প্রথম বাংলা বর্ণ পরিচয় আমার হয়েছিল সীতানাথ বসাক প্রণীত আদর্শ লিপির হাত ধরে। তখন আমার বয়স সাত, সবে ইংরেজি মাধ্যম ছেড়ে বাংলায় পড়াশোনা শুরু করেছি। মহা উৎসাহে বানান করে করে বাংলা পড়ি। কিন্তু আমাকে নিয়ে সমস্যা হলো, আমি পাঠ্যবই পড়ি না, পড়ি গল্পের বই, তখনকার ভাষায় আউট-বই।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক শওকত ওসমান বলতেন, 'ভাত খেতে ব্যঞ্জন লাগে' —
ভাত, পাঠ্যবই। ব্যঞ্জন হলো আউট-বই। বরাবর ভাতের চেয়ে ব্যঞ্জনের প্রতি আমার আকর্ষণই বেশি ছিল। বই পড়ার নেশা এমন ছিল যে, ওইটুকু বয়সেই কোনো কোনোদিন পড়তে পড়তে রাত শেষে ভোরের আযান শুনতে পেতাম। সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলে নিয়মিত মার কাছে বকুনি বরাদ্দ ছিল। ক্লাসে গিয়েও ঝিমাতাম। সে সব দিনে ঠাকুরমার ঝুলির— সাত ভাই চম্পা, আম সন্দেশ, দুধের সাগরে আমি মগ্ন। রাশিয়ান রূপকথার রঙিন ঝকঝকে ছবির বই শেষ করে রাশিয়ান, ইউক্রেন ও উজবেকিস্তানের উপকথার অনবদ্য সব অনুবাদ গোগ্রাসে গিলছি। নীল দস্তানা, সিভকাবুর্কা, বিখ্যাত সেই ‘গোল রুটি’র গল্প– ছোট্ট গোল রুটি, চলছি গুটিগুটি…এইসব ছেড়ে কি ঘুমানো যায়!
একদিন বাবার কাছে ধরা পড়ে গেলাম। বাবা বললেন, 'রাত জেগে, অল্প আলোয় বই পড়া ঠিক না, চোখ নষ্ট হয়ে যাবে।' কিন্তু কোনো নেশাই তো সহজে ছাড়া যায় না। এরপর ধরা পড়ার ভয়ে বাথরুমে বসে বই পড়তাম। বই পড়ার নেশা আজও কাটেনি। আর রাত জাগার বদভ্যাস এখনো যায়নি। আমার এই আবাল্য বইপ্রীতি আমাকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনুরাগী করে তোলে। বাবার ইচ্ছা ছিল আমি চিকিৎসক হই, কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকের পর বিজ্ঞানের পাট চুকিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি।
একটা সময় বাঙালি পরিবারে অবসরের সঙ্গী ছিল বই। সেকালে বিনোদনের অত সুযোগ ছিল না। ছিল রেডিও, হলে গিয়ে সিনেমা দেখা, যাত্রা কিংবা মাঠে গিয়ে খেলা দেখা, এই তো! তখনকার দিনে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তের বাড়িতে অন্যান্য আসবাবের সঙ্গে একটি বইয়ের আলমারিও শোভা পেত। বাড়ির বড়োরা সারাদিনের কাজ শেষে অবসরে বই নিয়ে বসতেন। মাকে দেখেছি দুপুরে খাবারের পর আমাকে আর ভাইকে নিয়ে বিছানায় যেতেন। মাঝে মাঝে ছোটোদের গল্পের বই থেকে পড়েও শোনাতেন। কিন্ত বেশির ভাগ সময় নিজেই বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়তেন। এই সুযোগে আমি আর ভাই পা টিপে খাট থেকে নেমে পালিয়ে যেতাম। ভাই ছুটত ফুটবল নিয়ে মাঠে। আর আমি মায়ের কাচের আলমারি থেকে বই নিয়ে চলে যেতাম নামাজের ঘরে। জানি এই সময়টায় এ ঘরে কারো আসার সম্ভাবনা নেই। আলমারিতে থরে থরে সাজানো বইয়ের মাঝে প্রথমে কপালকুণ্ডলা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের কঠিন ভাষা কিছুই বুঝলাম না, তবে বানান করে করে একটি বাক্য খুব ভালো লেগেছিল— "তিনি অতি মৃদুস্বরে কহিলেন, 'পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?'
