২০১২ সাল। ডিসেম্বর। আমার সোলো ফটো এক্সিবিশন চলছে দুবনার এক কালচারাল সেন্টারে। “ছোটবেলায় ফিরে যাওয়া” নামে এই প্রদর্শনীর ১০৯ ছবির সবগুলোই ছিল বাংলাদেশে তোলা। দীর্ঘ ১৪ বছর পরে দেশে ফিরে চেষ্টা করেছিলাম ফেলে যাওয়া দেশ, ফেলে আসা সময় ক্যামেরায় বন্দী করতে। কিন্তু এর মধ্যেই দেশ অনেক বদলে গেছে। তাকে আর কখনই ফিরে পাওয়া যাবে না।
দুবনায় বিভিন্ন পত্রিকার সাথে বাচ্চাদের জন্যও একটা পত্রিকা বেরোয়। “জীবন্ত টুপি” তার নাম। সেখানে সবাই স্কুলের ছেলেমেয়ে, মূলত প্রাইমারী স্কুলের। ওরাই লেখে, ছবি আঁকে, ইন্টারভিউ নেয়। তাই এটাকে পত্রিকা না বলে ভবিষ্যৎ সাংবাদিক হওয়ার স্কুল বলা যায়। তাতিয়ানা রোমানভা একজন ফটোগ্রাফার। সে থেকেই পরিচয়। আর তিনিই “জীবন্ত টুপি”র প্রধান।
আমরা জীবনে অনেক কাজ করি, কিন্তু ঠিক কেন যে করছি সেটা নিয়ে ভাবি না। আমরা পাঠ্য বই কেন পড়ি সেটা জানি। হ্যাঁ, বই পড়ে আমরা কেউ ডাক্তার হতে চাই, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বা অন্য কিছু। খুব কম মানুষই জ্ঞান অর্জন করতে চায়। ভাবখানা এই যে পড়লে জ্ঞান অর্জন এমনিতেই হবে আর লক্ষ্য হবে অন্য কিছু। সেক্ষেত্রে কেন গল্পের বই পড়ি সেটা আমরা প্রায় কেউই জানি না। অনেক বাবা মা তো মনেই করেন গল্পের বই পড়ে বাচ্চারা সময় নষ্ট করে। পড়ার বইয়ের বাইরে যে কিছু পড়া যায়, জ্ঞান অর্জন করা যায় সেটা তারা ভাবেনই না। তারা চান পরিক্ষার নম্বর, এসব তো নম্বর আনে না।
সেই এক্সিবিশনের সময় তাতিয়ানা আমার ইন্টারভিউ নিতে চাইল। সময় ঠিক হল। ও ক্লাবে এলো।
- তুমি কেন ছবি তোলো?
সত্যি বলতে আমি এ প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কেন ছবি তুলি? পেশাদার ফটোগ্রাফার হলে বলতে পারতাম “এটা আমার পেশা। জীবিকা অর্জনের জন্য।” কিন্তু সেটা তো ঠিক নয়। আমি শৌখিন ফটোগ্রাফার। তাহলে? যেহেতু রুশ আমার মাতৃভাষা নয়, তাই সেই সুযোগ নিলাম, মানে তাড়াহুড়ো না করে ধীরে ধীরে উত্তর দিতে শুরু করলাম।
- দেখ, ১৯৮৩ সালে আমি যখন মস্কো আসি তখন থেকেই ছবি তুলি। উদ্দেশ্য ছিল যখন দেশে ফিরব তখন এই ছবি দেখে মস্কোর কথা, মস্কোর বন্ধুদের কথা মনে করব। তাই বলতে পারো আমি ছবি তুলি অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে আমার অতীতকে ফিরে দেখার জন্য, অতীতে ফিরে যাওয়ার জন্য। আমি যখন ছবি তুলি তখন কেউ না কেউ আমার সাথে থাকে। ছবির ভেতর দিয়ে আমি তাদের ফিরে পাই। ফিরে পাই সেই সময়, সেই পরিবেশ। যেমন এখন সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই অথচ আশির দশকে তোলা যেকোন ছবি আমাকে সেই দেশে, সেই সময়ে, সেই ইউনিক পরিবেশে নিয়ে যায়।
- শুধু এ কারণেই?
- না। মানুষের জীবনে অনেক ঘটনাই ঘটে। আমিও এর বাইরে না। কিছুদিন আগেও আমি ঘর ভরা ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার করতাম। ওরা এখন মস্কো চলে গেছে। প্রায়ই ওদের অভাব অনুভব করি। বড় একা লাগে। আর তখনই ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। যাই বনে ঘুরতে বা ভোলগার তীরে। সুতরাং আমি ছবি তুলি আমার একাকীত্বকে নানা রঙে রাঙিয়ে তুলতে, একাকীত্ব দূর করতে।
- বেশ মজার তো। আরও কিছু?
