বই পড়ার সাত সতেরো
স্বপন বিশ্বাস | বাবা আমার জন্য স্কুল লাইব্রেরি থেকে ছোটদের বই আনা শুরু করলেন। তার কিছু রূপকথা আর কিছু বিদেশি বইয়ের অনুবাদ। কয়েকটা বইয়ের কথা এখনও মনে আছে ফারনান্দেজের গল্প, রবিনহুড, রবিনসন ক্রুসো, ট্রে
বাবার বইয়ের আলমারিতে তালা দেয়া থাকতো। তা নিয়ে আমার কোনে মাথা ব্যথা ছিল না। ছোটবেলায় হয়তো কোনোকিছু নিয়েই মাথা ব্যথা থাকে না। তবে আমার ছিল। সেটা সত্যিকারের মাথা ব্যথা। আমি প্রায়ই জ্বরে ভুগতাম। জ্বরে মাথা ব্যথা হতো। বছরে একাধিক বার জ্বরে ভুগতাম। বিশেষ করে দূর্গা পূজোর আগে আমার জ্বর হবেই হবে। একবার জ্বর মানে দশ-পনেরো দিন শুয়ে থাকা। ডাক্তার বলত টাইফয়েড। তো এমনি একবার জ্বরের শেষের দিকে। বাবা হয়তো আমার জ্বর নিয়ে একটু চিন্তিত ছিলেন, ভুল করে আলমারি খোলা রেখেই স্কুলে চলে গেলেন। তখন মাঝে মাঝে জ্বর আসে আবার ছেড়ে যায়। সেদিন আর জ্বর আসেনি। শরীর কিছুটা ভালো। মা তখন রান্না ঘরে ব্যস্ত। আমি আলমারি অভিযানে নামলাম। তখন হয়তো ফোর ফাইভে পড়ি। আমি জানতাম ওসব আমার পড়ার বই না। তাই পড়ার কোন আগ্রহও ছিল না। আগ্রহটা মূলত তালাবন্ধ নিষিদ্ধ এলাকাটা দেখার। তবু অভিযান শেষে বেশ পাতলা দেখে একটা বই নিয়ে পড়া শুরু করলাম। শরৎচন্দ্রের মেজদিদি। মা দেখে বলল, “পড়া হলে আবার জায়গা মতো রেখে দিও। না হলে বাবা রাগ করবেন।” পরে যদিও বাবা রাগ করেননি। হয়তো জ্বর ছিল তাই। বললেন, “ওসব বড় হলে পড়ো। এখন পড়ে বুঝবে না।” তবে একধরনের প্রশ্রয় পাওয়া গেল। সেই শুরু।
বাবা আমার জন্য স্কুল লাইব্রেরি থেকে ছোটদের বই আনা শুরু করলেন। তার কিছু রূপকথা আর কিছু বিদেশি বইয়ের অনুবাদ। কয়েকটা বইয়ের কথা এখনও মনে আছে ফারনান্দেজের গল্প, রবিনহুড, রবিনসন ক্রুসো, ট্রেজার আইল্যান্ড। আরও এক ধরনের বই পড়তাম, উপদেশ মূলক গল্প। ঈশপের গল্পের মতো গল্প। শেষে একটি করে উপদেশ। এই ধরনের গল্প পড়তে পড়তে মনে হতো উপদেশ দেয়ার জন্য একটা গল্প বানানো হয়েছে। গল্পকে সত্যি বলে মনে হতো না। যে কারণে আমি বাবার আলমরি থেকে বড়দের বই পড়তেই বেশি পছন্দ করতাম। সে আলমারিতে ছোটদের কোন বই ছিল না।
শুনেছি বাবার সংগ্রহে এক সময় অনেক বই ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বাড়ী লুট হয়ে যায়। বাবার বইয়ের সংগ্রহও লুট হয়ে যায়। তবে স্বাধীনতার পরে দেশে ফিরে ঘটি বাটি চেয়ার টেবিলের সাথে কিছু বইও ফেরত পাওয়া গিয়েছিল। সেই ফেরত পাওয়া বইয়ের ভেতরে শরৎ, ফাল্গুনী, নিমাই, নীহার, বিমল মিত্র যেমন ছিল তেমন ছিল মানিক, বিভূতি, তারাশঙ্কর। বঙ্কিম, দীনবন্ধু, মাইকেল, রবিঠাকুর সবার সাথেই পরিচয় ঘটেছে বাবার বইয়ের আলমারি থেকে। কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার নকশা, যাযাবরের দৃষ্টিপাত, অবধূতের মরুতীর্থ হিংলাজ, মোহাম্মদ নজিবর রহমানের আনোয়ারা, আবু সয়ীদ আইয়ুবের পান্থজনের সখা, প্রমথনাথ বিশীর কেরী সাহেবের মুন্সীর মতো বিখ্যাত বইও পড়েছি আমার স্কুল জীবনে বাবার আলমারি থেকে।