পরবর্তীতে অনার্স প্রথম বর্ষে আমার পাঠ্যবই ছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'কপালকুণ্ডলা'। আজও বলতে পারব না এমন দুর্বোধ্য বইটি আমার ওই বয়সে কেন ভালো লেগেছিল!
তখনকার দিনে গল্পের বই অর্থাৎ আউট-বই পড়া রীতিমতো বখে যাওয়ার লক্ষণ ছিল। সে সময়ে পড়ার বইয়ের নীচে লুকিয়ে গল্পের বই পড়ে নাই, এমন ছোটোবেলা খুব কম মানুষেরই কেটেছে!
পঞ্চাশ বছর আগেও অবসর ও মননের সঙ্গী ছিল বই। বাড়ির শিশুরা বইয়ের মধ্যেই বড়ো হত। বড়োদের হাতে বই দেখে, বড়োদের মুখে গল্প শুনে শুনে। এখন ধীরে ধীরে বইয়ের সেই জায়গাটি দখল করে নিচ্ছে ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম, গুগল আর ইউটিউব। ইন্টারনেট পৃথিবীর সমস্ত তথ্য নিমিষে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়। যেখানে সহজে একটা ক্লিক করে সব তথ্য পাওয়া যায় তখন কে আর কষ্ট করে লাইব্রেরিতে গিয়ে বই খুলে পড়তে যাবে! ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় বইয়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে আমাদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েই গেল। অনেক সময় দেখি বন্ধুরা আড্ডায় একসঙ্গে বসেও মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। গেজেটের গতিময় জীবনপ্রবাহে মানুষের ব্যস্তময় জীবনে অন্যান্য সামগ্রীর মতো বই কোনো অপরিহার্য সামগ্রী তো আর নয়! শপিংমলগুলোতে যে পরিমাণ বুটিক, ব্যবহারিক পণ্যের দোকান, রেস্তরাঁ দেখা যায়, একটিও কি বইয়ের দোকান চোখে পড়েছে? কারণ বইয়ের চাহিদা নেই। সব দেশেই শহরগুলোতে পুরানো বইয়ের দোকান থাকে। আমাদের দেশে নেই। যেখানে নতুন বই বিক্রি হয় না সেখানে মানুষ পুরানো বইয়ের দোকান করে কেন আর অর্থ ও সময়ের অপচয় করবে? তবে ফুটপাত কিংবা কিছু কিছু বইয়ের দোকানে পুরানো বই রাখতে দেখেছি। আমি নিজে কয়েকটি দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহ করেছি ফুটপাত থেকে। খুবই দুঃখজনক অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির সখের ব্যক্তিগত বইয়ের সংগ্রহ মৃত্যুর পর বাড়ির লোকেরা ফেরিওয়ালার কাছে সেরদরে বিক্রি করে দিয়েছে। এ আর নতুন কী! বই নষ্ট করা, পুড়িয়ে ফেলা এত অনেক পুরানো শত্রুতা।
আব্বাসীয়দের রাজত্বের সময় প্রতিষ্ঠিত ‘দ্য হাউজ অব উইজডম’ প্রায় ১০০ বছর পর্যন্ত ইসলামিক বুদ্ধিবৃত্তির উপকেন্দ্র এবং অ্যাকাডেমি বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু ১২৫৮ সালে মঙ্গোলীয়রা এটি ছিনিয়ে নেওয়ার পর অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই এবং পাণ্ডুলিপি ছিঁড়ে টাইগ্রিস নদীতে ভাসিয়ে দেয়। বিখ্যাত গণিতবিদ ও বীজগণিতের আবিষ্কারক আল-খারেজমি এবং দার্শনিক আল-কিন্দির মতো মানুষদের লেখা বই ছিল এই লাইব্রেরিতে। এখনো কথিত আছে, ছিঁড়ে ফেলা বইয়ের পাতার কালিতে সে সময় পুরো নদীর পানি কালো হয়ে গিয়েছিল!
