বাংলাদেশের জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা: অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে একটি আলোচনা
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এবং বাংলাদেশের সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সাথে নিউ ইয়র্ক টাইমসের ক্লাইমেট ফরোয়ার্ড ইভেন্টের সাক্ষাৎকার।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর ক্লাইমেট ফরোয়ার্ড ইভেন্টে একটি সাক্ষাৎকার দেন। ইউটিউবের সেই সাক্ষাৎকারটির একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ অনুবাদ করা হলো। অনুবাদ করেছেন রিটন খান।
বাংলাদেশের জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা: অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে একটি আলোচনা
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এবং বাংলাদেশের সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সাথে নিউ ইয়র্ক টাইমসের ক্লাইমেট ফরোয়ার্ড ইভেন্টের সাক্ষাৎকার।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী (সোমিনী গুপ্তা):
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং আমাদের ক্লাইমেট ফরোয়ার্ড ইভেন্টে আপনাকে আন্তরিক স্বাগতম। আপনি এই সময়কে একটি বিপ্লবী পরিবর্তন হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আপনি দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি, এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার কাজ করছেন, যখন একই সময়ে একটি জলবায়ু সংকট মোকাবিলা করছেন। এমন একটি বড় চ্যালেঞ্জ আপনি কীভাবে সামলান, এবং এর জন্য কী বাংলাদেশের সমৃদ্ধির পদ্ধতির পুনঃবিবেচনা প্রয়োজন?
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস:
প্রশ্নটির জন্য ধন্যবাদ। আমাদের সরকারের মূল লক্ষ্য সংস্কার। আমরা একটি ভাঙা অর্থনীতি, ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান এবং নীতিগুলি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। সুতরাং, পুরোনো পদ্ধতিতে ফিরে না গিয়ে, আমরা নতুন করে শুরু করতে চেয়েছি। সংস্কার আমাদের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োজন, অর্থনীতি থেকে শুরু করে সরকার এবং পরিবেশ পর্যন্ত। আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য কাজ করছি, এবং এর পরেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী:
এই জলবায়ু সংকটের মধ্য দিয়ে কীভাবে আপনি এগিয়ে যাবেন? আপনি দীর্ঘদিন ধরে কার্বন নির্গমন এর সমাপ্তি এবং দারিদ্রহীন একটি সমাজ গঠনের কথা বলে আসছেন। বাংলাদেশে এই ভিশনটি কীভাবে কার্যকর করা সম্ভব?
অধ্যাপক ইউনূস:
আমাদের বর্তমান সভ্যতা স্ব-বিধ্বংসী। আমরা একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করেছি যা লাভ সর্বাধিকীকরণে মনোযোগ দেয়, এবং এটি আমাদের পরিবেশ ও সমাজের প্রতি যে প্রভাব ফেলে তা উপেক্ষা করে। এই ব্যবস্থা কয়েকজনের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত করে, এবং এটি সমাজ এবং পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। আমাদের নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে এবং এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে যা সকলের জন্য কাজ করে, কেবলমাত্র কিছু ব্যক্তির জন্য নয়। আমাদের লক্ষ্য একটি টেকসই ব্যবস্থা তৈরি করা যা মানুষের এবং পরিবেশের উভয়ের মঙ্গল নিশ্চিত করে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী:
অনেক শিল্পোন্নত দেশ তাদের অর্থনীতি জ্বালানি তেল এবং কয়লার উপর ভিত্তি করে গড়ে তুলেছে। কেউ কেউ মনে করেন, উন্নয়নশীল দেশগুলিও তাদের নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার করে একই সুযোগ পাওয়া উচিত। আপনি এই যুক্তির প্রতি কীভাবে সাড়া দেবেন?
অধ্যাপক ইউনূস:
এই যুক্তি ভুল। শুধু তাই নয় যে শিল্পোন্নত দেশগুলি পৃথিবীকে ধ্বংস করেছে, আমাদেরও তাই করতে হবে এমন কোন কথা নেই। বাংলাদেশ কখনোই পরিবেশগত ক্ষতির প্রধান কারণ ছিল না। আমরা অন্যদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আমাদের লক্ষ্য হবে পুরোনো ভুলগুলো পুনরাবৃত্তি না করে, একটি নতুন মডেল তৈরি করা যা পরিবেশের ক্ষতি না করে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী:
বাংলাদেশ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বর্ষা এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে একটি। ধনী রাষ্ট্রগুলো, যেভাবে ঐতিহাসিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হয়েছে, সেই বিষয়টি বিবেচনা করে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর প্রতি তাদের দায়িত্ব কী বলে আপনি মনে করেন?
