সালমান রুশদী
নিজেকে শুধান, কোন বই আপনি সত্যি ভালোবাসেন?
নিউ ইয়র্ক টাইমস, ২৪ মে ২০২১
অনুবাদ আশফাক স্বপন
যখন বই ছিল না, তখন গল্প ছিল। প্রথম প্রথম সেই গল্প লেখা হতোনা। কখনো সে সব গল্প গাওয়া হতো। শিশুরা জন্ম নেবার পর কথা বলতে শেখার আগেই বাবা-মা ওদের গান শোনাত। হয়ত হাম্পটি ডাম্পটি-এর পাচিল থেকে ডিম পড়ে যাবার গল্প, বা জ্যাক আর জিল-এর পাহাড়ে উঠে পড়ে যাবার গল্প। বাচ্চারা বড় হয়ে ওঠার সময় যত ঘন ঘন ক্ষিদের কথা বলত, ততটাই গল্প শুনতে চাইত।
বাচ্চারা এইসব গল্পের প্রেমে পড়ে যেত, বারবার শুনতে চাইত। তারপর আরেকটু বড় হলে বইয়ে এইসব গল্পের সন্ধান পেতো। আরো কত সব গল্প। খরগোশের গর্তে একটি মেয়ের পড়ে যাওয়ার গল্প, একটি বোকা বুড়ো ভাল্লুকের গল্প, একটা ভীত শুকরশাবকের গল্প, একটা বেজার গাধার গল্প, একটা অলীক ফোনের বাক্সের গল্প, বা এমন সব জায়গার গল্প যেখানে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে। এইসব গল্পের প্রেমের পড়ার ফলে বাচ্চাদের মধ্যে এমন একটা জিনিস জাগ্রত হয় যেটা সারাটা জীবন তাদের চেতনাকে সমৃদ্ধ করে – সেটা হলো তাদের কল্পনার স্পৃহা।
বাচ্চারা নিজেরাই কত সব মিছেমিছি গল্প বানায় – দুর্গে হানা দিয়ে রাজ্য জয় করে সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে রাতে ড্রাগনের স্বপ্ন দেখে। তারপর ওরা বড় হয় আর গল্পগুলো ওদের চেতনা থেকে খসে খসে পড়ে। গল্পগুলো বাক্সপেটরায় বেঁধে চিলেকোঠায় তুলে রাখা হয়, আর এককালে যারা বাচ্চা ছিল, তাদের জন্য গল্প বলা বা গ্রহণ করা আরো কঠিন হতে থাকে। এমনকি, কী দুঃখের কথা, প্রেমে পড়াও কঠিন হয়ে যায়।
আমার বিশ্বাস আমরা যে সব বই আর গল্পের প্রেমে পড়ি, এইসব আমাদের চেতনাকে তৈরি করে। অত বাড়িয়ে বলতে চাই না, তবে আমার মনে হয় আমাদের প্রিয় গল্পটি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে আমাদের বাস্তবকে বোঝা, সেই সম্বন্ধে বিচার করা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়। আমরা বড় হয়ে উঠতে উঠতে একটা বই আর আমাদের অতটা আন্দোলিত করেনা, কিম্বা সে সম্বন্ধে আমাদের টানটা কমে আসে। বা এমনও হতে পারে যে আমাদের জীবন পরিণতি লাভ করার সাথে সাথে আশা করা যায় আমাদের উপলব্ধি আরো গভীরতা লাভ করে, তখন হঠাৎ যে বই খারিজ করে দিয়েছিলাম তার মর্ম বুঝতে পারি, হঠাৎ তার সুর আমাদের হৃদয়ের তারকে ঝঙ্কৃত করে, তার গানে আমরা মোহিত হই।
আমি যখন কলেজ ছাত্র, তখন প্রথম গুন্টার গ্রাসের (Gunter Grass) মহৎ উপন্যাস The Tin Drum পড়ি। উপন্যাসটা পুরো পড়তে পারিনি। আমার বইয়ের তাকে বইটি দশটি বছর পড়ে ছিল। তারপর আবার চেষ্টা করলাম। এবার বইটি আমার সর্বকালের অন্যতম প্রিয় উপন্যাস হয়ে গেল। আজ আমি একথা বলব যে ভালোবাসি এমন বইয়ের মধ্যে এটি অন্যতম। নিজেকে কিন্তু খুব চিত্তাকর্ষক একটি প্রশ্ন করতে পারেন। কোন কোন বই আপনার সত্যি পছন্দ? নিজেকে প্রশ্নটা করে দেখুন না। উত্তর যা পাবেন তাতে আপনার বর্তমান মন-মানসিকতার অনেক খবর পাবেন।
*
আমি ভারতের বম্বে শহরে বড় হয়েছি। শহরটা আজ একেবারেই আগের মতো নেই। নতুন নাম হয়েছে তার – সেটা আগের মতো শ্রুতিমধুর নয়। মুম্বাই। যেই সময়ে ঐ শহরে বড় হয়েছি সেটা বর্তমান থেকে এত অন্যরকম যে মনে হয়ে সে কোন সুদূর অতীতের, এমনকি অতিবাস্তব, কাল্পনিক। সেই দূর-বহুদূরে অবস্থিত বম্বে শহরে আমার কাছে পাশ্চাত্য থেকে যেই গল্প আর বই এসে পৌছুঁত সেসব যেন আশ্চর্য বিস্ময়জাগানো গল্প।