দক্ষিণ এশিয়ার ভারতের বিহারে অবস্থিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১০৮৮ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নয় তলা লাইব্রেরিটি পরিচিত ছিল ‘ধর্মগুঞ্জ’ বা ‘সত্যের পর্বত’ নামে। এই নামে ডাকার কারণ হলো এটি অন্যান্য সাহিত্যের সঙ্গে বৌদ্ধ সাহিত্যের সবচেয়ে সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা। আনুমানিক ১২০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বখতিয়ার খিলজির নেতৃত্বে মুসলমান মামলুক বাহিনী নালন্দা লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে।
নিরীহ বইয়ের উপর অযথা আক্রোশ বহুবার নানাভাবে হয়েছে। লেখক ল্যু আন্দ্রিয়াস-সালোমের সঙ্গে ফ্রয়েডের আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। সালোমের মৃত্যুর পর জার্মানির গেস্টাপো বাহিনী তাঁর বাড়ির লাইব্রেরি তছনছ করে ইহুদি সম্প্রদায়ের সব বই নিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। এমন অনেক দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতায় রয়ে গিয়েছে। (তথ্যসূত্র উইকিপিডিয়া)
"মোদের গরব মোদের আশা, আ–মরি বাংলাভাষা"
এই বাক্যটি কি শুধু মাত্র বছরের একটি মাস, ফেব্রুয়ারিতে সীমাবদ্ধ থাকবে? প্রতিবার একুশের বইমেলা শেষে এই প্রশ্নটি আমার মনে জাগে। আশঙ্কা জাগতেই পারে তাহলে বইয়ের দোকান, বই বাজার, বই মেলা কি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে?
কিন্তু আমি এখনো পুরোপুরি হতাশ নই। যাঁরা মননশীল পাঠক, যাঁরা বইয়ের জগতে মানসিক তৃপ্তি পান তাঁরা ঠিকই তাঁদের পছন্দের বইটি খুঁজে নেন। তাঁদের বইপ্রীতি বা বই নিয়ে আগ্রহ কখনোই কমে না। আগ্রহীরা অনলাইনে অতিরিক্ত মূল্য দিয়েও বই সংগ্রহ করেন। বইবিপনির সেভাবে প্রসারণ না হলেও বই মেলায় বাঙালির ভিড় দেখে মনে হয়, বই প্রেমিকের অভাব নেই। একুশের বই মেলায় বাবা-মা তাঁদের শিশুদের হাত ধরে বা কোলে করেও বইমেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বই দেখছেন, বই কিনছেন। মেলায় ছুটির দিনে আয়োজন করা হয় ‘শিশু প্রহর’। সকাল থেকে শিশুরা মেলা চত্বরে ভিড় জমায়। বিভিন্ন বয়সের শিশুরা স্টলে ঘুরে ঘুরে নিজেদের পছন্দের বই কেনে। বইয়ের জগৎ এতটাই বর্ণময় জীবন্ত যে বই থেকে দূরে থাকা সত্যি কঠিন। ইন্টারনেট প্রয়োজনে যতই পাশে থাকুক না কেন বই পড়া থেকে নিজেকে বিরত রাখা যায় না। এখনো ঈদ, পূজার আনন্দের অন্যতম উপকরণ, ঈদসংখ্যা, পূজাসংখ্যার অপেক্ষায় থাকি। আসলে নেশাটা ছোটো থেকেই পেয়ে বসেছিল।
জোসেফ ব্রডস্কি একটু শক্ত করে বলেছেন — "বই পোড়ানোর চেয়েও গুরুতর অপরাধ অনেক আছে। সেগুলোর মধ্যে একটি হলো বই না পড়া।"