অধ্যাপক ইউনূস:
ধনী দেশগুলোকে তাদের ভূমিকা স্বীকার করতে হবে এবং দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা তাদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের বোঝা বহন করছি। এটি ন্যায্য নয় যে বাংলাদেশ এর মতো দেশগুলোকে এর খেসারত দিতে হবে। এই দেশগুলোকে আমাদের সহায়তা করতে হবে যাতে আমরা এই চ্যালেঞ্জগুলোর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারি।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী:
আপনি দীর্ঘদিন ধরে বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনায় জড়িত আছেন। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে বিশ্ব একত্রিত হয়ে কার্বন নির্গমন কমানোর একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আপনার মতে, এই চুক্তিটি কার্যকর হচ্ছে, নাকি এটি পুনরায় বিবেচনার প্রয়োজন?
অধ্যাপক ইউনূস:
আমি ছোট ছোট পরিবর্তন নিয়ে আগ্রহী নই। প্যারিস চুক্তি একই ভ্রান্ত কাঠামোর মধ্যে কাজ করছে। আমাদের পুরো সিস্টেমটি পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের অর্থনীতি অপচয়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এবং যতক্ষণ না আমরা এটি মোকাবিলা করি, কোনো চুক্তিই কার্যকর হবে না। লাভ সর্বাধিকীকরণের জন্য আমাদের প্রবৃত্তি পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে এবং আমাদের এটি পরিবর্তন করতে হবে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী:
আপনি একটি নতুন অর্থনৈতিক মডেলের কথা বলেছেন, যা তিনটি জিনিসের বিলোপ্তির কথা বলেছেন—কার্বন নির্গমনের সমাপ্তি, সম্পদ কেন্দ্রীয়করণের সমাপ্তি, বেকারত্বের সমাপ্তি। আপনি কীভাবে এই লক্ষ্যগুলো অর্জনের কল্পনা করেন?
অধ্যাপক ইউনূস:
আমাদের একটি বৈশ্বিক আন্দোলন দরকার, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে, যারা এই তিনটি নীতিগুলিকে গ্রহণ করবে। এটি ব্যক্তিগত দায়িত্বের সাথে শুরু করতে হবে—কার্বন নির্গমন কমানো, অসমতা মোকাবিলা করা, এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করা। তরুণরা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে এবং তারা এই পরিবর্তনের চালিকাশক্তি হতে পারে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী:
প্রত্যাশা নিয়ে বলতে গেলে, জলবায়ু প্রভাবের কারণে অনেক বাংলাদেশি তাদের বাড়িঘর ছেড়ে চলে গেছে। আপনার মতে, জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য কি নতুন নিরাপদ পথ প্রয়োজন?
অধ্যাপক ইউনূস:
যদিও নিরাপদ পথ গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের জাতীয় সীমানার বাইরে চিন্তা করতে হবে। পৃথিবী আমাদের সবার বাড়ি, এবং আমরা সবাই এটি রক্ষা করার দায়িত্বে রয়েছি। জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে সৃষ্ট অভিবাসন একটি বড় সমস্যার লক্ষণ মাত্র। আমাদের সবাইকে একসাথে এর মূল কারণগুলো মোকাবিলা করতে হবে, শুধুমাত্র এর পরিণতিগুলি নিয়ে ব্যস্ত থাকার পরিবর্তে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী:
বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত বিচার ব্যবস্থার অভিযোগ উঠেছে। আপনি নিজেও এর শিকার হয়েছেন। এই রূপান্তরের সময় বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা কীভাবে নিশ্চিত করবেন?
অধ্যাপক ইউনূস:
তরুণদের নেতৃত্বে একটি বড় বিপ্লব হয়েছে, এবং পূর্ববর্তী শাসন অপসারিত হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে একটি নতুন বাংলাদেশ তৈরি করা, যেখানে আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা সকল প্রতিষ্ঠানকে পুনর্গঠন করার জন্য কাজ করছি, যাতে ন্যায়বিচার নিরপেক্ষভাবে কার্যকর হয় এবং কোনো রাজনৈতিক প্রভাব না থাকে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী:
আপনি বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এই পরিবর্তনের সময় কীভাবে একটি ন্যায্য এবং সুষ্ঠু প্রক্রিয়া নিশ্চিত করবেন?
অধ্যাপক ইউনূস:
আমরা ইতিমধ্যেই প্রধান খাতগুলোতে সংস্কার আনার জন্য কমিশন গঠন করেছি, যার মধ্যে নির্বাচন প্রক্রিয়া, বিচার ব্যবস্থা, এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আমাদের লক্ষ্য হলো এই পরিবর্তনগুলো কার্যকর করা, এবং এর পরেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী:
কোনো সম্ভাবনা আছে যে আপনি নির্বাচনে অংশ নেবেন?
অধ্যাপক ইউনূস:
না, আমি নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী নই। আমার লক্ষ্য হচ্ছে পরিবর্তন এবং সংস্কার প্রক্রিয়াকে সমর্থন করা, রাজনৈতিক দল গঠন করা নয়।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী:
অধ্যাপক ইউনূস, আমাদের সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
অধ্যাপক ইউনূস:
ধন্যবাদ।