বই স্মৃতি, বিস্মৃতি, স্মৃতির বই
ইন্দ্রাণী দত্ত | এ' যাবৎ পড়া বই এর স্মৃতির ব্যাপারটা সেরকমই - মাঝপথে দাঁড়িয়ে জীবনের গোড়ার দিকের পড়া বই এর কথা ভাবছি যখন, মাথার ওপর চিলেকোঠার ছাদে অজস্র পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি- মৃত ব্যক্তিরা ফিরে আসছে এক এ
একবার একটা লম্বা গল্প পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে মধ্যপথে থেমে গিয়েছিলাম। তারপর আবার শেষ থেকে পড়তে থাকি। সমাপ্তি থেকে গল্পের মধ্যপথে পৌঁছনোর অভিজ্ঞতা পূর্বপাঠের থেকে আলাদা হয়ে যেতে থাকে এবং টের পাই, আপ ডাউনের রাস্তা বিলকুল আলাদা।
এ' যাবৎ পড়া বই এর স্মৃতির ব্যাপারটা সেরকমই - মাঝপথে দাঁড়িয়ে জীবনের গোড়ার দিকের পড়া বই এর কথা ভাবছি যখন, মাথার ওপর চিলেকোঠার ছাদে অজস্র পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি- মৃত ব্যক্তিরা ফিরে আসছে এক এক করে; এক একটি বই মানে এক একটি সম্পর্ক আর এক এক জন মানুষ। বই যেন নৌকো- বই বেয়ে বেয়ে বৈতরণী পার হয়ে তাঁরা আমার কাছে ফিরছে-
দিদা ফিরল পাতলা এক ছড়ার বই চড়ে- লেখকের নাম যতদূর মনে পড়ছে, অণুকণা খাস্তগীর -উৎসর্গপত্রে লেখা ছড়া-'রিমি রিমি ওরে/ এ বই দিলাম তোরে/ বড় হবি যখন / বইটি পড়বি তখন/ আমার আশির্বাদ/ রইল এরই সাথ। দিদা"; আর আমরা দুই বোন অবাক হয়ে ভাবছি, দিদার নাম অণুকণা খাস্তগীর হল কী করে?
বীণা হাতে মালা গলায় সরস্বতী ঠাকুর ফিরছে গীতবিতান চড়ে- কাগজের শিকলি টিকলি সমেত- বাঁধানো নীল বই, পাতার ভাঁজে গাঁদাফুলের পাপড়ির ফসিল, শিরদাঁড়ায় চন্দন আর শান্তিজলের ছিটা পড়েছিল- দাগ ধরে গেছে; এইচ এম ভি ফিয়েস্তায় বাল্মীকিপ্রতিভা চলছে থার্টি থ্রী আর পিএমে আর আমি গীতবিতানের ৬৪৫ পৃষ্ঠা খুলে মিলিয়ে নিচ্ছি গানের ক্রম; তারপর " দেবী গো, চাহি না চাহি না, মণিময় ধুলিরাশি চাহি না" জায়গাটায় পেন্সিলের দাগ দিচ্ছি একটা-"লক্ষ্মীর অন্তর্ধান" শব্দদ্বয়ের দিকে তাকিয়ে আবির্ভাব শব্দের মহিমা বুঝতে পারছি যেন।
জেঠু ফিরে এল দুটো বই এর ওপর ভেসে ভেসে, টুং করে গেট খুলে ঢুকল; বলল, এসে গেছি। অদ্ভূত যত ভূতের গল্প র পাতা ওল্টাতেই ভয়ের বদলে হাসি পেল- একটা লোক প্রচন্ড শীতে এত জামা কাপড় কোট সোয়েটার পরেছে যে ভূত দেখে রামনাম করবে বলে পৈতেগাছ খুঁজে পাচ্ছে না, শীত নিয়ে কবিতা লিখছে সে লোক- বস্তা বস্তা বস্তা পুঞ্জ পুঞ্জ তীব্র হিম ঢেলে/ ব্যোমমার্গে কে রচিল শীতের পাহাড়... পরে কবিতাই প্রমাণ করছে সে ভূত নয়, জলজ্যান্ত মানুষ- কবি।