হ্যান্স ক্রিস্টিয়ান এ্যান্ডারসনের (Hans Christian Andersen) The Snow Queen ‘বরফের রাণী’ রূপকথায় গল্প আছে জাদুর আয়নার টুকরো কাঁচ মানুষের রক্তে ঢুকে ওদের হৃদয়কে বরফ করে দেয়। সেই গল্প গরমের দেশে থাকে এমন একটা বালকের কাছে আরো ভয়াবহ ছিল, কারণ সে ফ্রিজের বাইরে আর কোথাও বরফ দেখেনি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পতনের পরবর্তী সময়ে যে ছেলেটা বড় হচ্ছে, তার কাছে The Emperor’s New Clothes (‘সম্রাটের নতুন পোষাক’) গল্পের একটা আলাদা মজা ছিল।
হয়ত অন্য কোথাও থেকে যেসব গল্প আসে, সেসব রূপকথার মতো লাগে। তবে আমার জন্য সবচাইতে বড় বিস্ময় ছিল বাড়ির আঙিনাতেই। লেখক হিসেবে আমি মনে করি এটা আমার পরম সৌভাগ্য যে আমি এইসব গল্পের মাঝে বড় হয়েছি।
এর মধ্যে কিছু কিছু গল্পের মূলসূত্র ধর্মীয় ছিল, তবে আমার বাড়ির পরিবেশে ধার্মিকতার আনাগোনা ছিল অল্পই, তাই আমি এগুলো অপূর্ব গল্প হিসেবে গ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। যখন প্রথম মহাভারত মহাকাব্যের গল্পে শুনি পরাক্রান্ত দেবতা ইন্দ্র বিখ্যাত মন্দার পর্বত দিয়ে ছায়াপথ বা Milky Way মন্থন করে বিশাল দুধের মহাসমুদ্র থেকে অমৃত নামে অমরত্বের নির্যাস উদ্ধার করে, তখন আমি তারার দিকে নতুন করে তাকাতে শিখি।
সেই অবিশ্বাস্যরকমের প্রাচীন সময়ে, আমার ছেলেবেলায়, আজকালকার আলো আতিশয্যের দূষণ নগরবাসীর কাছে রাতের আকাশের তারা অদৃশ্য করে দেবার আগে, বম্বের কোনো বাগানে একটি বালকের পক্ষে তখনো সম্ভব ছিল পরম কৃতার্থ হয়ে রাতের আকাশের পানে চেয়ে গ্যালাক্সির মোটা দাগটি প্রত্যক্ষ করা। আমার কল্পনায় যেন সেটা দিয়ে অমৃতধারা ঝরে পড়ত। হয়ত হাঁ করলে আমার মুখেও দুয়েক ফোঁটা পড়ত, আমিও অমরত্ব লাভ করতাম।
বিস্ময়কর গল্প এবং তার বংশধর কথাসাহিত্য - এদের এই হলো জাদু। একই সাথে বোঝা যায় যে গল্পটা কল্পনার ফসল, অর্থাৎ সত্যি নয়, অথচ তার মধ্যে গভীর এক সত্য নিহিত। এই রকম মুহূর্তে জাদু আর বাস্তবের মধ্যে ভেদাভেদ ঘুচে যায়।
আমাদের বাড়িতে আমরা কেউ হিন্দু ছিলাম না, কিন্তু হিন্দুধর্মের বড় বড় কাহিনিকে আমরা আপন করে নিয়েছিলাম। গণপতি উৎসবের দিন যখন গণেশের প্রতিমা নিয়ে শোভাযাত্রা চৌপাট্টি সমুদ্রের ধারে গিয়ে প্রতিমা বিসর্জন দিত, তখন আমার মনে হতো গণেশ আমারও। তখন মনে হতো গণেশ সামূহিক আনন্দের প্রতীক, এবং হ্যাঁ, শহরের সামগ্রিক ঐক্যের প্রতীক। তাকে মোটেও ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ধর্মের দেবতাগুচ্ছের একজন মনে হতো না।
যেদিন জানতে পারলাম যে গণেশ সাহিত্য এতটাই ভালোবাসতেন যে ভারতে হোমারের সমতুল্য ব্যাসদেবের পায়ের কাছে বসে মহাভারতের অনুলিখন করেন, তখন তিনি আমার আরো বেশি আপনার লোক হয়ে গেলেন। আমি যখন বড় হলাম তখন সেলিম নামে একটা ছেলেকে নিয়ে উপন্যাস লিখলাম। সেলিমের নাকটা অস্বাভাবিকরকমের বড়। সেলিমের যদিও মুসলিম পরিবারে জন্ম, Midnight’s Children-এর (মধ্যরাতের সন্তান) উপন্যাসের সূত্রধরের সাথে সবচাইতে সাহিত্যঘেঁষা দেবতা, যার বিশাল শুঁড়বিশিষ্ট নাকটাও বেশ বড়, তার সাথে একটা সম্পর্ক রচনা আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। সেই প্রাচীন, অসাম্প্রদায়িক বম্বে শহরে বিভিন্ন ধর্মাশ্রিত সংস্কৃতিগুলোর বিভাজন এইভাবে মিলিয়ে যেত। আজ মনে হয় সেই পুরনো মানবিকতাপূর্ণ প্রবণতা বর্তমান ভারতের তিক্ত, গুমোট, শাসানিপূর্ণ ভেদবুদ্ধি জর্জরিত সমাজের সাথে অতীতের ফারাক চিহ্নিত করে।
একথা মানতে হবে যে এইসব গল্পের প্রভাব যে সব সময় ভালো হয় তা নয়। ভারতীয় জনতা পার্টির মতো হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলগুলোর ভেদবুদ্ধি-তাড়িত রাজনীতিতে রাম রাজ্য বা ভগবান রামের শাসনের তথাকথিত হিন্দুধর্মের স্বর্ণযুগের কাল্পনিক অতীতে ফেরার যে হাতছানি দেওয়া হয়, সেখানে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মতো উটকো ঝামেলা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। দুষ্ট সাম্প্রদায়িক মাতব্বরদের হাতে রামায়ণ এবং সাধারণভাবে হিন্দুধর্মের রাজনীতিকরণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
*
তবে আমি ফিরে যেতে চাই বাল্যকালের প্রসঙ্গে – সেই ছেলেবেলার সত্তায়, যখন গল্পের জাদু আমায় মুগ্ধ করত, যখন গল্পের একটিই উদ্দেশ্য ছিল – তা হলো মুগ্ধতা সৃষ্টি। বড় বড় ধর্মীয় মহাকাব্য থেকে নজর ফিরিয়ে বরং আমি তাকাতে চাই প্রতীচ্যের মহাফেজখানায় সংরক্ষিত অজস্র কুৎসাপূর্ণ, ছলচাতুরিভরা, রহস্যময়, উত্তেজক, কৌতুকপ্রদ, পরাবাস্তব এবং অনেক সময় অত্যন্ত আদিরসাত্নক গল্পের সম্পদের দিকে – কারণ – এই সব গল্পে বোঝা যায় একবার ঈশ্বরকে সাহিত্যের আঙিনা থেকে দূর করতে পারলে সাহিত্য অপার আনন্দের উৎস হয়ে উঠতে পারে।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ‘এক হাজার ও এক রাত’ বা আরব্য রজনীতে যেসব গল্প সংগ্রহ করা হয়েছে, তার একটা অত্যাশ্চর্য দিক হচ্ছে ধর্মবিশ্বাসের অনুপস্থিতি। প্রচুর যৌনতা, অনেক দুষ্টুমি, বেশ কিছুটা চালাকি – দৈত্য, জ্বিন, বড় বড় রকপাখি; রক্তপাত আর হানাহানিও অপর্যাপ্ত, কিন্তু ঈশ্বরের কোনো দেখা নেই। এই জন্য গোঁড়া কাঠমোল্লারা একে এত অপছন্দ করে।
মিসরে ২০১০ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারাকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মাত সাত মাস পর কয়েকজন ইসলামপন্থী উকিল খবর পেলো যে ‘আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা’ (আরব্য উপন্যাসের আরবি নাম) নতুন সংস্করণ বেরুচ্ছে। তারা এই ব্যাপারে মামলা ঠুকে দিলেন। মামলার দাবি ঐ সংস্করণ প্রত্যাহার করা হোক এবং বইটি নিষিদ্ধ করা হোক, কারণ এটি ‘পাপ ও অনাচারের আহবান,’ এতে সরাসরি যৌন উত্তেজনাকর কথা আছে। সৌভাগ্যবশত তাদের মামলা সফল হয়নি, এবং মিসরের মানুষ আরো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মেতে ওঠে। তবে আসল কথা হচ্ছে, তাঁদের যুক্তি ভুল নয়।
সত্যি বইটিতে বেশ কয়েকটি আদিরসাত্মক উল্লেখ রয়েছে, এবং গল্পের চরিত্রগুলোর ধর্মপ্রাণ জীবনের চাইতে রতিক্রিয়া নিয়েই মাথাব্যথা বেশি। উকিলরা যেমনটা যুক্তি দিচ্ছেন, সেটা আসলেই অনাচারের দিকে হাতছানি, যদি অমন বিকৃত গোঁড়া দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আপনি পৃথিবীকে দেখতে চান। আমার তো মনে হয় এই হাতছানিটা একটা চমৎকার জিনিস, এবং এতে সাড়া দেওয়াটাও খুব ভালো কাজ। তবে আপনি বুঝতে পারছেন যে যেসব লোকে সঙ্গীত, রঙ্গ ও আনন্দ অপছন্দ করে, তারা এতে গোস্যা করবেন। যেটা অত্যাশ্চর্য অবাক কাণ্ড, তা হলো এই গল্পগুলো প্রথম পৃথিবীতে অবতীর্ণ হবার ১,২০০ বছর পরও এই অপূর্ব গল্পগুলোর অপূর্ব সমাবেশ, আজও বিশ্বের কট্টর চরমপন্থীদের ক্রোধ উৎপাদনের ক্ষমতা রাখে।
আজ যেই বইটিকে আমরা ‘আরব্য উপন্যাস’ বলি তার উৎপত্তি আরব বিশ্বে নয়। সম্ভবত এর উৎপত্তি ভারতে। ভারতের গল্পসম্ভারও গল্পের কাঠামোর ভেতর আরো গল্প বলার রীতিটি পছন্দ করে, গল্পের মধ্যে গল্প, বা জীবজন্তুদের নিয়ে গল্পও ভারতে জনপ্রিয়। অষ্টম শতাব্দীর কোনো এক সময়ে এই গল্পগুলো ফারসি ভাষায় প্রবেশ করে, এবং এতদিন পর টুকিটাকি যে খবর আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি তাতে জানা যায় যে সঙ্কলনের নাম ছিল ‘হাজার আফসানা’ বা ‘এক হাজার গল্প। ’
দশম শতাব্দীতে বাগদাদের একটা নথিতে হাজার আফসানার বর্ণনা রয়েছে। সেখানে তার মূল কাঠামোর গল্পটি উল্লেখ রয়েছে। সেই গল্পে এক দুর্বৃত্ত রাজা প্রতি রাতে একজন উপপত্নী খুন করেন। এই সব অভিশপ্ত উপপত্নীদের একজন গল্প বলে নিজের মৃত্যুদণ্ড ঠেকাবার পর সেই হত্যাকাণ্ড থামে। এখানেই আমরা ‘শাহারজাদী’ নামটা প্রথম পাই। দুঃখের বিষয়, আজ ‘হাজার আফসানা’-এর একটি কপিরও অস্তিত্ব নেই। বিশ্ব ইতিহাসে এই বইটি একটি রহস্যময় লুপ্ত যোগসূত্র। এই স্বনামধন্য বইয়ের মাধ্যমে ভারতের জাদু গল্প পশ্চিমে চলে এসে অবশেষে আরবি ভাষার সাথে তার মোলাকাত হয়, এবং সেটা ‘এক হাজার ও এক রাত’-এর রূপ নেয়। সেই বইটির আবার বহু রূপ আছে। এর কোনো স্বীকৃত প্রমিত রূপ নেই। তারপর গল্পগুলো অগ্রসর হয় আরো পশ্চিমে, প্রথমে ফরাসী ভাষায় অষ্টাদশ শতাব্দীতে আঁতোয়ান গালঁ-এর (Antoine Galland) রূপায়ণে – সেখানে আবার তিনি কিছু গল্প জুড়ে দেন যেটা আরবিতে নেই – যেমন ‘আলাদীনের আশ্চর্য চেরাগ’ এবং ‘আলি বাবা ও চল্লিশ চোর’।
ফরাসি থেকে সেই গল্প চলে আসে ইংরেজিতে, ইংরেজিতে থেকে চলে যায় হলিউডে। হলিউডের আবার নিজস্ব ভাষা আছে, সেখানে আমরা উড়ন্ত গালিচার দেখা পাই আর রবিন উইলিয়ামস হয় জ্বিন। (এটা লক্ষণীয় যে ‘আরব্য রজনীতে’ কোন উড়ন্ত গালিচা নেই। রাজা সোলোমনকে নিয়ে গল্প আছে যে তাঁর এরকম একটি গালিচা ছিল যেটার আবার মাপ পালটানো যেত। সেটাকে বড় করলে নাকি আস্ত সেনাবাহিনী পরিবহন করা যেত। )
কথকতার এই বিস্তৃত অভিবাসন বিশ্ব ইতিহাসের অনেকটা অনুপ্রেরণার উৎস। চলতে চলতে সে পৌঁছে গেছে দক্ষিণ আমেরিকার কল্পকাহিনিকারদের জাদুবাস্তবতায়। ফলে আমি নিজে যখন সেই একই ধরনের কৌশল ব্যবহার করলাম, তখন আমার এমন একটা অনুভূতি হলো যেন আমি কথকতাপরম্পরার বিশ্বময় চক্রটি পূর্ণ করে একেবারে তার যে মূল আবাস, যে দেশে তার শুরু, সেখানে নিয়ে এলাম। তবে হাজার আফসানার অবলুপ্তির জন্য বড় দুঃখ হয়। এই গল্পের আকরটি আবিষ্কৃত হলে সব গল্পের পেছনে যে আসল গল্প, সেই গল্পটি পূর্ণ করত। সেটা এক আবিষ্কারের মতো আবিষ্কার হতো বটে।
এই আবিষ্কারের ফলে হয়তো মূল অবকাঠামোর গল্পটির একেবারে কেন্দ্রে বা শেষের দিকে অবস্থিত একটা রহস্যের গ্রন্থিমোচন ঘটত। এই প্রশ্নটি বেশ কিছু বছর ধরে বার বার করছি: শাহারজাদী ও তার বোন দুনিয়ারজাদী কী এক হাজার ও এক রাত্রি-এর আরো পরে নিজেরাই খুনী হয়ে যায়? তারা কি তাদের রক্তপিপাসু স্বামীদের খুন করে?
‘ভারত ও চীন দ্বীপ বা উপদ্বীপের’ অধিপতি শাহরিয়ার এবং বর্বর সামারকান্দ-এর সার্বভৌম অধিপতি শাহ জামান ঠিক কত নারী খুন করেছিল? এই খুনোখুনি শুরু হয় যখন শাহজামান তার স্ত্রীকে রাজপ্রাসাদের পাচকের বাহুবন্ধনে আবিষ্কার করে। শাহজামান ওদের টুকরো টুকরো করে কুপিয়ে তার ভাইয়ের বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করে। সেখানে সে দেখে রাণী, অর্থাৎ শাহরিয়ারের স্ত্রী ১০জন সহচরী ও দশজন ক্রীতদাসে নিয়ে বাগানে রয়েছে। দশ জন জোড়ায় জোড়ায় যৌন সম্ভোগে মত্ত। রাণী তার প্রেমিককে গাছ থেকে নেমে আসতে বলে।
হায় প্রতারক নারীজাতি! শাহ জামান তার ভাইকে কি দেখেছে সেটা জানায়, এবং রাণীর সহচরী, ক্রীতদাস ও রাণীর প্রাপ্য পরিণতি ঘটে। (শাহরিয়ারের প্রয়াত রাণীর প্রেমিক মনে হয় রক্ষা পায়। )
বাদশাহ শাহরিয়ার ও বাদশাহ শাহ জামান প্রবঞ্চক নারীজাতির ওপর যথাসময়ে বদলা নেয়। তিন বছর ধরে তারা প্রতি রাতে একজন কুমারীকে বিয়ে করে তার সতীত্বহরণ করার পর তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করত। শাহারজাদীর বাবা ছিলেন শাহরিয়ারের উজির। তাকে স্বহস্তে এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হতো। উজির সৌখিন, সংস্কৃতিমনস্ক ব্যক্তি ছিলেন, স্বভাবে সংবেদনশীল। শাহারজাদীর মত এমন গুণবতী নারী যার কন্যা, তার বাবা তো অমনই হবে, তাই না? আর তার বোন দুনিয়ারজাদী তো আরেকজন ভালো, বুদ্ধিমতী, ভদ্র মেয়ে।