স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে সাফায়েত বই পড়ত। সাফায়েতের কাছে সন্ধান পেয়েছিলাম সেবা প্রকাশনীর বইয়ের। ওর কাছ থেকে নিয়ে পড়েছিলাম ভিন গ্রহের মানুষ আর বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল’র মতো দুটো বই। রহস্য ঘেরা দুটি জগত। যা এখনও আমাকে ভাবায়। সাফায়েত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান নিয়ে পড়াশোনা করেছে। এখন ঢাকাতে একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করে। হয়তো সেবা প্রকাশনীর বই আর পড়ে না, এখন তাবলিগ জামাত করে। স্কুল জীবনের শেষের দিকে আরেক জন বন্ধু পেয়েছিলাম, নুরুলহুদা চঞ্চল। চঞ্চলের বাবা পুলিশে চাকরি করতেন। তাই বদলি সূত্রে চঞ্চল আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়েছিল ক্লাস নাইনে। দুবছর আমাদের সাথে পড়েছে। চঞ্চল পড়ত রূপকথা। স্কুল লাইব্রেরির সমস্ত রূপকথার বই পড়ে শেষ করেছে। মনে আছে ওর জন্য স্কুল লাইব্রেরিতে নতুন করে রূপকথার বই কেনা হয়েছিল। স্কুল পাসের পর চঞ্চলের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। শুনেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ বিজ্ঞান থেকে পাস করে কোনো এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে।
কলেজে ভর্তি হয়ে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে কুষ্টিয়া শহরের মেসে এসে উঠলাম। নাম তরুণ মেস। সেখানে মোহিনী মিলের বয়স্ক কর্মজীবীদের বাস। মিলের দুর্দিন পড়ায় আমি ছাত্র হিসাবে ঢুকে পড়লাম কর্মজীবী মেসে। সেখানে সূর্যকান্ত লাহেরী নামে একজন চিরকুমার বয়স্ক ভদ্রলোক থাকতেন। মোহিনী মিলে চাকরি করতেন। সত্যিকারের পড়ুয়া মানুষ। তিনি মোহিনী মিলের লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়তেন। তাঁর কাছ থেকে কিছু বই নিয়ে আমি পড়তাম। পুরানো দিনের বই। নাম মনে নেই। সে সময় মোহিনী মিলের ইতিহাস বইটা পড়েছিলাম। কলেজ লাইব্রেরি থেকে লালনের উপর কিছু গবেষণাধর্মী বই পড়েছিলাম। কলেজ লাইব্রেরির আরেকটি বইয়ের কথা না বললেই না, সেটা রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখা জীবনস্মৃতি। এছাড়া কিছু বই পড়েছি রচনা প্রতিযোগিতায় রচনা লেখার জন্য। রচনা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ছিল আমার কাছে নেশার মতো। নেশাটা এই মাত্রার ছিল যে কলেজে পড়ার সময় ১৯৮১ ও ১৯৮২ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জাতীয় পর্যায়ের রচনা প্রতিযোগিতাতেও অংশ নিয়েছি এবং প্রথম হয়েছি। বিষয় ছিল, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ, আর