সে সময়ে কিশোর সাহিত্যের সংখ্যা এতই কম ছিল যে আমার উপযোগী পাঠ্য বইয়ের সংখ্যা অচিরে ফুরিয়ে যায়। এদিকে ক্ষুধা সাঙ্ঘাতিক, বাধ্য হয়েই আমাকে ঢুকে পড়তে হয় বড়দের বইয়ের জগতে। মায়ের জন্য দু’খানা করে বই আনি, সেগুলি আমিই আগে শেষ করি। বুঝি না বুঝি, তাতে কিছু আসে যায় না। উই পোকা কি বইয়ের অর্থ বুঝে খায়? মনে আছে, ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়ই কী করে যেন হাতে আসে রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা। সেটা পড়ছি, এক মামা আমার কান ধরে বলেছিলেন, অ্যাঁ, খুব এঁচোড়ে পাকা হয়েছিস? তবু বইখানা শেষ করেছিলাম, এবং বুঝিনি, কতটা এঁচোড়ে পাকা হলাম। মা শরৎচন্দ্র, নরেশ সেনগুপ্ত, উপেন গঙ্গোপাধ্যায়, আশাপূর্ণা দেবী প্রমুখের রচনা বেশি পছন্দ করতেন, আমি সে সবই পড়তা, ক্রমশ আমার নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ গড়ে ওঠে। কল্লোল যুগের লেখকরা আমাকে বেশি টানে। ক্যাটালগে এক একজন লেখকের নাম ধরে ধরে তাঁদের সব বই পড়ে ফেলতাম। যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ…….। পরবর্তীকালে বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর আমি তাঁর বহুকাল ছাপা না থাকা কোনও কোনও বইয়ের উল্লেখ করায় তিনি হকচকিয়ে গিয়েছিলেন, যখন তিনি ও তাঁর বন্ধুরা অর্থসঙ্কটে ছিলেন তখন দেবসাহিত্য কুটির বা অন্য দু’একটি প্রকাশকের জন্য অনেক ছোট ছোট উপন্যাস লিখেছিলেন, সেগুলি হারিয়েই গেছে বলে ধরে নেওয়া হত, শুধু কয়েকটি লাইব্রেরিতে সেসব বইয়ের অস্তিত্ব টিকে ছিল। আমি বুদ্ধদেব বসুকে সবিনয়ে বলেছিলাম, ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত আপনার এমন কোনও লেখা নেই, যা আমি পড়িনি।
আপনিও পড়ুয়া'য় লিখুন। আমাদের কাছে লেখা পাঠাবার ঠিকানা editor@porua.net
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কবি ও অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক সময় আমার বাংলা বই পড়া নিয়ে প্রতিযোগিতা হত। মানবেন্দ্র ছাড়া, অন্য কোনও লেখক বা চেনাশুনো কেউ আমার চেয়ে বেশি বাংলা বই পড়েনি৷ পাঁচকড়ি দে থেকে শশধর দত্ত, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় থেকে প্রবোধকুমার সান্যাল, এমনকী নীহাররঞ্জন গুপ্ত কিংবা রোমাঞ্চ সিরিজে প্রতুল লাহিড়ীর গোয়েন্দা কাহিনী কিছুই বাদ দিইনি। মানবেন্দ্রর সঙ্গে আমার তফাত এই, এত বেশি বাইরের বই পড়েও সে অ্যাকাডেমিক পড়াশোনাতেও কৃতবিদ্য, সেদিকে আমার কিছুই হয়নি!