এইরকম চমৎকার দুই কন্যার বাবাকে যখন দিনের পর দিন তরুণীদের হত্যা করতে হতো, ওদের গলা কেটে রক্ত বের করতে হতো, তখন তার মনের অবস্থা কী হতো! সে কথা আমাদের জানানো হয়না। অবশ্য আমরা একথা জানতে পারি যে শাহরিয়ারের প্রজারা তার ওপর প্রচণ্ড ক্ষেপে যেতে শুরু করে। তারা তাদের মেয়েদের নিয়ে রাজধানী থেকে পালিয়ে যায়, ফলে তিন বছর পর শহরে আর কুমারী মেয়ের খোঁজ পাওয়া যায় না। শাহারজাদী, দুনিয়ারজাদী, ছাড়া আর কোনো কুমারীই শহরে বাকি নেই।
শাহারজাদীর বাদশাহ শাহরিয়ারের সাথে বিয়ের পর তার কুমারীত্ব হরণের পর তার বোন দুনিয়ারজাদী বাসরশয্যায় এক প্রান্তে বসে শাহারজাদীর আদেশে একটি গল্প শুনতে চায়। গল্পে শাহারজাদীর আবির্ভাব ঘটতে ঘটতে শাহরিয়ার আর শাহ জামান দুই হাজার দুই শত তেরটি প্রাণ সংহার করেছে। এর মধ্যে মাত্র ১১ জন পুরুষ।
শাহারজাদীকে বিয়ে করার পর শাহরিয়ার তার গল্পে এমনই মশগুল হয়ে যায় যে সে নারীহত্যা বন্ধ করে। শাহ জামানের ওপর সাহিত্যের ঐরকম শাসন ছিলনা, সে তার প্রতিহিংসাযজ্ঞ চালিয়ে যেতে থাকল। এক হাজার এক রাতের পর হত্যার সংখ্যা দাঁড়াল তিন হাজার দু’শ চোদ্দ।
শাহারজাদীর কথা ধরা যাক। ওর নামের অর্থ ‘শহরে জন্ম নিয়েছে যে। ’ নিঃসন্দেহে শহুরে মেয়ে সে, চালু, ঠোঁটকাটা, কখনো আবেগপ্রবণ, কখনো বা তীক্ষ্ণদৃষ্টিসম্পন্ন। তাকে যে কোন আধুনিক শহুরে কথাকারের সাথে তুলনা করা চলে। শাহারজাদী, যে কিনা তার কখনো-শেষ-হয়-না এমন গল্প দিয়ে রাজপুত্রকে মোহাবিষ্ট করেছে। শাহারজাদী, জান বাঁচাবার জন্য যে গল্প বলে, যে মৃত্যুর সাথে গল্প দিয়ে পাঞ্জা লড়ে, সে যেন আমেরিকার স্ট্যাচু অব লিবার্টির মতো, কিন্তু সেটা শব্দরাজি দিয়ে প্রস্তুত, ধাতব অবকাঠামো দিয়ে নয়। শাহারজাদী, যে বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজার মৃত্যুগহবর তুল্য শয্যাগৃহে ধাবমান কাফেলায় সামিল হয়। শাহারজাদী, যে রাজাকে বশীভূত করে বোন বাঁচাবার কঠিন দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেয়। এই যে খুনী জানোয়ারের মতো লোকটা, তার ভেতর একটা মানুষ লুকিয়ে আছে এই বিশ্বাস ছিল শাহারজাদীর, সেই সাথে এই বিশ্বাসও ছিল যে সে গল্প বলে এই লোকটার মানবিকতা উদ্ধার করতে পারবে।
সত্যি কী অপূর্ব নারী! বাদশাহ শাহরিয়ার কেন তার প্রেমে পড়ে গেলেন সেটা বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় না। প্রেমে সে ঠিকই পড়েছিল, তার সন্তানের বাবা হয়েছিল। যত রাতের পর রাত পার হচ্ছিল, ততই সে বুঝিতে পারছিল তার খুনের হুমকি ফাঁকা হয়ে গিয়েছে, আর তার পক্ষে তার উজির, অর্থাৎ শাহারজাদীর বাবাকে দিয়ে এই সব হত্যাকাণ্ড করার আদেশ দেওয়া সম্ভব ছিলনা। এমন এক নারীর প্রজ্ঞা তার বর্বরতা খর্ব করে যে এক হাজার আর এক রাত অন্যের জীবন বাঁচাতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিল। তার আস্থা ছিল যে তার কল্পনা বর্বরতাকে ঠেকাবে। সেটা শক্তি দিয়ে নয়, বরং অবাক কাণ্ড, বর্বরতাকে দমন করে মানুষটাকে সুশীল, সভ্য করে।
কী ভাগ্যবান বাদশাহ! কিন্তু (এটা আরব্য উপন্যাসের একটি অমীমাংসিত রহস্য) এই নারী কেন রাজার প্রেমে পড়লো? আর ছোটবোন দুনিয়ারজাদী, যে এক হাজার এক রাত ধরে বাসরশয্যার পাশে বসে বোনের সাথে রক্তপিপাসু বাদশাহর রতিক্রিয়া প্রত্যক্ষ করেছে, তার গল্প শুনেছে – দুনিয়ারজাদী, সে শুধু চিরন্তন শ্রোতাই নয়, সব দেখেও - সে-ই বা কেন শাহ জামানকে বিয়ে করতে রাজি হয়। শাহ জামানের ইতিহাস তো আরো রক্তরঞ্জিত।
কীভাবে এই দুই নারীর মর্মোদ্ধার করব? গল্পে এই বিষয়ে একটা বিশাল নিরবতা রয়েছে সেটা যেন চিৎকার করে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করে। আমরা এটুকু মাত্র জানতে পারি: সব গল্প শেষ হবার পর, শাহ জামান ও দুনিয়ারজাদীর বিয়ে হয় তবে শাহারজাদী একটা শর্ত আরোপ করে – শাহ জামানকে তার নিজ রাজ্য ত্যাগ করে ভাইয়ের সাথে এসে থাকতে হবে, যাতে দুই বোন আলাদা না হয়। শাহ জামান সানন্দে তাতে রাজি হয়, এবং নিজের ভাইয়ের বদলে শাহরিয়ার সামারকান্দ শাসনের দায়িত্ব দেয় সেই একই উজিরকে যে এখন তার শ্বশুর। শ্বশুর যখন সামারকান্দে আসে তখন নগরবাসী উল্লসিত হয়, এবং শহরের কেষ্টুবিষ্টুরা সবাই প্রার্থনা করেন তার শাসন যেন দীর্ঘস্থায়ী হয়। সেটাই অবশ্য হয়েছিল।
এই প্রাচীন গল্পটি গ্রন্থিমোচন করতে গিয়ে আমার প্রশ্ন হলো: মেয়ে আর বাবার মধ্যে একটা চক্রান্ত ছিল কি? এমন কি হওয়া সম্ভব যে শাহারজাদী আর উজির দুজনে মিলে কোন গোপন চক্রান্ত ফেঁদেছে? কারণ শাহারজাদীর কৌশলের কারণে শাহ জামান আর সামারকান্দের রাজা নয়। শাহারজাদীর কৌশলের কারণে তার বাবা এখন আর কারো আজ্ঞাবহ নয়, অনিচ্ছায় তাকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হয় না, সে এখন নিজেই রাজা। শুধু রাজাই নয়, লোকে তাকে ভালোবাসে, সে একজন বিজ্ঞ লোক, রক্তগঙ্গা ভাসিয়ে দেওয়া এক জানোয়ারের পর সে এক শান্তির দূত। তারপর হঠাৎ করে, কোন কৈফিয়ত ছাড়াই একই সাথে শাহরিয়ার আর শাহ জামানের মৃত্যু হলো। মৃত্যু, যা কিনা ‘সুখ ধ্বংসকারী, সমাজ ছিন্নকারী, বসতি লোকশূন্যকারী, গোরস্থানের পর গোরস্থানের পত্তনকারী’ সেই মৃত্যুই ওই দু’জনের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটালো। ওদের দু’জনের প্রাসাদ আস্তে আস্তে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলো আর ওদের জায়গায় এলো এক বিচক্ষণ ও বিজ্ঞ শাসক, যার নাম আমাদের বলা হয় না।
কিন্তু ‘সুখ ধ্বংসকারী’ মৃত্যুরই বা আগমন ঘটলো কেন? গল্পে যেমন ইঙ্গিত রয়েছে, দুই ভাইয়ের মৃত্যু একই সময়ে ঘটলো কেন? ওদের প্রাসাদই বা পরে ধ্বংসস্তুপ হয়ে গেল কেন? আর তাদের উত্তরসূরী যে বিজ্ঞ, নাম অনুল্লেখিত রাজা, তিনিই বা কে?
সেটা আমাদের জানানো হয় না। কিন্তু আরেকটিবার কল্পনা করুন অত বছর নিরীহ মানুষের রক্তপাত করতে বাধ্য হয়ে উজির রাগে টগবগ করছে। তার শঙ্কার কথাটা কল্পনা করুন। এক হাজার এক রাত ধরে তার দেহের রক্ত যাদের ধমনীতে বইছে, সেই দুই কন্যা শাহরিয়ারের শোবার ঘরে বদ্ধ, ওদের নিয়তি একটা গল্পের ওপর নির্ভর করছে।
মানুষ কতদিন প্রতিশোধের জন্য অপেক্ষা করে? সে কি এক হাজার আর এক রাতের জন্য অপেক্ষা করে? এই বিষয়ে আমার অনুমান, উজির, যে এখন সামারকান্দের রাজা, সেই বিজ্ঞ রাজা যে শাহরিয়ারের রাজত্বের শাসক হয়। আর দুই রাজা এক সাথে হয় তাদের স্ত্রীর হাতে নতুবা উজিরের হাতে খুন হয়। এটা আমার অনুমান মাত্র। হয়তো উত্তরটা হারিয়ে যাওয়া মহাগ্রন্থের মধ্যে আছে। হয়তো নেই। আমরা শুধু জল্পনা কল্পনা করতে পারি।
যাই হোক, সর্বশেষ হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা তিন হাজার দু’শ ষোল। এর মধ্যে ১৩ জন পুরুষ।
*
গোড়াতেই যেসব গল্প শুনে আমি সাহিত্যের প্রেমে পড়ে যাই, সেই সব কাহিনি মোহময় অসম্ভবের গল্প, সেসব সত্যি নয়। কিন্তু সত্যি নয় বলেই সেসব গল্প থেকে আসল সত্য বেরিয় আসত। সত্যের ওপর যেসব গল্প নির্ভর করে, তার চাইতে আরো সুন্দর ও স্মরণযোগ্য করে সেই সত্য উচ্চারিত হতো। সেসব গল্প অনেক অনেক দিন আগের ঘটনা নয়। সেসব আজকের ঘটনা হতে পারে। গতকাল, আজ অথবা আগামী কাল।
প্রাচ্যের গল্পবলার পরম্পরায় জন্তু জানোয়ারের গল্পের অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী। এর মধ্যে যেগুলো সেরা গল্প, সেগুলোতে ঈসপের গল্পের মতো নীতিকথা নেই। এই সব গল্পে বিনয়, নম্রতা, সততা বা কৃচ্ছতার নীতিকথা শোনানো হয় না। এতে সত্যের জয়ের কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া হয় না। ফলে এই গল্পগুলো আশ্চর্যরকমের আধুনিক। মন্দ লোকেরাও মাঝে মাঝে জয়ী হয়।
পঞ্চতন্ত্র নামে ভারতের প্রাচীন গল্পসংকলনে দুই শেয়ালের গল্প আছে। করটক এদের মধ্যে ভালো, আর দামানক, সে হলো দুষ্টু চক্রান্তকারী। বইয়ের শুরুতে তারা সিংহ রাজার সেবায় নিয়োজিত, কিন্তু রাজার যখন আরেকজন পারিষদ ষাড়ের সাথে বন্ধুত্ব হয়, দামানক সেটা সুনজরে দেখে না। সে তখন ছল চাতুরী করে সিংহকে বিশ্বাস করায় যে ষাড় তার শত্রু। সিংহ নিরীহ পশুকে খুন করে, আর শেয়াল দুটো সেটা প্রত্যক্ষ করে। গল্প শেষ।
এই ধরনের মারদাঙ্গা হলিউডী ছবির হিংস্রতার তুলনায় ঈসপের নীতিকথামূলক নানা গল্প – যেমন উদ্ধত দ্রুত (খরগোশের) বিরুদ্ধে পরিশ্রমী অথচ ধীরের (কচ্ছপ) জয়, বা নেকড়ে না থাকলেও ‘নেকড়ে!’ বলে চীৎকার করার বোকামি, বা যে রাজহাস সোনার ডিম পাড়ে সেটাকে মেরে ফেলার গল্প – এসব গল্প রীতিমতো জোলো লাগে। এই নাকি শান্তিময়, মরমী প্রাচ্য!
আমি নিজে অভিবাসী, তাই দেশ থেকে দেশান্তরে গল্পের যাত্রাপথ আমাকে খুব আকৃষ্ট করে। এই শেয়ালের গল্প প্রায় আরব্য রজনীর গল্পের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে – আরবী ও ফারসী দুই রূপেই এই গল্পের উপস্থিতি রয়েছে। এই নবরূপে শেয়াল দুটোর নাম কালিলা আর ডিমনা। এই শেয়ালগুলো আবার হিব্রু আর ল্যাটিন গল্পে আবির্ভূত হয়েছে। অবশেষে ওরা ইংরেজি আর ফরাসীতে Fables of Bidpai (বিদপাই-এর কাহিনি)-তে হাজির। তবে আরব্য রজনীর গল্পের সাথে এই গল্পগুলোর তফাত হলো আধুনিক পাঠকদের কাছে এইসব গল্প পরিচিত নয়, সম্ভবত গল্পগুলোর ‘সকলের মুখে হাসি গান আর গান’ মার্কা জোলো সমাপ্তি নেই বলে ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানির এই বিষয়ে তেমন আগ্রহ নেই।
তাই বলে এদের প্রভাব যে কম তা নয়। এই প্রভাবের কারণ দৈত্য-দানব-জাদুমন্ত্র যাই থাক না কেন, এই গল্প মানবচরিত্রের এক বিশ্বস্ত চিত্র আঁকে।(এমনকি মানবস্বভাবসদৃশ জীব-জন্তু গল্পের চরিত্র)। এখানে আমরা মানবজীবনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাই – তার সাহস আর কাপুরুষতা, তার নীতিনিষ্ঠা আর ভ্রষ্টচরিত্র, তার সরলতা আর কুটিলস্বভাব। গল্পগুলোতে সাহিত্যের সবচাইতে দীর্ঘস্থায়ী প্রশ্নটির উত্তর সন্ধান করা হয় – যখন সাধারণ মানুষের জীবনে অসাধারণের আবির্ভাব হয় তখন তারা কীভাবে তার মোকাবেলা করে? এই সব গল্প তার উত্তরে বলে – কখনো কখনো আমরা খুব ভালোভাবে মোকাবেলা করি না, আবার কখনো কখনো নিজের মধ্যে অজানা শক্তি কোথার থেকে সঞ্চয় করি, শিরদাঁড়া সোজা করে উঠে দাঁড়াই, দৈত্যকে পদানত করি, বিউলফ গ্রেন্ডেলকে হত্যা করে, তার আরো ভয়ঙ্কর মাকে খুন করে, রেড রাইডিং হুড নেকড়েকে খুন করে, বিউটি বিস্ট বা দৈত্যের মনের প্রেম আবিষ্কার করে, তখন আর সে দানবিক থাকে না এই হল জাদু, মানুষের জাদু, জাদুগল্পের সত্যিকার জাদু।
