প্রিয় পাঠক,
“অচ্ছ্যুত থাকার চেয়ে নিমজ্জিত থাকা ঢের ভালো” - টিলি ওলসেন
ছোটো বেলা থেকেই আমি ভীষণ বই পাগল। বইয়ের জগতে ডুবে থাকা আমার কাছে ছিল সবচেয়ে আনন্দময় ব্যাপার। প্রায় প্রতি বছরই আমাদের বাড়ি বদলে নতুন জায়গায় যেতে হতো। সেসব নতুন জায়গা সম্পর্কে আমার প্রায় কিছুই জানা থাকতো না। সেটা অবশ্য বড় কোনো সমস্যা ছিল না। নতুন জায়গা সম্পর্কে জেনে নেবার কৌতূহলে আমি প্রথমে সেখানকার লাইব্রেরিতে ঢুঁ মারতাম। অচেনা জায়গা, বন্ধুহীন হলেও লাইব্রেরির থরে থরে সাজানো বইয়ের ভেতর বন্ধুবান্ধব এবং অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজ যে আমার অপেক্ষায় থাকতো সেটা আমি জানতাম। বড় হবার পর আমি একবার ব্রাজিলে গিয়েছিলাম। পঠিত বইয়ের নানা ঘটনার মধ্যে নিজেকে কল্পনা করতে বেশ লাগতো আমার। একটা মজার খেলা যেন। তারই ধারাবাহিকতায় জর্জ আমাদোর উপন্যাসের পথ ধরে ইতাবুনার বাসে চড়ে বসি এবং মাথায় মুরগী নিয়ে বাসে চড়া মহিলাদের পাশে বসে ভ্রমণ করি। সে এক অভিজ্ঞতা বটে!
তার কয়েক বছর পর আমি আফ্রিকা চলে যাই। সাথে নিয়েছিলাম একটা গিটার, কিছু কাপড়চোপড় আর এক বাক্স ভর্তি বই। বইভর্তি বাক্স তো নয়, মনে হয়েছিল গোটা একটা বিশ্বকেই বুঝি সঙ্গে নিয়ে এলাম। যে বইগুলো সঙ্গে এনে ছিলাম, তার বেশির ভাগই ছিল, আফ্রিকার সুসন্তানদের লিখিত বই। যেমন : চিনুয়া আচেবে, ওয়া থিওনগো, সইঙ্কা, গর্ডিমার(তালিকাটি বেশ দীর্ঘ), বইগুলো আমাকে চোখ মেলে দেখতে, উপমহাদেশটির বিভিন্ন স্হান এবং মানুষ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পেতে সাহায্য করার পাশাপাশি খুঁটিনাটি অনেক কিছু শিখিয়েছিল। বইগুলো পড়ে কোথায় কীভাবে প্রশ্ন করতে হয়, বা প্রশ্নের ব্যাখ্যা খুঁজে পেতে পথপ্রদর্শকের মতো আমায় বিভিন্ন সময়ে পথ দেখিয়ে ছিল। আরো শিখিয়েছিল কীভাবে উদার থাকার চেষ্টা করতে হয়। বোঝার চেষ্টা করতে হয়, আমরা যে জগতে বাস করি সেখানে প্রতিটি জীবন, প্রতিটি পরিবার, প্রতিটি নগর, রাষ্ট্র, জাতি হলো নানাভাবে সুন্দর, অসুন্দর, চালাক, বোকা, শান্ত, অশান্ত, রঙিন, সাদাকালো মানুষদের সমন্বয়েই তৈরী।
আধুনিক জীবন বহুমুখী হয়ে চারদিক থেকে আপনাকে টেনে ধরতে চাইবে। আপনি বইবন্ধুর ছায়ায় থাকা মানুষ হলে সেসব ঠেলে সরানো আপনার জন্য কোনো ব্যাপারই নয়। বই থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন আইডিয়ার প্রতি আপনার ভালোবাসা, অজানাকে জানা; সত্যের সন্ধান দেওয়া নিরন্তর বইবন্ধুটির জন্য নানামুখী অসাড় জাগতিক প্রলোভন তুচ্ছ করা আপনার জন্য বরং মঙ্গলময়। আপনি বরং সেই দুনিয়ায় ডুবে থাকুন যা কোনো লেখক তাঁর মেধা-মনন নিংড়ে, পাঠক হিসেবে আপনার/আপনাদের জন্যই সৃষ্টি করেছেন।
আপনি যতবেশি পাঠে ডুবতে পারবেন, মনোযোগী হওয়ার মন্ত্রটা ততই আপনার তালুবন্দী হবে। ততই আপনার কল্পনা শক্তি আর আবিষ্কারের ইচ্ছা দ্বিগুণ হবে। সেরা বইগুলো যেন কবজের মতো, কিংবা টাচস্টোন বা প্রার্থনার মতো, যা আপনার হৃদয়কে শুদ্ধ করে।
তাই, হে বন্ধু পড়ুন। বইময় পৃথিবীটার গাঢ় আলিঙ্গনে নিজেকে সঁপে দিন। পাঠের পৃথিবীর মতো শান্তিময়-দ্যুতি ছড়ানো স্হান আর কোথায় আছে বলুন! নিজেকে ফিরে পেতে সেই পৃথিবীতেই আসুন বন্ধু।
আপনাদের
বই পাগলবন্ধু
জ্যাকলিন নোভোগ্রাটজ