- ছাত্রজীবনে যখন একা থাকতে মন চাইত চলে যেতাম হোস্টেলের পেছনের বনে অথবা লোকে লোকারণ্য আরবাত স্ট্রীটে। ওখানে তিল ফেলার জায়গা নেই, কিন্তু তুমি কাউকে চেনো না, কেউ তোমাকে চেনে না। এই বিশাল জনারণ্যেও তুমি একা। আজকাল প্রায়ই মস্কো যাই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। বন্ধুদের সাথে দেখা হয়। যখন এত মানুষের মধ্যে একটু নিজের সাথে থাকতে ইচ্ছে করে ক্যামেরা হাতে নিয়ে এসব মানুষদের ছবি তুলতে শুরু করি। ওরা আর বিরক্ত করে না। তাই যখন নিজেকে একান্ত ভাবে পেতে চাই তখনও ছবি তুলি।
- আর?
- দেখ, আমি পদার্থবিদ। থিওরি নিয়ে থাকি। চাই বা না চাই, সব সময় ওসব মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। কিন্তু যখন ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ লাগাই এসব কিছুই মনে থাকে না, পৃথিবীটাকে দেখতে পাই। হ্যাঁ, বাস্তবতাকে অনুভব করার জন্যেও ছবি তুলি।
- খুব ভাল। আমি ভাবিইনি যে তুমি এতগুলো উদ্দেশ্য নিয়ে ছবি তোলো।
- সত্যি বলতে কি, আমি নিজেও ভাবিনি। ছবি তুলেছি বা তুলি মনের আনন্দে। তুমি জিজ্ঞেস করলে। উত্তর খুঁজতে গিয়ে এসব পেলাম। তবে এটা ঠিক আমি যদি এই লক্ষ্যগুলো সামনে রেখে ছবি তুলতে শুরু করতাম, তাহলে হয়তো ছবি তুলে এখন যে আনন্দ পাই সেটা পেতাম না আর তা হলে ছবিগুলো মনের মতো হতো না, তাতে প্রাণ থাকত না। সেটা হবি না হয়ে ডিউটি হয়ে যেত।
মনে আছে স্কুল জীবনে একটা রচনা ছিল – হবি। অনেকেই হবি হিসেবে বই পড়া উল্লেখ করত। তবে সেটা ছিল গৎ বাঁধা রচনা, ঠিক যেমন জীবনের লক্ষ্য হিসেবে ডাক্তার হওয়া। বরাবরই আমার ঘরে অনেক বই থাকে। তার একটা বিরাট অংশ অবশ্য পদার্থবিদ্যা আর গণিতের বই। গল্পের বইয়ের সংখ্যাও কম নয়। একবার কে যেন জিজ্ঞেস করল এই যে এত বই পড় তাতে কি হয়? কোন দিন এভাবে ভাবিনি। আসলে বই পড়েছি পড়ার আনন্দে - অন্য দেশ, অন্য সময়কে কিছুটা হলেও জানার জন্য। তখনই মনে হয়েছে ছবির কথা। একটু ভেবে দেখেছি ছবি যেমন আমাকে অতীতে ফিরিয়ে নেয়, আমার একাকীত্বকে রাঙিয়ে তুলে আবার নিজের মধ্যে হারিয়ে যেতে সাহায্য করে – বইও ঠিক সেটাই করে। বই আরও বেশি যেটা করে তা হল অনেক কিছু শেখায়। বইয়ের মধ্য দিয়ে আমরা কোন ব্যাপারে অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে পারি। তার সাথে আমরা একমত হতে পারি আবার নাও হতে পারি, কিন্তু কোন ঘটনা যে অন্য ভাবে দেখা যায়, অন্য ভাবে ভাবা যায়, আমাদের দেখা জীবনের বাইরেও যে আরেকটা জীবন থাকে সেটা জানতে পারি। একই ঘটনা ঘটে অন্যদের তোলা ছবি দেখে। পরিচিত জিনিস অপ্রত্যাশিত রূপ নেয়। তাছাড়া সময়ের সাথে আমাদের পড়ার বিষয় বদলায়, বদলায় প্রিয় লেখকের তালিকা। এমনকি আগে যে বই পড়ে আনন্দে আত্মহারা হয়েছি এখন সেটা পড়ে বিশাদগ্রস্থ হই। কোনো কোনো বই আর পড়তে পারি না। আবার আগে যে বই শুরু করেও শেষ করতে পারিনি এখন সেটা অনায়াসে পড়ি। এভাবে বইয়ের মাধ্যমে আমরা নিজেদের বিবর্তনকে দেখতে পাই।
জালাল উদ্দিন রুমীর ভাষায় “সব কিছু জেনে ফেলাই জ্ঞান নয়, জ্ঞান হলো কী কী এড়িয়ে যেতে হবে বা বর্জন করতে হবে তা জানা।” এটা আমাকে ফটোগ্রাফির কথা মনে করিয়ে দেয় এখানেও মূল কথাটা হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় বস্তু বাদ দেওয়া। বই যদি লেখা হয় অক্ষরে ছবি তোলা বা আঁকা হয় রং তুলি আর ক্যামেরা দিয়ে তবে উভয় ক্ষেত্রেই যেটা অনিবার্য তা হল ইমাজিজেশন, ফ্যান্টাসি, কল্পনা। হয়তো এ কারণেই যখন কেন বই পড়ি সেই প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম, মনে পড়ে গেল ছবির কথা। হয়তো সব ধরণের ক্রিয়েটিভ হবির পেছনের কারণগুলো একই রকম।