্রেরয়ান বাবুটি চলে গেলেন ঐপারে। লাইব্রেরিটির চাবি দিয়ে গেলেন সেদিনকার এক তরুন পাঠক ময়েনউদ্দিনকে। অনুরোধ করেছিলেন, তুমি দেইখা রাইখো।
তিনি সত্তর বছর ধরে দেখে রেখেছেন লাইব্রেরিটি। দেশভাগের আগেকার অনেক স্থাপনাই তো ধীরে ধীরে মুছে ফেলা হয়েছে। কিন্তু ময়েন স্যারের হাতে লাইব্রেরিটি আরো উজ্জ্বল হয়েছে। একতলা বিল্ডিং হয়েছে। দেয়ালঘেরা। একটি ফুলবাগানও হয়েছে।বইপত্র বেড়েছে। স্যারও তরুণ থেকে বুড়ো হয়েছেন। তিনিই আমার ভেতরে বইয়ের তেষ্টা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, পড়ো, জীবনপড়ো।
আমি জীবনকে পড়ছি। বুঝতে চেষ্টা করছি বহুজীবনকে। পড়তে পড়তে লিখছি। আমার অনেক লেখার মধ্যেই স্যার চলে এসেছেন।
'মার্কেজের পুতুল' নামের গল্পের বইটি স্যারকে উৎসর্গ করেছি। বইটি নিয়ে গেল-জানুয়ারিতে ষোল বছর পরে স্যারের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। শুনতে পেলাম স্যার ঘুমুচ্ছেন। গ্রিল দিয়ে ঘেরা স্যারের বারান্দা। ভেতরে যেতে পারিনি। স্যারকে দেখার সুযোগ পাইনি। বইটি তাঁর হাতে দিতে পারিনি।বাড়ির লোককে দিয়ে বলেছিলাম, স্যার জেগে উঠলে বইটি তাঁর হাতে দেবেন।
কাল স্যার চলে গেলেন। যেতে যেতে হয়তো কোনো বই পড়ছেন। পড়তে পড়তে হাসছেন। গম্ভীর হচ্ছেন। ম্লান হচ্ছেন।
আর আমি দূর দেশে বসে কাঁদছি। তাঁর মতো তো আর কেউ নেই আমার শহরটিতে। কেউ রইলও না। কেউ আসবেও না।
তিনি আমাকে নির্মাণ করেছিলেন। পড়তে শিখিয়েছিলেন। লিখতে উস্কে দিয়েছিলেন।
প্রিয় ময়েনউদ্দিন স্যার, প্রিয় দেবদূত--আপনাকে প্রণাম।