এক আনাড়ি পাঠকের পাঠ-ভাষ্য
বিপ্লব বিশ্বাস | বিদ্যালয়শিক্ষার মধ্যস্তরের প্রয়োজনে যখন গাঁ ছেড়ে গঞ্জে বাস শুরু হল তখন সেখানে পাওয়া গেল এক সরকারি পাবলিক লাইব্রেরি যার সদস্য করে দেওয়া হল আমার পাঠোৎসুক মাকে আর সেই সূত্রে আমারও নানাবি
গত শতকের ষাটের দশকের গোড়ায় দূরান্তরী এক গণ্ডগ্রামিক বালকের অনিয়মিক পাঠাভ্যাসের সূচনা হয়েছিল ' শিশুসাথী ' জাতীয় শিশু- কিশোর বইয়ের মাধ্যমে, এ কথা স্মরণে আসে, পাঠ- স্মৃতিচারণের অনিবার্যতায়। জ্যাঠামশাই পূর্বরেলের কলকাতা সদর দপ্তরের চাকুরে ছিলেন। বড় পুজোর ছুটিতে যখন দেশের বাড়ি আসতেন, যাবতীয় উপাহৃত সামগ্রীর মাঝ থেকে সগর্বে উঁকি মারত শারদীয় এই ঢাউস পত্রনিচয় যা আমার লক্ষবস্তু ছিল। সব ছেড়ে যথাস্থানে লক্ষ্যভেদ করতে আমি দেরি করতাম না। এভাবেই হয়তো শুরু হয়েছিল। এ ছাড়া তেমন কোনও বনেদ বনিয়াদ উত্তরাধিকার সূত্রে আমাতে অর্শায়নি, বিশেষত কলমচারিতার ক্ষেত্রে। তবে হ্যাঁ, আমার মা ছিলেন গোগ্রাসী পাঠক ( এখনও আছেন, তবে শুধুই টিভি সিরিয়ালের ভক্ষক হিসেবে)। প্রয়াত বাবার সামান্য ভিন্নধর্মী ( অকাল্টিজম জাতীয়) পাঠাভ্যাস থাকলেও জ্যাঠামশাইয়ের মধ্যে তেমন কোনও নিয়ত অভ্যাস দেখিনি। বাবার প্রয়াণের পর অবশ্য সামান্য কাব্যচর্চার প্রমাণ পেয়েছি যা মোটেও উল্লেখযোগ্য নয় - অন্তত উত্তরপুরুষকে প্রভাবিত করতে। তাই লেখালিখির জগতে আমি প্রমথ চৌধুরীর ভাষায় স্বশিক্ষিতই বলা যায়। আমার আমর্ম পাঠানুরাগও অন্তর্গত ভাবরঞ্জিতই আর এ কথায় অতিরঞ্জন আছে বলে মনে করি না। হোর্হে লুই বোর্হেস একবার বলেছিলেন : Sometimes I suspect that good readers are even blacker and rarer swans than good writers. Reading, obviously, is an activity which comes after that of writing. It is more modest, more unobtrusive, more intellectual. ' বিশিষ্ট সাহিত্য - তাত্ত্বিক তথা আকরণবাদের ( Structuralism -এর এই বঙ্গীকরণ তপোধীর ভট্টাচার্য কৃত) প্রণেতা রোলাঁ বার্থও একই সুরে জোরালঢঙে বলেছিলেন ' The birth of the reader must be at the cost of the death of the author '. সুতরাং এটা স্পষ্টতই বোধগম্য হয় যে তন্নিষ্ঠ পাঠকের গুরুত্ব লেখকের চাইতে কম তো নয়ই বরং বেশি।
যাই হোক, আপন বক্তব্যে ফিরে বলি, বিদ্যালয়শিক্ষার মধ্যস্তরের প্রয়োজনে যখন গাঁ ছেড়ে গঞ্জে বাস শুরু হল তখন সেখানে পাওয়া গেল এক সরকারি পাবলিক লাইব্রেরি যার সদস্য করে দেওয়া হল আমার পাঠোৎসুক মাকে আর সেই সূত্রে আমারও নানাবিধ বইপড়ার বিস্তার ঘটল- মূলত উপন্যাসপাঠ, সামাজিক, ঐতিহাসিক ; শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর থেকে শুরু করে শরদিন্দু, পারাবত, আশুতোষ, নীহাররঞ্জন, বিমল মিত্র, রমেশচন্দ্র দত্ত - কে নেই সেই তালিকায়! মাকে দেখেছি রাতভর জেগে প্রমথনাথ বিশীর( প্র না বি)' লাল কেল্লা ' র মতো ঢাউস উপন্যাস শেষ করতে। এ বই আমিও পড়েছি তবে রয়েসয়ে। এরপর পড়েছি কিছু অধরা আকর্ষণের বই যে সবের লেখক অবধূত, তারাপ্রণব ব্রহ্মচারী, স্বামী অভেদানন্দ ইত্যাদি। পরবর্তী সময়ে প্রিয় সমরেশ বসু থেকে শুরু করে প্রিয়তর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ( এঁর ' ঘুণপোকা 'র সঙ্গে অনেক পরে কাফকার ' মেটামরফোসিস 'এর মিল খুঁজে পেয়েছিলাম যেন)। সত্তর দশকের গোড়ায় বিপ্লবাত্মক কলেজকালে রেড বুক যেমন পড়েছি তেমনই পরে পড়েছিলাম সমরেশ মজুমদারের অনিমেষ - মাধবীলতা সিরিজও। এক সময় ' সাহিত্য ' পত্রিকার সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি বন্ধুবর প্রমথ চৌধুরীকে ' উদাসীন গ্রন্থকীট ' বলেছিলেন। দীর্ঘদিন আমিও তেমনটাই ছিলাম। আমার পাঠ প্রক্রিয়ায় লেখক রবীন্দ্রনাথ অনুসৃত কোনওরূপ সাংগঠনিক প্রয়াস ছিল না। বয়সের ঢালপথে নেমে মনে হয়েছে প্রয়োজনীয় পাঠের চাইতে অহেতুক পাঠের পাল্লাই ভারী হয়েছে। সমালোচক সরোজ আচার্যর কথানুযায়ী জলীয় অংশ বাদ দিয়ে জ্ঞান ভাণ্ডারের ক্ষীর আত্মসাৎ করা হয়ে ওঠেনি। তাই এখন আর...
এই ফাঁকে বলে রাখি, যেহেতু মূলত গল্পচর্চাই করে থাকি সেই হেতু ইদানীং উপন্যাস পড়ি না বললেই চলে - নিজস্ব কাজের প্রয়োজন ছাড়া। তবে সম্প্রতি তিনটি উপন্যাস পড়েছি। ' ব্যাস ', ' ইহদেহ ', আর ' পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল '। প্রথম দুটির লেখক শাহযাদ ফিরদাউস আর তৃতীয়টির লেখক প্রীতম বসু। এই তিনটি বইই আমাকে অনাবিল প্রভবিষ্ণুতায় মুগ্ধ করেছে। মানুষের জৈবনিক সংগ্রামের অংশভাক হতে কিংবা আমাদের অতীতকে খুঁজে পেতে এই দুজনের লেখা অবশপাঠ্য। তা যে কথা বলছিলাম, পত্রপত্রিকার উল্লেখ বাদ দিলে বলতে হয়, রবীন্দ্রনাথ ও তারাশঙ্করের ' গল্পগুচ্ছ ' দিয়েই আমার গল্পপাঠ শুরু। আমার প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ তারাশঙ্করকে উৎসর্জিত ; তাঁর গল্পের প্রেরণাতেই আমার প্রথম গল্প ' জটাই ' লিখেছিলাম। সেই অর্থে তিনি আমার গল্প লিখনের সূচনামুখ।
এরপর কুসুমিত যৌব - ঘোটকের সওয়ার হয়ে যখন কলেজের আঙিনায় পা রাখলাম তখন পাঠাভ্যাসেও খানিক চাঞ্চল্য এল। দুটি উপন্যাস তখন আমার কাছে বেদ-সম হয়ে উঠেছিল - নিমাই ভট্টাচার্যর ' মেমসাহেব ' আর যাযাবরের ' দৃষ্টিপাত '। সঙ্গে কিছু নিষিদ্ধ পাঠ, অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত যেমন সমরেশ বসুর ' বিবর ', ' প্রজাপতি ', বুদ্ধদেব বসুর ' রাত ভরে বৃষ্টি ', নবোকভের ' লোলিটা ', মোরাভিয়া বা লরেন্সের ইরোটিক উপন্যাস ' লেডি চ্যাটারলিজ লাভার '। সুখী জীবনের সন্ধানে তখন ডেল কার্নেগিও পড়তাম। মনে পড়ে, বিবাহবাসরে স্ত্রীকে বুদ্ধদেব বসুর ' তিথিডোর ' উপহারস্বরূপ দিয়েছিলাম যার আকার দেখে সে একটু অনীহাসুলভ বিরক্তি প্রকাশ করেছিল।