জেঠু আর একটা বই দিল তারপর- গল্পগুচ্ছ- একটা লোডশেডিংএর রাত ফিরল সেই সঙ্গে, ফিরল, "অপরাহ্নে মেঘ করিয়াছিল, কিন্তু বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা ছিল না। .... রাইচরণ ধীরে ধীরে গাড়ি ঠেলিয়া ধান্যক্ষেত্রের প্রান্তে নদীর তীরে আসিয়া উপস্থিত হইল। নদীতে একটিও নৌকা নাই, মাঠে একটিও লোক নাই মেঘের ছিদ্র দিয়া দেখা গেল, পরপারে জনহীন বালুকাতীরে শব্দহীন দীপ্ত সমারোহের সহিত সূর্যাস্তের আয়োজন হইতেছে। সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে শিশু সহসা এক দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল, "চন্ন, ফু।"
সমস্তজীবনের মত চন্ন ফু ডেমোক্লিসের খড়গের মত আমার মাথায় ঝুলে রইল- একটা ভয় পিছু নিল সারাজীবনের মত-এই বুঝি কেউ বলল - চন্ন ফু- এই বুঝি মুহূর্তের অসাবধানতা , এই বুঝি ঝপ করে একটা শব্দ হবে আর "চন্ন বলিয়া কেহ উত্তর দিল না, দুষ্টামি করিয়া কোনো শিশুর কন্ঠ হাসিয়া উঠিল না; কেবল পদ্মা পূর্ববৎ ছল্ছল্ খল্খল্ করিয়া ছুটিয়া চলিতে লাগিল, যেন সে কিছুই জানে না এবং পৃথিবীর এই-সকল সামান্য ঘটনায় মনোযোগ দিতে তাহার যেন এক মুহূর্ত সময় নাই।"
এরপর একটা নীল বেডকভার আসছে; পূবদিকের সবুজ রং করা জানলার পাট খোলা-রোদে রোদে ভরে যাচ্ছে বেডকভার আর সামনে খোলা জীবনস্মৃতি - অলীক মুহূর্ত তৈরি হচ্ছে তারপর " খড়খড়ি দেওয়া লম্বা বারান্দাটাতে মিটমিটে লন্ঠন জ্বলিতেছে , সেই বারান্দা পার হইয়া গোটা চার পাঁচ অন্ধকার সিঁড়ির ধাপ নামিয়া একটি উঠান ঘেরা অন্তঃপুরের বারান্দায় প্রবেশ করিয়াছি, বারান্দার পশ্চিমভাগে পূর্ব-আকাশ হইতে বাঁকা হইয়া জ্যোৎস্নার আলো আসিয়া পড়িয়াছে, বারান্দার অপর অংশগুলি অন্ধকার, সেই একটুখানি জ্যোৎস্নায় বাড়ির দাসীরা পাশাপাশি পা মেলিয়া বসিয়া প্রদীপের সলিতা পাকাইতেছে" ।
পিসিমণি বন্দে আলি মিঞার ছোটদের বিষাদসিন্ধু দিয়েছিল- এজিদ, জয়নাব, হাসান , হোসেন, কারবালার প্রান্তর; আর দিয়েছিল ছোটোদের জাতক কাহিনী- অদ্ভূত খসখসে কাগজ, চকচকে মলাট, আশ্চর্য সোঁদা গন্ধ- লেপের তলায় শুয়ে পড়তে পড়তে মনে হল, এই গন্ধ এই অক্ষর শুধু আমার হয়ে থাক- প্রায় আড়াই পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে দলা পাকিয়ে খেয়েছিলাম। না তোতাকাহিনী পড়ি নি তখনও।
ইতিমধ্যে স্কুল থেকে পেয়েছি সচিত্র যীশুকাহিনী আর বাংলা বাইবেল- "আমি পর্বতগণের দিকে চক্ষু তুলিব, কোথা হইতে আমার সাহায্য আসিবে/ সদাপ্রভু হইতে আমার সাহায্য আইসে / তিনি আকাশ ও পৃথিবীর নির্মাণকর্তা / তিনি তোমার চরণ বিচলিত হইতে দিবেন না / তোমার রক্ষক ঢুলিয়া পড়িবেন না", বাড়ির আলমারিতে উপেন্দ্রকিশোরের রামায়ণ, মহাভারত, দেবসাহিত্য কুটিরের ছোটোদের ইলিয়াড, ওডিসি। আমাদের মফস্সলের বাড়ি, শীতের রাতে ছাদে খচমচ শব্দ ওঠে, বিড়াল হেঁটে যায়, ঠাকুমা কাশে, বাবাকে ডাকে, মাঠ পেরিয়ে শববাহীর দল ধবনি দেয়- বল হরি হরি বোল! আমার মনে পড়ে, " সুভাগা দেখলেন, গায়েবের মুখে সূর্যের আলো ক্রমেই ফুটে উঠতে লাগল, আর গায়েবীর কালো চুলে চাঁদের জ্যোৎস্না ধীরে ধীরে নিভে গেল। তিনি মনে -মনে বুঝলেন, গায়েবীকে এই পৃথিবীতে বেশিদিন ধরে রাখা যাবে না।" থরথরিয়ে কেঁপে উঠে বলি, মা, আমি ইচ্ছামৃত্যুর বর চাই।