তৎকালীন লেখকদের সম্পর্কে কিছু কিছু কৌতুক কাহিনী প্রচলিত ছিল। অধুনা বিস্মৃত সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় একসময় বেশ জনপ্রিয় এবং বহু গ্রন্থের লেখক ছিলেন। তাঁর ভাষার বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি অনেক বাক্যই ডট ডট দিয়ে শেষ করতেন, যেমন, সে জানালার দিকে চাহিয়া রহিল….., কিংবা সে এখন কী করিবে….. এই লেখকের কন্যা সুচিত্রা মুখোপাধ্যায়ই এখনকার স্বনামধন্যা গায়িকা সুচিত্রা মিত্র। তখন অনেকে বলত, এই সুচিত্রা হচ্ছে সৌরীন্দ্রমোহনের ডটার! রবীন্দ্রনাথ ছবিও আঁকতেন বলে তখন অনেক লেখকও ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন। যেমন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল। তারাশঙ্কর নাকি ছবি আঁকতে আঁকতে তাঁর ছেলে সনৎকে ভুল করে রথী বলে ডেকে উঠতেন। মোহন সিরিজের লেখক শশধর দত্ত সম্পর্কে ধারণা ছিল, তিনি বহু দেশ ঘোরা, সাহসী, বলশালী পুরুষ। একসময় জানা গেল, তিনি উত্তর কলকাতারই একটি মেস বাড়িতে থাকেন। কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম তাঁর সঙ্গে। নিতান্তই এক রোগা সোজা নিরীহ বাঙালি, কথা বলতে বলতে থুতু ফেলেন মেঝেতে, খুব আফসোসের সঙ্গে জানালেন, ওই রকম এক-একটা রোমহর্ষক বইয়ের জন্য তিনি মাত্র পঞ্চাশ টাকা করে পান। এঁর ডাকনাম ছিল, কী হইতে কী হইয়া গেল বাবু। কারণ, এঁর বইতে, দুর্ধর্ষ নায়ক মোহনকে কোনও দুবৃত্ত একেবারে কোণঠাসা করে ফেলেছে, তার রিভলভার মোহনের গলায় ঠেকানো, মোহনের বাঁচার কোনও উপায়ই নেই, তবু নায়ককে উদ্ধার করার জন্য তিনি এরকম অবস্থায় প্রায়ই লিখতেন, তাহার পর কী হইতে কী হইয়া গেল, দুবৃত্তের রিভলভার মোহনের হাতে!
আমার প্রধান দোষ আমি বই পড়তে পড়তে বড় কাঁদি। মৃত্যু দৃশ্য বা করুণ দৃশ্যে নয়, ভুল বোঝাবুঝির দৃশ্যে আমার চোখে বেশি জল আসে। একজন আর একজনকে ভুল বুঝছে, অথচ ভালোবাসার অভাব নেই, এরকম আমি সহ্য করতে পারি না। মনে আছে, সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ প্রথমবার পড়ার সময় মা, বাবা ও দুই ভাইয়ের ভুল বোঝাবুঝির কাহিনীতে আমি এত জোরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠেছিলাম যে মা ভয় পেয়ে পাশের ঘর থেকে ছুটে এসে ব্যাকুলভাবে জানতে চেয়েছিলেন, কী হয়েছে? তখন শুধু লজ্জা পেয়ে চোখের জল মুছতে হয়। এ জীবনে আমি বই পড়ে যতবার কান্নাকাটি করেছি, প্রিয়জন বিচ্ছেদের কান্না সে তুলনায় অনেক কম।
ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগে বড়দের বই পড়লে চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়। কতবার বকুনি খেয়েছি এজন্য। স্কুলের বই ছাড়া অন্য কোনও বই হাতে দেখলেই বাবা চোখ রাঙিয়ে বলতেন, নভেল-নাটক পড়া হচ্ছে? আবার যদি ফের দেখি-। নভেল একনম্বর ভিলেইন, নাটক তো পাঠযোগ্যই নয়। মহাপুরুষদের জীবনী তবু চলতে পারে। আমি কোনও নিষেধাজ্ঞা মানিনি, যা পেয়েছি, সব পড়েছি, পরীক্ষার আগের দিনও ইংরিজি টেক্সট বুকের তলায় লুকিয়ে পড়েছি গোয়েন্দা গল্প। অন্যরা বলাবলি করত, প্রবোধকুমার সান্যালের ‘আঁকাবাঁকা’, নাকি অশ্লীল বই, যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চতুষ্কোণ’। ওসব বই পড়ে শেষ করে ফেলেছি গোঁফ গজাবার আগে। কই, তাতে তো বখেও যাইনি, চরিত্রও নষ্ট হয়নি।
কিংবা হয়েছে হয়তো। বোধহয় আমার চরিত্র বলে কিছুই নেই।