সব মানুষেরই কিছু না কিছু বিশ্বাস আছে, সেই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে কাটে একটা গোটা জীবন। আমারও তেমন কিছু বিশ্বাস আছে যেগুলো জীবন ভর বয়ে নিয়ে যাব বলেই আমি মনে করি। বই পড়তে চিরকাল খুব ভালোবাসি আমি। আর বিশ্বাস করি বই চিরকাল আমাদের গল্প বলে, সে কবিতা হোক অথবা গল্প।
আমার এই বিশ্বাস জন্মাতো না যদি না আমার মাকে দেখতাম। আমার মা তখনও স্কুলের শিক্ষিকা পদের চাকরি পাননি একটা গোটা দুপুর উনি বই পড়তেন। সেখান থেকে গল্প বলতেন আমাদের। সেই গল্প, আমাদের গল্প; আমাদের হাসি; আমাদের কান্না। কান্না বলতে গিয়ে একটা কথা বলতেই হবে, একদিন আমি আর আমার ছোটবোন পড়তে বসে খুব গল্প করছি। মা অনেক ক্ষণ ধরে আমাদের পড়ানোর চেষ্টা করছেন শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিলেন। তারপর কাজী নজরুলের একটা কবিতা পাঠ করতে শুরু করলেন। আমি আর আমার বোন খেলেই যাচ্ছি, শুনছি না ওঁর কথা। হঠাৎ দেখলাম আমার মা কাঁদছেন আর একটা লাইন খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন,
'ক্ষুদাতুর শিশু চায়না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন
বেলা বয়ে যায়,খায় নিক বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন!'
আমরা দু বোন খেলা বন্ধ করে দিলাম, মা কবিতা পাঠ করলেন আর আমরা শুনলাম। দুদিন পর আমাদের বাড়ির সামনে এক মা এলেন দুটো ভাতের জন্য। কে বলে গল্প লেখা বাহুলতা, ও তো আমাদেরই কথা। এবার বিশ্বাস মজবুত হলো আরও। পরে মা শিক্ষিকা পদে যোগদান করেছেন। বাচ্চাদের স্কুলে পড়ান। এখনও পূজো সংখ্যা ঠিক আসে। মা পড়েন। নিজের মতামত খুব পরিষ্কার ভাবে জানান আমাদের, আমরা শুনি।
বই নিয়ে যে আড্ডা হয়, তর্ক হয়, ঝগড়া হয় সেটা আমি আর একজনের কাছে দেখেছি। উনি আমাদের পারিবারিক বন্ধু। সম্পর্কে আমার মামা। ওনাকে আর মাকে দেখতাম গল্পের বই কে কখন পড়বেন তা নিয়ে ঝগড়া চলছে। আবার কখনো কোন চরিত্র কার বেশি পছন্দের সেই নিয়ে ঝগড়া। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওদের মতের অমিল থাকবে। আর ঝগড়া এমন পর্যায়ে পৌঁছাতো শেষ পর্যন্ত আমার বাবুকে সমাধান করতে হতো। আমার বাবুকে(বাবা) দেখতাম উনি মা এবং মামার ঝগড়াটা খুব উপভোগ করছেন। আবার কখনো মামার মা, যাঁকে আমরা দিদা বলতাম, সেই দিদাও আসতেন সমাধানে। সমাধান তো দূরের কথা তিনি এসে আবার গল্প শোনাতেন। মা খুব আনন্দ করে চা করে দিতেন। চা, জল খেয়ে দিদা বাড়ি ফিরে যেতেন। মজার বিষয় হলো দিদা বাড়ি যাওয়ার পরেই আবার মা এবং মামা সেই পুরনো ঝগড়ার ছুতো ধরে নতুন করে ঝগড়া শুরু করতেন। এখন ওরা দুজনে আলাদা আলাদা স্কুলে পড়ান কিন্তু কারণে অকারণে ঝগড়া আজকেও লেগে আছে। আমিও আমার বন্ধুদের সাথে বই নিয়ে তর্ক করি ঝগড়া করি আবার গোটা গোটা উপদেশও ঝাড়ি। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে ওরা আমার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দেয় কিন্তু আমি থামি না।
এই গল্প বলার কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ছে, আর একজনের গল্প আমি খুব ভালবাসি শুনতে উনি আমার দিদা, মায়ের মা। ছোটবেলায় যখন উনুনের ধারে বসে তরকারিতে ফোড়ন দিতে গিয়ে গল্পের খেই হারিয়ে ফেলতেন আমাদের প্রশ্ন থাকতো, 'তারপর?' উনি ফোড়নের থালা নামিয়ে আবার শুরু করতেন। সেখানেও দেখতাম সব গল্প যেন আমাদের কথা বলে। আমার, আপনার গল্প। আমরা সব ভাইবোনেরা সেই সব শুনতাম চোখ বড়ো করে।
চোখ বড়ো নিয়ে কথা বলছি অথচ আমার বড়োমাসির কথা না বললে কি করে চলে। আমার বড়োমাসি খুব শান্তি প্রিয় মানুষ। আমার মামা বাড়ির যে কোনো অনুষ্ঠানে উনি বসে পড়তেন আমাদের নিয়ে, গল্প শোনাতেন । বাড়ির সব বাচ্চারাই তখন ওর কাছে হাজির। এখন যখন কোনো অনুষ্ঠানে আমি হাজির হই বাড়ির সব বাচ্চাদের আমার কাছে হাজির করা আমার প্রধান কাজ। এইভাবেই তো গল্প আমাদের রোজদিনের বেঁচে থাকার রসদ যোগায় তাই না?
এমন করে গল্প শুনতে শুনতে একদিন গল্প পড়তে শুরু করলাম। প্রথম প্রথম ছোট ছোট গল্প । দশম শেষ করতে করতেই শরৎচন্দ্র প্রথমখণ্ড প্রায় শেষ করে ফেলেছি। শুধু আটকে গেছি 'অরক্ষণীয়া'র সামনে। আবার এক বিশ্বাসের জন্ম হলো, ভালবাসার মানুষ ছেড়ে যায়না কক্ষনো। ঝগড়া হয়, বিবাদ হয়, মুখ দেখাদেখি বন্ধ, কিন্তু তাও ছেড়ে যায় না কক্ষনো। সেই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে আর একটু পথ চলা।
দেখতে দেখতে বাংলা নিয়ে স্নাতকোত্তর শেষ। ভালোবাসা, হাসি, আনন্দ সব নিয়ে বেশ আছি। বলা ভালো মেতে আছি কিন্তু এভাবে তো জীবন চলবেনা নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। হাজার ভাবনা চিন্তা নিয়ে যখন জ্বরাক্রান্ত, বড়ো মামার পক্ষ থেকে তখন হাতে এলো ম্যাক্সিম গোর্কি’র “মা”। বড়োমামা প্রতি জন্মদিনে আমায় একটি করে গল্পের বই উপহার দেন।
“মা” পড়া শেষ হতে বুঝলাম ঘুরে দাঁড়ানোর আর এক নাম জীবন। কে বলেছে গল্প লেখা বাহুলতা। সে তো আমাদের জীবনের অংশ। আমাদের জীবনের বেঁচে থাকার গল্প। তাই তো আজও বিশ্বাস করি বই জীবনের গল্প বলে, আমাদের গল্প বলে আমাদেরকেই।