বই পড়ার স্মৃতি
কামাল উদ্দিন | পত্রিকা, ম্যাগাজিন কেনার জন্য ফেরিওয়ালারা দরজায় এসে হাঁক দিতো শিশি, বো-ত-ল, কাগোজ বিক্রী, পুরান কাগোজ আছে, পুরান কা-গো-জ? পুরাতন পত্রিকা বিক্রী করে ওদের কাছ থেকে সের দরে পুরাতন বই কিনেছ
পঞ্চম শ্রেণীতে ফাইনাল পরীক্ষার পর (১৯৬৮সালে) অবসর মুহূর্তে বই পড়ার জন্য প্রতিবেশী ও বন্ধু বাকিবিল্লাহ'র কাছ থেকে তাঁর ষষ্ঠ শ্রেণীর বাংলা বই নিয়ে আসি। একাডেমিক ইয়ারে সে আমার এক বৎসরের সিনিয়র ছিল। প্রতিবারই বৎসর শেষে তাঁর কাছ থেকে বই চেয়ে আনতাম। নতুন বৎসরে স্কুল থেকে বুক-লিষ্ট পাবার পর আব্বা নতুন বই কিনে আনলে তাঁর বই ফেরৎ দিয়ে আসতাম। মনে হয় এভাবেই বাংলা বই পড়ার প্রতি দুর্বলতা গড়ে ওঠে। "মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই, ফুলের বাসে ঘুম আসে একলা জেগে রই"। আমিও তখন থেকেই বইয়ের টানে আজো "একলা জেগে রই"।
স্কুল শেষে বাসায় এসে দেখতাম বিকালে মা বই পড়ছেন। কখনো, কখনো সুর তুলে পুঁথি পড়তেন। আপাও বই পড়ছেন। আব্বার ধর্মীয় বইয়ের বিশাল সংগ্রহ ছিল। তিনি তাঁর সংগৃহীত বই পড়ার জন্য আমাকে উৎসাহিত করেন। বড় ভাই'র সংগ্রহে দেখেছি গ্রামের সমিতির পাঠাগারের বই। একাত্তরের যুদ্ধে গ্রামে বড়দের হাতে দেখেছি, "কতো ছবি কতো গান"। স্বাধীনতার পর তাঁদের হাতে দেখেছি, মাসুদ রানা, খেলারাম খেলে যা। কলেজে প্রবেশ করেই বহুল আলোচিত, নন্দিত এবং নিন্দিত খেলারাম খেলে যা পড়ি, দ্বিতীয় বারের মতো গত বৎসর অধিক সমালোচিত এই বইটি আবার আমার মনযোগ কেড়ে নেয়। একই সাথে লেখকের "মার্জিনে মন্তব্য" ও দ্বিতীয় বারের মত "গল্পগুচ্ছ" পড়ার সুযোগ হয়।
আমার শৈশবে মেঝ ভাই ছিলেন স্কুল শিক্ষক। তিনি তাঁর স্কুল লাইব্রেরী থেকে গল্পের বই এনে দিতেন। প্রতিবারই একসাথে আট-দশটি বই আনতেন। পড়া শেষে সবগুলো বই তাঁকে ফেরৎ দিলে ঐ দিন বিকালেই তিনি বাসায় ফেরার সময় আবার বই নিয়ে আসতেন। তখনই পরিচিত হই আরব্য রজনীর সাথে। ১৯৬৯ সালে যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন স্কুলেও লাইব্রেরী ছিল। ক্লাস শেষে স্যার বলতেন, বাসায় ফেরার পূর্বে বই নিয়ে যাবি। নির্দিষ্ট সময়ে ফেরৎ দিতে ভুলে গেলে প্রতিদিনের জন্য এক আনা (ছয় পয়সা) জরিমানা দিতে হতো।
পত্রিকা, ম্যাগাজিন কেনার জন্য ফেরিওয়ালারা দরজায় এসে হাঁক দিতো শিশি, বো-ত-ল, কাগোজ বিক্রী, পুরান কাগোজ আছে, পুরান কা-গো-জ? পুরাতন পত্রিকা বিক্রী করে ওদের কাছ থেকে সের দরে পুরাতন বই কিনেছি নীহাররঞ্জন, ফালগুনী, নিমাই ভট্টাচার্যের।