এই জাদুগল্প থেকে আমি এই শিক্ষা পাই যে গল্প বলার কৌশল অনেক রকমের হতে পারে, তার সম্ভাবনা অসীম, আর এই উপায়গুলো মজায় ঠাসা। বাস্তবের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-গভীরতার যে তিনটি মাত্রা, সেখানে কল্পলোকের আগমনের ফলে চতুর্থ, পঞ্চম ষষ্ঠ সপ্তম মাত্রা যুক্ত হয়, ফলে আমরা বাস্তবকে যেভাবে অনুভব করি সেটা আরো সমৃদ্ধ হয়, তীব্রতর হয়। এটা বাস্তব থেকে পালিয়ে ঢিসুম-ঢাসুম আজগুবি সুপার হিরো বা ভৌতিক ভ্যাম্পায়ারের কাল্পনিক জগতে গমন নয়।
শুধুমাত্র কথাসাহিত্যের গাল্পিক প্রবণতাকে উন্মুক্ত করে, কল্পনার কাল্পনিক ক্ষমতাকে অবাধ করে, আমাদের স্বপ্নলোকের স্বপ্নিল গীতিময়তার নিরবিচ্ছিন্ন প্রকাশে আমরা আশা করতে পারি যে আমরা নতুনকে বরণ করতে পারবো, এমন কথাসাহিত্য সৃষ্টি করতে পারব যা সত্যের চাইতেও চিত্তাকর্ষক।
কল্পলোকের ছোঁয়া শুচিতার ধার ধারেনা, সেটা যে বাস্তব থেকে পালাতে চায়, তাও নয়। কল্পনার বিস্ময়লোক কারো আশ্রয় নয়, এমনকি সে যে স্থান হিসেবে খুব আকর্ষণীয় বা পছন্দ করার মতো তাও নয়। এটা নরমেধ, শোষণ, নির্মমতা, ভয়ের আড্ডা হতে পারে, সাধারণত তাই হয়। ক্যাপ্টেন হুক পিটার প্যানকে খুন করতে চায়। ব্ল্যাক ফরেস্ট-এর ডাইনি হ্যান্সেল আর গ্রেটেলকে উনুনে রান্না করতে চায়। নেকড়ে সত্যি রেড রাইডিং হুডের দাদীকে খেয়ে ফেলে। আলবাস ডাম্বল্ডোরকে খুন করা হয়, লর্ড অফ দ্য রিংস সম্পূর্ণ মিডল আর্ত্থ-কে ক্রীতদাসে পরিণত করার পাঁয়তারা করছে।
এসব গল্প শোনার সময় আমরা জানি যে যদিও গল্পগুলো ‘অবাস্তব’ কারণ গল্পের মতো গালিচা তো আর আকাশে ওড়ে না, আর জিঞ্জারব্রেড বিস্কুটের ঘরের অস্তিত্ব নেই, কিন্তু তারপরও এগুলো ‘বাস্তব’ কারণ গল্পগুলোর কারবার বাস্তব নিয়ে – ভালোবাসা, শত্রুতা, ভয়, ক্ষমতা, সাহসিকতা, ভীরুতা, মৃত্যু। শুধু তফাত এরা এই গন্তব্যে পৌঁছায় ভিন্নপথে। এমনই এদের জগৎ, যদিও আমরা জানি জগৎটা আসলে এমন নয়। শুধু বাস্তবের অনুকরণের মাধ্যমে সত্যে পৌঁছনো যায় না। একটি চিত্র ক্যামেরাতেও ধরা পড়ে, শিল্পীর তুলিতেও ধরা পড়ে। তারকা খচিত আকাশের চিত্রশিল্প একটি স্থিরচিত্রের চাইতে কিছু কম সত্য নয়। চিত্রশিল্পী যদি ভ্যান গ’ হন, তাহলে সেই চিত্রশিল্প আরো বেশি সত্য, যদিও অনেক কম ‘বাস্তব।’
কল্পলোকচারী সাহিত্য – জাদুর গল্প, লোকগাঁথা, উপকথা, জাদুবাস্তব উপন্যাস – বরাবরই মানুষ, তার সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ ও গভীরতম ভেদবুদ্ধি সম্পর্কে প্রগাঢ় সত্যকে ধারণ করে। জাদুর গল্প আমাদের সম্বন্ধে এমন সব সত্য তুলে ধরে যা প্রায়ই অপ্রীতিকর – আমাদের ভেতরের ভেদবুদ্ধি প্রকাশ করে দেয়, আমাদের আদিম যৌন প্রবৃত্তি অনুসন্ধান করে, আমাদের গভীরতম ভীতি কী নিয়ে সেটা শনাক্ত করে। এইসব গল্প শুধু বাচ্চাদের বিনোদনের জন্য লেখা হয়নি, অনেকগুলো গল্প তো বাচ্চাদের জন্যই লেখা হয়নি। নাবিক সিন্দবাদ বা আলাদীনের যখন গল্পের জগতে প্রথম আবির্ভাব ঘটে, তখন তারা মোটেও ডিজনি ছবির চরিত্র ছিল না।
তবে বর্তমান সময়টা শিশু ও শিশুমনা বড়দের সাহিত্যের এক বর্ণাঢ্য সময়। মরিস সেন্ডাকের (Maurice Sendak) “Where the Wild Things Are” থেকে শুরু করে ফিলিপ পুলম্যানের (Phillip Pullman) ধর্মাশ্রয়ী চেতনা-উত্তর অতিবাস্তব জগত; নার্নিয়া্র কল্পলোকে আমরা একটা আলমারি দিয়ে প্রবেশ করি; এক অশরীরী ফোনের বুথ থেকে অদ্ভুত সব জগতে আমরা যাত্রা করি, হ্যারি পটারের হগওয়ার্থ থেকে মিডল আর্থ – এই সব গল্প আমাদের জানান দেয় যে অতিবাস্তব কল্পলোক ভালোভাবেই বেঁচে আছে। এইসব নানান এ্যাডভেঞ্চারে শিশুরাই বড় হয়ে বীর হয়, প্রায়ই তারা বড়দের জগতকে উদ্ধার করে। আমরা এই শিশু ছিলাম একদিন, এই শিশুটি এখনো আমাদের মধ্যে রয়েছে, এই শিশুরা কল্পলোককে বোঝে, গল্পের মধ্যে সত্যিটা কোথায় তারা জানে। জানেনা শুধু বড়রা, কারণ তারা এই সত্যগুলো ভুলে গিয়েছে।