ব্যর্থতাই বিজয়ের স্তম্ভ - উহুদ যুদ্ধের প্রধান শিক্ষা। বিশেষ দিবস উপলক্ষে দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এধরনের প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়। এ সব প্রতিযোগিতায় হয়তো তেমন কেউ অংশগ্রহণ করে না। সেই সুযোগে আমি পুরস্কার হিসাবে কিছু ভিন্ন ধরনের বই পড়ার সুযোগ পেয়েছি। যেমন গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী, মীর মোশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু, এম আর আখতার মুকুলের আমি বিজয় দেখেছি সহ মুক্তিযুদ্ধের বই। আর কবিতার বই। বাবার আলমারিতে তেমন কবিতার বই ছিল না। কলেজ জীবন পর্যন্ত লাইব্রেরি থেকে তুলে কিংবা কিনে কবিতার বই পড়া হয়নি। যা পড়েছি রচনা প্রতিযোগিতার পুরস্কার। এধরনের প্রতিযোগিতায় সাধারণত জসীম উদ্দীন, জীবনানন্দ, কিংবা রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্তের বই পুরস্কার হিসাবে দেয়া হয়।
কলেজের সংক্ষিপ্ত সময়টাতে পড়ার চেয়ে লেখালেখিতেই বেশি ব্যস্ত ছিলাম। লেখালেখির পোকাটা স্কুল থেকেই মাথায় ঢুকেছিল। তরুণ মেসের বাসিন্দা সে সময়ের তরুণ কবি দেবাশীষ সান্যালের সাহচর্যে এসে সেই পোকাটা যেন পাখা মেলে দিল। কলেজের পড়াশোনা চাঙে উঠলো। দেবাশীষ এখন কলকাতার কবি।
সমসাময়িক সাহিত্যের পড়াশোনাটি শুরু হয়েছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর। তখন সহপাঠি হিসাবে পেয়েছিলাম পড়ুয়া খোকন রায়কে। ওর ছিল অসাধারণ স্মরণশক্তি আর বর্ণনা করার এক আকর্ষণীয় ক্ষমতা। যিনি এখন কুলদা রায় নামে পরিচিতি লাভ করেছেন। সেই সময়ে খোকনের সাহচর্যে শক্তি সুনীল আর আবুল হাসান পড়েছি। পড়েছি বুদ্ধদেব গুহ, দেবেশ রায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আর সমরেশ মজুমদার ও সমরেশ বসুর মতো সমসাময়িক আরও অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখকের লেখা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন আর তার পরবর্তি সময়ের বইপড়া নিয়ে পরে একদিন লিখব।
কথা সাহিত্যিক আনিসুল হক যুগান্তরের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট এবং ওয়ার এন্ড পিস বই দুটি পড়া থাকলে তার সাথে কথা বলা সহজ হয়।” সেই অর্থে আমি হয়তো কথা বলার জন্য অতটা সহজ হয়ে উঠতে পরিনি। কারণ ইংরেজি বই পড়তে আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। অনুবাদ সাহিত্যকে আমার কাছে লবন ছাড়া তরকারির মতো বিস্বাদ মনে হয়। সেই বিবেচনায় পাঠক হিসাবে আমি ফেসবুক পড়া পাঠক। চুটিয়ে ফেসবুক পড়ি। সম্প্রতি ফেসবুকে আলভী আহমেদের মুরাকামির অনুবাদের সন্ধান পেলাম। অমর মিত্রের ধ্রুবপুত্র শেষ করে মুরাকামির নরওয়েজিয়ান উড ধরবো। লবনহীন বিস্বাদ তরকারি কতটা হজম করতে পারি তার একটা পরীক্ষা হয়ে যাবে।