কৈশোরে সুধীজন পাঠাগারের বইয়ের ভুবনে আমি বিস্ময়াবিষ্ট হৃদয়ে প্রথম পা রাখি। তখন পাঠাগার দু'টি কক্ষে বিভক্ত ছিল। উত্তর দিকের কক্ষে বই ও দক্ষিণ দিকে পাঠ কক্ষ ছিল। আমি, রতন ও জাহাঙ্গীর স্কুল শেষে পড়ন্ত রোদে বাসা থেকে হেঁটে পাঠাগারে এসে পাঠ কক্ষে বসে দস্যু বনহুরের একটি বই শেষ করে নতুন আরেকটি বই বাসায় নিয়ে পড়ার টেবিলে লুকিয়ে রাখতাম। লুঙ্গি বা পেন্ট পরে পাঠাগারে এলে সার্টের নীচে পেটের কাছে লুকিয়ে রাখতাম। এভাবে প্রতিদিন পাঠাগারে আমার আসা-যাওয়া বাড়তে লাগলো। তখন পাঠাগারে আমাদের (ছাত্র সদস্য) মাসিক চাঁদা ছিল চার আনা (পঁচিশ পয়সা), এখনকার মত কার্ড সিষ্টেম ছিল না। বিশাল একটি রেজিষ্টার খাতা ছিল। প্রত্যেক সদস্য'র জন্য একটি নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা বরাদ্দ থাকতো। বই ইস্যু করতে চাইলে স্মৃতি থেকে পৃষ্ঠা নাম্বার উল্লেখ করতে হতো। নির্দিষ্ট পৃষ্ঠায় স্বাক্ষর করে বই বাড়িতে নিয়ে যেতাম। প্রয়াত ডঃ করুণাময় গোস্বামী স্যার একদিন আমাকে ডেকে বললেন "তুই দশজনকে পাঠাগারে সদস্য করতে পারলে তোকে বই পুরস্কার দেবো"। বইয়ের লোভে সদস্য সংগ্রহে লেগে গেলাম। তাদের মধ্যে অনেকেই এখন আর সদস্য নেই। কিন্তু স্যারের পুরষ্কারও আর পাইনি। দিনমান বই নিয়ে মেতে থাকি। পৃথিবীময় বইয়ের রাজ্যে ঘুরে বেড়াই। সে এক স্বপ্নের রাজ্য। বেদুইন সামাদের "বেলাশেষে" ও গোলাম মোস্তফার "মোস্তফা চরিত" পড়ে কেঁদেছি তখন। প্রয়াত বন্ধু রতনের উৎসাহে পৌর পাঠাগারের সদস্য হই। রতন ও জাহাঙ্গীরকে নিয়ে দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে পৌর পাঠাগার থেকে বই এনেছি।
ব্যাংকে সেভিংস একাউন্ট খুলে টাকা জমাতাম। ছাত্র জীবনের কৃচ্ছতায় জমানো টাকা তুলে বাংলা বাজার থেকে অনেক বই কিনলাম। কারণ "বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না"। সুধীজন পাঠাগার ও পৌর পাঠাগারের বই মেলা থেকে বই কিনেছি। পাঠাগার থেকে পড়েছি ডেল কার্ণেগী, ম্যাক্সিম গোর্কি, কাহলিল জিবরান, জালাল উদ্দিন রুমী, চার খলিফার জীবনী, ফ্রয়েড, ইমাম গাজ্জালী, অন্নদাশঙ্কর রায়, আবু জাফর শামসুদ্দিন, আবু ইসহাক, আলাউদ্দিন আল আজাদ, ধীরাজ ভট্টাচার্য, সৈয়দ মুজতবা আলী, রবীন্দ্র- নজরুল সাহিত্য, জীবনানন্দ, শামসুর রাহমান, কাজী মোতাহার হোসেন, কিরীটি অমনিবাস, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, মানিক, বিভুতিভূষণ, সেলিনা হোসেন, মাহমুদুল হক, আল মাহমুদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, ডঃ মুহম্মদ শহীদু্ল্লাহ্-র বই।
সুধীজন পাঠাগারে পরিচালক সদস্য হয়ে নতুন চোখে, নতুন করে আমি পাঠাগারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করি। "এখন যৌবন যার বইয়ের মিছিলে যাবার শ্রেষ্ঠ সময় তার"। ইশ্ কি আনন্দ, বইয়ের জন্য কল নাম্বার বলতে হয় না, ক্যাটালগ ঘাটতে হয় না। অনেক কাছ থেকে বই স্পর্শ করি। নতুন বইয়ের গন্ধ নেই।