মা কলেজ ফেরৎ গাদা গাদা বই নিয়ে আসে - সঞ্চয়িতা, সুকুমার সমগ্র, উপেন্দ্রকিশোর সমগ্র, ননী ভৌমিক অনূদিত রুশদেশের উপকথা, কেলে ভূতো, ম্যালাকাইটের ঝাঁপি, বুদ্ধিমতী মাশা, পথের পাঁচালি, চাঁদের পাহাড়, হীরা মাণিক জ্বলে, দেড়শো খোকার কান্ড, আরোগ্যনিকেতন, রবিনসন ক্রুশো , টম ব্রাউন্স স্কুল ডেজ, ট্রেজার আইল্যান্ড, রাজকাহিনী, দক্ষিণের বারান্দা , ঘরোয়া, সকালবেলার আলো, এণিড ব্লাইটন, আগাথা ক্রিস্টি, টিনটিন সব কখানা- আলমারি উপচে, টেবিল উপচে ছাদ অবধি উঠে গেল বইএর পাঁজা- মা, এত বই আমি রাখি কোথায় এখন?
মা আলমারি খুলে বের করছে বাঁধানো আনন্দমেলা, বলছে, " ব্যালান্স হারাসনি কমল , ব্যালান্স হারাসনি" । আমি আলমারির সামনে থেবড়ে বসে পড়ছি- "কমল উঠে দাঁড়াল। কোনও দিকে না তাকিয়ে মুখ নিচু করে সে মাঠের মাঝে সেন্টার সার্কেলের মধ্যে এসে দাঁড়াল। আকাশের দিকে মুখ তুলল। অস্ফুটে বলল, আমি যেন কখনও ব্যালান্স না হারাই। আমার ফুটবল যেন সারা জীবন আমাকে নিয়ে খেলা করে।" তারপর পড়লাম, "ছুটে বাইরে যেতে গিয়ে থমকে গেলাম। তার পর ফুলগাছগুলোর মধ্য দিয়ে রেলিং-এর ধারে গিয়ে বাইরে তাকালাম। একটা তুবড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। ক্রমশ আলোর ঝাড় চালচিত্রের মতো ছড়িয়ে পড়ল। দেখতে পেলাম, অনেক লোকের মধ্যে একজনের কপালে চিকচিক করছে একটা টিপ। অত্যন্ত উজ্জ্বল, মর্যাদাবান।"
মা আমার হাতে তুলে দিচ্ছে অসময়, ভুবনেশ্বরী, বালিকা বধূ আর খড়কুটো। মৃত্যু আমার পিছু ছাড়ে না-"অনাবিল জ্যোৎস্না মাথার ওপর, চারপাশ নিঃশ্ব্দ, নির্জন; রাশি-রাশি জোনাকি উড়ছে ঝোপের মধ্যে, আর আমার মা পুরু শ্যাওলার তলায় ডুবে শুয়ে আছে, যেন এতকাল মা যে-শয্যায় শুয়ে এসেছে সেটা মার নিজের মনোমতন হয় নি, এই শ্যাওলার শয্যা, জলজ লতাপাতার আবরণ , ঝোপঝাড়ের নির্জনতা, আকাশ থেকে ঝরে পড়া জ্যোৎস্না মার মনোমত হওয়ায় মা অকাতরে ঘুমিয়ে পড়েছে। পাথরের ওপর রাখা মার ছোট্ট মাথাটি এক আশ্চর্য জলপদ্মের মতন ফুটে ছিল"।
ন্যাপথালিনের গন্ধে ভরা দিদার আলমারিতে যতেক সাহিত্য সংখ্যা আর অমৃত। সাহিত্য সংখ্যায় লেখকদের ছবি , সঙ্গে কী লিখি কেন লিখি; দিদার বাড়ির ছাদে কড়ি বর্গা, তার তলায় মস্ত আয়না , সোফা, উঁচু বারান্দায় টবে স্নেক প্ল্যান্ট-তার ডগায় ডিমের খোলায় রং করে মানুষের মুখ এঁকেছে দিদা, সাড়ে তিনটে বাজলেই কোয়ালিটির চকলেট বার আইসক্রীম আসবে, জলচৌকিতে বসে আমি আর বোন বাক্স খুলে গন্ধ নেব, কাঠিশুদ্ধ চেটে ফর্সা করে দেব তারপর খেলতে শুরু করব- মোটা ফ্রেমের চশমা, কলম কামড়াচ্ছেন, আকাশে চোখ- বলত তো কে? তিনটে চান্স মোটে। খেলতে খেলতে পড়া হয়ে গেল বিলু ও ছটি মরচে পড়া আলপিন। আমি বলছি, মা, বিলু কে?
মা বলছে, জাগরী আর ঢোঁড়াইচরিতমানস পড়তেই হবে। তারপর অমিয়ভূষণ পড়বি। আলমারির নিচের তাকে সব তোলা রইল। দিদার বাড়ির সোফায় বসেই শারদীয় সংখ্যায় ফেলুদা শেষ করে লুকিয়ে পড়েছি 'বড়দের' উপন্যাস- বিজন বিভুঁই, মহাকালের রথের ঘোড়া।
মনীষা এসে বলেছিল, " সোনার মাছি খুন করেছি।" সুমনা, মুনমুন বলেছিল, কলকাতার যিশুর কথা, হস্টেলের কবিতার কথা। আমাদের কবিতা পড়া শুরু হয়ে গিয়েছিল; বঙ্গলিপির পিছনের পাতায় লিখে রেখেছিলাম, "ক্ষত বক্ষস্থল মম দেখো নৃপমণি, হের পৃষ্ঠে মোর নাহি অস্ত্র লেখা"।
সাপ্তাহিক দেশে বেরোচ্ছিল কালবেলা , আমাদের জগৎ তখন অনিমেষ, মাধবীলতা ময়- রেলব্রিজ পেরিয়ে অনিমেষের কাছে আসছে মাধবীলতা-সেই মেয়ে যার মুখ সহস্র পদ্মের মত উজ্জ্বল। আমাদের মফস্বলের রেলব্রিজে এই সব মুখ আমরা খুঁজে ফিরতাম। মনে মনে এক দাড়িওলা তরুণের নাম দিয়েছিলাম অনিমেষ। পরে সে বধূহত্যায় জেল খেটেছিল।
এবার বইয়ে চড়ে একটা মস্ত হাসপাতাল আসার পালা, তার কাচের দরজা, সামনে দাঁড়ালে আপনা থেকে খোলে। বাইরে প্রখর রোদ, কাচ দরজার ভেতরে এসি চলে সর্বক্ষণ- ভিতরে এলেই চশমার পরকলায় ঘনীভবন অনিবার্য - তখন সব ঝাপসা। সেইখানে আমি ঠায় বসে থাকব ধাতব বেঞ্চে, আশে পাশে রোগগ্রস্ত মানুষ, তাদের আত্মীয়স্বজন। এলিভেটর উঠবে নামবে, টেলিভিশনের ফ্ল্যাট স্ক্রীনে সংবাদপাঠিকার ঠোঁট নড়ে যায় শুধু; এইখানে চতুর্থ তলে যে লড়ছে মৃত্যুর সঙ্গে, আমার হাতে তারই দেওয়া বই, তার শেষ উপহার- কবির বৌঠান।
একদিন আমি বই মুড়ে ফেলব। তাকে চারতলায় ফেলে রেখে সাগর পেরিয়ে চলে যাব।
শুধু একটা বড় উঠোনে টানা দড়িতে আমার স্মৃতি বইস্মৃতি টাঙানো থাকবে , ক্লিপের বদলে সেখানে বসে রং বেরঙের কিচিরমিচির- বুদ্ধিমতী মাশা তাদের পাহারায়। আমি ডাউনের পথ ধরব।