এরপর আমার প্রিয়পাঠের সারিতে যে সমস্ত বই এসেছে তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা দেওয়া অহেতুক বাতুলতাই শুধু নয়, অসম্ভবও বটে। তবে কিছু বইয়ের উল্লেখ অবশ্যই করব। যেমন প্রথমেই মনে আসছে অ্যালভিন টফলারের ' ফিউচার শক ' যা পড়ে পোশাকের বিবর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সাইকো অ্যানালিসিস বিষয়ে আমার জ্ঞানলাভ হয়। বরিস পাস্তারনাকের ' ড. জিভাগো ' তেমনই অপর প্রিয় বই যার বই হয়ে ওঠা থেকে নোবেল পুরস্কার পাওয়া নিয়ে আর একটি রোমহষর্ক উপন্যাস হতে পারত। বার্ট্রান্ড রাসেল আমার অপর প্রিয় চিন্তক যাঁর ' ম্যারেজ অ্যান্ড মোরালস ' বা শিক্ষা সংক্রান্ত রচনা আমাকে সতত ঋদ্ধ করে।
কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হিসাবে যে সব হ্যান্ডি পেপারব্যাক নিয়ে প্রদর্শিত ঘোরাঘুরি করে অন্তর্গত গর্ববোধ করতাম তার মধ্যে প্রথমেই মনে আসে প্যালগ্রেভের ' গোল্ডেন ট্রেজারি ' র কথা। Riders to the Sea(Synge), Strife, Justice (Galsworthy) ছাড়িয়ে এই ক্ষেত্রে যে রক্তিম মলাটের বইটি আমাকে উদ্দীপ্ত করত তা হল ন্যাথানিয়েল হথর্নের Scarlet Letters. একই সময়ে বুদ্ধদেব গুহর ' হলুদ বসন্ত'র নয়না চৌধুরীকে লেখা চিঠি পড়ছি। পত্রসাহিত্য, মনীষী লেখকদের পত্রচারিতা আমার আমর্ম কৌতূহল কেননা তার মাঝ থেকেই উঠে আসেন সুপ্ত ও গুপ্ত মানুষটি। রবীন্দ্রনাথের বা কীটস-এর পত্রাবলি তাই আমার অত্যন্ত প্রিয়। এমনতরো আরও আছে।
আমার অসংগঠিত এলোমেলো পাঠসূচিতে কিছু ধর্মপুস্তকও আছে। শ্রীম'র ' শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত ', স্বামী সারদানন্দর ' শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ ' র উল্লেখ বাদ দিলেও ড. দুর্গাদাস বসু সরস্বতীর ' হিন্দুধর্মের সারতত্ত্ব ' কিংবা ওয়েনডি ডনিগারের On Hinduism পড়েছি। মনে পড়ছে, আমার আলমারিতে পবিত্র কুরআনের একটি বাংলা অনূদিত গ্রন্থ দেখে এক গোঁড়া হিন্দু পাঠক হাঁ হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ' আপনি কোরআনও রাখেন? ' তার অন্তর্লীন অনড় অচ্ছুৎ - ভাবনার কথা বুঝে নিয়ে তাকে আর অযথা বোঝাতে চেষ্টা করিনি যে বাংলা কোরআনের এতাবৎকালের মধ্যে শ্রেষ্ঠ অনুবাদক একজন হিন্দু, ভাই গিরিশচন্দ্র সেন।
এক কালে ভ্রমণের বই খুব টানত। না, আমি পুতুল -ঈশ্বরের আশিস পেতে ভ্রমণে যাই না। মন্দির -মসজিদ - গুরুদ্বারের স্থাপত্য আমার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। এই বৈচিত্র্যময় দেশটার আনাচকানাচে যা কিছু দর্শনীয় লুকিয়ে, সুযোগমতো সে সবের টানেই ছুটে যেতে মন চায়। সশরীরে যেতে না পারলে মানসভ্রমণই আমার পা-বাজিকে উসকে দেয়। এভাবেই থিতু অক্ষরের হাত ধরে বারবার পৌঁছে গিয়েছি চিত্রল প্রেক্ষাপটে, আমার চংক্রমণে রোমাঞ্চন জাগিয়েছে সুবোধ কুমার চক্রবর্তীর একুশ খণ্ডের ' রম্যাণি বীক্ষ্য '। এক একটি খণ্ডের পথ বেয়ে আমার ভারতভ্রমণ সাঙ্গ করেছি। মনে পড়ছে শৈলেন্দ্র নারায়ণ ঘোষাল শাস্ত্রীর ' তপোভূমি নর্মদা 'র কথা যে বই আমাকে প্রাতিস্বিক, সুললিত বর্ণনার সামনে সন্নত হতে শিখিয়েছিল। অধুনা- বিস্মৃত দেবেশ চন্দ্র দাশের ' ইয়োরোপা ', সৈয়দ মুজতবা আলীর ' দেশে বিদেশে ', অন্নদাশঙ্কর রায়ের ' পথে প্রবাসে 'ও অনাবিল আনন্দ দিয়েছে। এই পর্যায়ে প্রবোধ কুমার সান্যালও কম আনন্দ দেননি। রাহুল সাংকৃত্যায়নের ' ভোলগা থেকে গঙ্গা ' ও ভ্রমণকাহিনি হিসেবে আমার অতি প্রিয়।
শিক্ষক হিসেবে যে বইগুলো আমাকে অভূতপূর্ব মজায় প্রতিবিম্বিত করেছে তার মধ্যে আবশ্যিকভাবেই উল্লেখ্য মনোজ বসুর ' মানুষ গড়ার কারিগর ', আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ' নিষ্ফলা মাঠের কৃষক ', মৌসুমী ভৌমিকের অনুবাদে তেৎসুকো কুরোয়ানগির ' তোত্তো-চান ' আর অবশ্যই আহমদ ছফার ' যদ্যপি আমার গুরু '( এই বইটি নিয়ে বিস্তৃত পর্যালোচনা করেছিলাম ঢাকা থেকে প্রকাশিত ' এবং বই ' পত্রিকায়)।
আমার কাব্যপাঠ অকিঞ্চিৎকর। তবু্ও যাঁদের আমি সান্দ্র অভিনিবেশে পড়েছি তাঁরা হলেন রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ ও বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ; ফ্রান্সিস বেকনের কথানুযায়ী ভাসাভাসা পড়েছি শক্তি, নীরেন্দ্রনাথ সহ আরও এক দুজন।
আমার সম্প্রদায় - সমন্বয়ী মানস যে কটি বইয়ের দিকে ধাবিত তার মধ্যে উল্লেখনীয় বিপান চন্দ্রর ' আধুনিকতা ও সাম্প্রদায়িকতাবাদ ', সাবা নাকভির In Good Faith, রফিক জাকারিয়ার Communal Rage In Secular India, ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব, রোমিলা থাপারের আধুনিকমনস্ক প্রামাণ্য বইপত্র এবং অবশ্যই সমন্বয়সাধক রেজাউল করিমের রচনানিচয়।
তৎগতচিত্ত পাঠকের ভাব থাকবে আর স্তেনবৃত্তির অবিকার আকর্ষণ থাকবে না এমন সোনার পাথরবাটি হতেই পারে না। আমিও এই সহজাত বৃত্তি বা বৃত্তের বাইরে নই।এ বিষয়ে আমি মুজতবা আলীর নির্দেশ -মান্য অনুগামী। সেই সূত্রে কলেজের ছাত্রাবাস - পাঠাগার কিংবা অসন্দিগ্ধচিত্ত বন্ধুর সংগ্রহ থেকে লোভ্য বইপত্র ঝেঁপেছিলাম বেশ কিছু ;আর এভাবেই আমার আলমারিতে ঢুকেছিল গোর্কির ' মা ', শ্রীশ চন্দ্র দাশের ' সাহিত্য - সন্দর্শন ', জসিমউদ্দীনের ওপর গুরুত্বপূর্ণ বই, প্রিয় অ্যাফ্রো - আমেরিকি লেখক জেমস বলডুইনের Tell Me How Long The Train's Been Gone, If Beale Street Could Talk... হয়তো আরও আরও, মনে নেই সব। তবে এ কৃতকর্ম তো একমুখী হতে পারে না, তাই আমারও গেছে বেশ কিছু।
প্রসঙ্গত মনে পড়ল আর এক প্রিয় লেখকের কথা - পাওলো কোয়েলহো যাঁর Eleven Minutes, Like The Flowing River, The Zahir, The Alchemist আমার নিবিড় পাঠের অন্যতম।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস খুব কম অথচ অধৃষ্য লেখার কারণে আমার অতীব প্রিয়। শওকত আলীর প্রায় সব গল্প পড়েছি এবং নিম্নবর্গীয়, নিম্নবিত্তিয় মানুষের নানাবর্ণিল যে ছবি তিনি এঁকেছেন তা আমাকে শিক্ষিত ও দীক্ষিত করেছে। অথচ বাংলাদেশে তেমনভাবে আলোচিত ছিলেন না তিনি, কিছুদিন আগে অব্দি। এবার বলি, শহীদুল জহিরের কথা যাঁর অকালপ্রয়াণে বাংলা কথাসাহিত্যের সমূহ ক্ষতি হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। যদিও ভাষাগত অজ্ঞানতায় ( অন্তত আমার কাছে) সব গল্প আত্মস্থ করতে পারিনি তবুও আকৃষ্ট হয়েছি যৎপরোনাস্তি। তাঁর ' আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস ' একটিমাত্র অনুচ্ছেদে লিখিত যার উদাহরণ আমি অন্তত আমার পাঠ- পরিধিতে পাইনি ( গল্পের ক্ষেত্রে)।
মৌলিক লেখালিখি তথা অনুবাদের জরুরি প্রয়োজনে প্রচুর বাধ্যতামূলক পড়াশোনা করতে হয় যার তালিকা দিতে গেলে চিত্রগুপ্তের খাতাকেও ছাড়িয়ে যাবে আর সবকিছু স্মৃতিতেও নেই। তবে একটি কথা বলা যায়, বিভিন্ন ভাষা তথা প্রদেশের গল্পানুবাদ করতে গিয়ে বাঙালি উচকপালেপনা যথেষ্টই টাল খেয়েছে, পাঠক হিসেবে উন্মোচিত হয়েছে সঠিক দর্শন।
ইদানীং এই উত্তর ষাটে এসে সিরিয়াস প্রবন্ধকার, ইচ্ছাকৃতভাবে স্মৃতিবর্জিত গল্পকারদের মন দিয়ে পড়ছি, তাঁদের নিয়ে কাজও করছি আর আফশোস হচ্ছে, এতদিন কেন এঁদের খুঁজিনি বা খুঁজে পাইনি! এঁদের মধ্যে যাঁদের কথ চটজলদি মনে পড়ছে তাঁরা হলেন সাবিত্রী রায়, সুলেখা সান্যাল, দিবাকর ভট্টাচার্য, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, ননী ভৌমিক, গুণময় মান্না প্রমুখ। প্রবন্ধের ক্ষেত্রে আছেন সুকুমারী ভট্টাচার্য, অবন ঠাকুর, অরিন্দম চক্রবর্তী, দীপেশ চক্রবর্তী, মণীন্দ্র গুপ্ত, শামসুর রাহমান, আবু সয়ীদ আইয়ুব প্রমুখ। এঁদের পড়ি, আবারও সেই ফ্রান্সিস বেকনের নীতি অনুসারে অর্থাৎ some books are to be chewed and digested.
যে কটি বই পড়ে বেবাক ঠকে গিয়েছি তার মধ্যে অন্যতম আমেরিকি ডেভিড মার্কসনের This is not a novel and other novels কেননা না - উপন্যাস, না - গল্প জাতীয় লেখা আমার দুর্বল মস্তিষ্কের মোটা ঘিলুতে সহজধার্য নয়, নয় সহজপাচ্যও। তাই প্রৌঢ়ত্বের সীমান্তে এসে আর এলোপাথাড়ি পড়াশোনা করি না। সাংগঠনিক ঢঙে লেখালিখির প্রয়োজনানুগ পাঠ চালিয়ে যাই। জলীয় অংশ বর্জন করে চলতে চেষ্টা করি।
এই স্বল্পাকার রচনার শেষ পর্যায়ে এসে কী কী পড়েছি সে ব্যাপারে আর গাওনা না দিয়ে কী কী পড়িনি বা পড়তে আগ্রহ পাইনি তার সামান্য ফিরিস্তি দিই।
এ প্রসঙ্গে ' বই পড়া ' গ্রন্থের লেখক সরোজ আচার্যর মত মস্তিষ্ক - ধার্য করে তাঁর কথাতেই বলি : ' কী কী বই পড়িনি, পড়ে উঠতে পারিনি অথবা চেষ্টা করেও পড়বার উৎসাহ পাইনি তা নিয়ে স্মৃতিমন্থন করলে অদ্ভুত একটা আনন্দ পাওয়া যায়
( অকপট স্বীকারোক্তির আনন্দ)। নিজের অনুরাগ, বিরাগ, অজ্ঞতা, অন্ধতা এবং অক্ষমতার হিসেবনিকেশ করায় ক্ষতি নেই, লাভ কিছু আছে। ' সরোজবাবু আরও বলেছেন, ' আলডুস হাক্সলি বলেছিলেন তিনি গোল্ডস্মিথের ' ভিকার অব ওয়েকফিল্ড', হুগোর ' লে মিসেরাবলস ' পড়েননি ; জর্জ মেরেডিথের বেশির ভাগ উপন্যাসেরই একশো পাতার বেশি তিনি পড়তে পারেননি। হ্যামিলটন ফাইফ স্পেনসারের ' ফেয়ারি কুইন ' শুধু পড়েননি তা নয়, তাঁর মতে ও বই অপাঠ্য। '
এ বিষয়টি সকল পাঠকের মতো আমার ক্ষেত্রেও স্বতঃসিদ্ধ তাই বলি, হাতের নাগালে থাকা সত্ত্বেও যে বই এখনও পড়া হয়নি তার কয়েকটি হল, তলস্তয়ের ' রেজারেকশঅন ', হার্পার লি'র বিখ্যাত বইদুটি, To Kill a Mocking bird, Go Set A Watchman, গৌরী আইয়ুবের ' আমাদের দুজনের কথা এবং অন্যান্য ', প্রশান্ত কুমার পালের ' রবিজীবনী'র অধিকাংশ খণ্ড, জীবনানন্দ সমগ্রর অধিকাংশ রচনা, নাগাল্যান্ডের সমাজ- জীবনে মাতৃতন্ত্রের শক্তিশালী প্রভাব - বিষয়ক বই A Terrible Matriarchy ( Easterine Kire), পরশুরাম, শিব্রামের অধিকাংশ গল্প প্রভৃতি। আর যে বই পড়ার চেষ্টা করেও বেশিদূর এগোনোর উৎসাহ পাইনি তা হল জয়েসের ' ইউলিসিস ', সেসোয়াভ মিউসের ' দ্য ক্যাপটিভ মাইন্ড ' বা মিলান কুন্দেরার The Festival of Insignificance.
যে সব বই সংগ্রহে নেই অথচ পড়ার ইচ্ছা প্রবল তা হল - চাণক্য সেনের ' একান্তে ' ( বঙ্গসাহিত্য প্রসারিত না হবার কারণ উল্লেখপূর্বক দারুণ তথ্যমূলক বই), অন্নদাশঙ্কর রায়ের ' সত্যাসত্য ', যাযাবরের ' কালকের পোষাক ', আবুল মনসুর আহমদ -এর 'আয়না ', ' ফুড কনফারেন্স ', ফা হিয়েনের ' ট্রাভেলস ', জ্যাক কেরুয়াকের ' অন দ্য রোড ', বুলবুল চৌধুরীর গল্পসংগ্রহ, The Autobiography of an American Communist ( Peggy Dennis), Moscow 2042★(Vladimir Voinovich), Till The Day I Die / Waiting for Leftie( Clifford Odets), The Wonder That Was India ( A L Basom), The ABC of Relativity ( Russell), The Holy Warriors : A Journey into the Hearts of Indian Fundamentalism ( Edna Fernandes), Indian Muslims - where have they gone wrong? (Rafiq Zakaria) ইত্যাদি। জানি না এই সমস্ত প্রিয় বই আমার জীবিতাবস্থায় আর পড়ার সুযোগ পাব কি না! অবশ্য রোলাঁ বার্থের Barthe by Barthe বইটি আমাকে পড়তেই হবে।
কবিগুরুর ' না - বলা বাণী 'র মতো অনেক না-বলা কথা রয়ে গেল। এতক্ষণ অব্দি যা বললাম বা যে সমস্ত বইয়ের কথা ছুঁয়ে গেলাম তা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। তবু্ও মালার্মের কথা মেনে বলি ' Everything ends up in a book '. তাই আক্ষেপের সুরে নাটককার - কবি মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার ছত্র দিয়ে শেষ করি : ' বুকের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় লক্ষ দীঘি / তবু আমার স্নান হল না সারাবেলা '( গোলাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ)।