ফেব্রুয়ারীর বই মেলা, বাংলা বাজার, 'সুবর্ণ', 'ম্যারিয়েট' ও 'পাঠক সমাবেশ' থেকে সুধীজন পাঠাগারের জন্য ও নিজের সংগ্রহের জন্যও বই এনেছি প্রচুর। এ যেনো "রথ দেখা ও কলা বেঁচা"। পাঠাগারে যাওয়া আসা ছিল আমার জীবনের এক "স্বর্ণালী সময়"। আমার পঠিত শতাধিক "শ্রেষ্ঠ বই"- এর একটি তালিকা তৈরী করে আমি অনেক পাঠককেই দিয়েছি। কাউন্টারে বসা ও গ্রন্থাগারিক হবার কারণে পাঠাগারের সদস্যদের সাথে আমার সরাসরি যোগাযোগ ছিল। আমার তৈরী তালিকার বই পড়ে অনেকেই খুশী হয়ে কোলাকুলি করেছে আমার সাথে। এ এক বিস্ময়কর পাওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়া সংলগ্ন বই-এর দোকান থেকেও কিনেছি ডঃ রফিকুল ইসলাম স্যার, ডঃ সাঈদ-উর-রহমান স্যার, ডঃ আহমদ শরীফ স্যার, ডঃ আবু হেনা মোস্তফা কামাল স্যারের বই। স্যারদের বই কেনার পর তাঁদের রুমে গিয়ে অটোগ্রাফ নিয়েছি। বই কেনার টাকা পকেটে থাকতো না অনেক সময়, বন্ধু কাঞ্চনের কাছ থেকে প্রায়ই ঋণ নিয়েছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীতে রেফারেন্স বই পড়ার সময় বাংলা সাহিত্যের দিকপালদের লেখা পড়তে গিয়ে পরিচয় ঘটে পত্র সাহিত্যের। 'ছিন্নপত্র' ও 'রাশিয়ার চিঠি' পড়ি। এরপর লেখকদের প্রতিটি রচনাবলী থেকেই তাঁদের চিঠি পড়া শুরু করি। খাতায় লেখকদের নাম লিখে রাখতাম, কার চিঠি পড়েছি আর কারটা পড়ি নাই। ভুলে আবার কেউ বাদ রয়ে গেলো না-তো। অবসর পেলে বা আড্ডার ফাঁকে ছুঁটে যেতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীতে। দীর্ঘ দিন পড়েছি এসব পত্র সাহিত্য। জীবনানন্দ দাশ বলেছেন "আমি এক ঘোরের মধ্যে থাকি"। মনে হয় তেমনি এক ঘোরের নেশায় পড়েছি বাংলা সাহিত্যের সব পত্র সাহিত্য। ইন্দিরা গান্ধীকে লেখা জওহরলাল নেহেরু'র চিঠির বইটি সুধীজন পাঠাগার থেকে এর পূর্বেই পড়েছিলাম। কিন্তু তখন ভাবিনি যে,পত্র সাহিত্য আমার চেতনার আরেকটি দ্বার খুলে দেবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ শেষে আপা বাংলা একাডেমি থেকে ফর্ম এনে দিলেন একাডেমির "জীবন সদস্য" হবার জন্য। বাংলা একাডেমির জীবন সদস্যদের জন্য একাডেমির প্রকাশিত বই ফিফটি পারসেন্ট ডিসকাউন্টে কেনা যায়। বাংলা একাডেমির জীবন সদস্য হবার পর বাৎসরিক সভায় অংশ গ্রহণে দেখি আরেক বিস্ময়। বিভুতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় বলেছিলেন, "যে বিস্মিত হতে জানে না সে মৃত"।
পড়ুয়াতে আমার লেখা নির্বাচিত হওয়াতে আমি আনন্দিত। কর্তৃপক্ষকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই।