একাত্তরে যেভাবে নিজের দিনলিপি রক্ষা করেছিলেন জাহানারা ইমাম
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছেলে শাফী ইমাম মুক্তিযুদ্ধের শহীদ। জাহানারা ইমামের বই ‘একাত্তরের দিনগুলি’ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দলিল। লিখেছেন সরদার ফজলুল করিম।
রুমীর আম্মা
আমার ইচ্ছে হচ্ছে, রুমীর আম্মা, জাহানারা ইমামের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎকারের কথাটি লিখে রাখি। রুমীর পরিচয় পেয়েছি জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’র প্রকাশিত দিনলিপিতে। গ্রন্থের আকারে প্রকাশিত সে দিনলিপির চতুর্থ সংস্করণটি ইতিমধ্যেই হয়তো নিঃশেষ হতে চলেছে। ১৯৮৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘একাত্তরের দিনগুলি’। ‘সচিত্র সন্ধানী’র পাতায় এর আগে বেরিয়েছিল। তার পরে বই আকারে ।
একাত্তরের দিনগুলি আমার নিজেরও অজানা নয়। সেদিনের বন্দী, অবরুদ্ধ ঢাকার মানুষ আমি। নিজের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনেও সেদিন নানা বিপদ এবং বিপর্যয় ঘটেছিল। সেই বিপর্যয়ের ভেতর দিয়েই একাত্তরের সঙ্গে পরিচয়। কিন্তু একাত্তরের মোকাবিলা সেদিন কয়েকটি ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। পূর্ব বাংলার মানুষের সমগ্র ইতিহাসে তার আপামর অধিবাসীর জীবনে এমন রাজনৈতিক-সামাজিক আলোড়ন আর কখনো ঘটেছে বলে কল্পনা করা চলে না। ৩০ লক্ষ শহীদ— ৩০ লক্ষ মানুষের ধন-মান-প্রাণের নিধন। কথাটা বাক্য হিসেবে শুনলে আবেগের বাহুল্য বলে বোধ হয়। কিন্তু জাহানারা ইমামের জীবনে একাত্তরে যা ঘটেছে, এবং জাহানারা ইমাম, তাঁর স্বামী ইঞ্জিনিয়ার শরীফ ইমাম, তাঁদের হীরের টুকরোর মতন জ্যোতির্ময় পুত্র রুমী: একাত্তরের সংগ্রামের সঙ্গে তাঁদের দৃশ্য-অদৃশ্য, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নানাভাবে সম্পৃক্ততার কথা শুনলে বাক্যের আবেগকে বাহুল্য নয়, বাস্তবকে প্রকাশের ক্ষেত্রে বাক্যকে একেবারেই অক্ষম বলে বোধ হয়।
জাহানারা ইমাম, তার স্বামী এবং পুত্র—এঁরা একাত্তরে কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলেন না। তবু সেই ঊনসত্তর কিংবা তার আগ থেকেই বাংলার জনমানসের ক্রমবিকাশমান আর্তি এবং আলোড়নের তাঁরা ছিলেন সচেতন দর্শক এবং জীবনের তালে তাল মিলিয়ে চলার পথযাত্রী। তরুণ রুমী ভর্তি হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনির্ভাসিটিতে। পরিকল্পনা ছিল উচ্চতর শিক্ষার জন্য সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাবে। কিন্তু সে তার মাকে বলেছিল, ‘আম্মা, আমি মুক্তিযুদ্ধে যাব।’ বাবাকেও সে কথা সে জানিয়েছিল। তাদের পারিবারিক পরিবেশটি ছিল পরস্পরের মধ্যে উন্মুক্ত আলোচনা আর বন্ধুত্বের পরিবেশ। এমনটি খুব কম দেখা যায়। রুমী তার মাকে না জানিয়ে কোনো কাজ করে না। ’৭১-এর ২৫ মার্চের পরেই বাংলাদেশের তরুণরা গেরিলা কৌশলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিল। তারা সম্ভবত মারণাস্ত্র সংগ্রহ করছিল। শত্রুর যাতায়াতকে বিঘ্নিত করার চেষ্টা করছিল। এমন কাজে ব্যাপৃত কর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য, মালমশলা, কাপড়-চোপড় সংগ্রহ করছিল। গোপনে, সঙ্গোপনে। রুমী, রুমীর আম্মা, রুমীর আব্বা—তাঁরা সকলেই ছিলেন এমন গোপন কাজের অংশীদার। অবস্থা ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। শত্রুর আক্রমণ তীব্র হচ্ছিল। ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের পর ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সুনির্দিষ্ট আঘাত আসছিল অবরুদ্ধ ঢাকার গুপ্তভাবে কর্মরত মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সমর্থকদের ওপর । রাত–বিরেতে বাড়িতে বাড়িতে হানাদাররা হানা দিচ্ছিল। ধরে নিয়ে যাচ্ছিল ক্যান্টনমেন্ট আর নির্যাতন কেন্দ্র এমপি হস্টেলে। রুমী এসেছিল তার বন্ধুদের সাথে একটা নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করতে। মায়ের সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ রোধ করতে না পেরে বাড়িতে এসে একরাত থাকতে না থাকতে পাকিস্তানি বাহিনী গভীর রাতে এসে হামলা করল জাহানারা ইমামের নিউ মার্কেটের কাছের এলিফ্যান্ট রোডের ‘কণিকা’ বাড়িটিতে। ঘরের ভেতর থেকে ধরে নিয়ে গেল রুমী এবং তার আব্বাকে। নির্মম নির্যাতন চালানো হলো তাদের ওপর, এমপি হস্টেলে। গ্রেপ্তারের পর পিতার কাছ থেকে পুত্র রুমীকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হলো। কয়েক দিন পর অকথ্য নির্যাতনের চিহ্ন বুকে-পিঠে ধারণ করে রুমীর আব্বা শরীফ সাহেব যদিবা মুক্তি পেয়ে ফিরে এলেন, রুমী আর এল না। নির্যাতনের এই আঘাতে এবং পুত্রের নিহত হওয়ার ঘটনায় শরীফ সাহেবের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ল। ডিসেম্বর মাসে, স্বাধীনতার যুদ্ধ যখন বিজয়ের সন্নিকটে, তখন আকস্মিকভাবে শরীফ সাহেব সংজ্ঞা হারালেন। হাসপাতালে নেওয়া হলো তাঁকে। কিন্তু সেখান থেকে ১৪ ডিসেম্বর সকালে ফিরে এল তাঁর মৃতদেহ।
জাহানারা ইমাম ১৪ ডিসেম্বরের দিনলিপিতে লিখলেন, ‘শরীফকে বাসায় আনা হয়েছে সকাল দশটার দিকে। মনজুর, মিকি—এরা দুজনে ওদের পরিচিত ও আত্মীয় পুলিশ অফিসার ধরে গাড়িতে আর্মড পুলিশ নিয়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একটা পিকআপ জোগাড় করে হাসপাতাল থেকে ওকে নিয়ে এসেছেন।’
যেন জাহানারা ইমামের স্বামী শরীফ সাহেব অসুস্থ হলেও দুর্বল অবস্থায় ফিরে এসেছেন। তিনি মারা গেছেন এমন মর্মান্তিক ঘটনার আভাস বর্ণনার এ বাক্য কয়টিতে পাঠক অন্বেষণ করেও পাবেন না। কেবল এখানেই নয়। তার পরের সকল ঘটনার বিবরণ এমন একটি অকল্পনীয় স্থৈর্যের মধ্যে লিখিত হয়েছে যে নিজের জীবনের সবচাইতে মর্মান্তিক ঘটনার এমন আপাত নিরাবেগ বর্ণনা তাঁকে তুলনাহীন করে তুলেছে। এই বিবরণ পাঠ করে এবং দৃশ্যটি নিজের মনের চোখে উদ্ভাসিত করতে গিয়ে আমার নিজের চোখও বারংবার জলে ভরে ওঠে। দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দেয়।
‘এটা আমার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। নিজের খাতায় টুকিটাকি লিখে রাখা। দিনাদিনের ঘটনা। কিন্তু একাত্তরের ঢাকায় বসে এসব লেখার বিপদ আমি জানতাম। তবু অভ্যাস ছাড়তে পারিনি। কেবল নিজের বুদ্ধিতে আজেবাজে খাতার পাতায় এ-কোণা ও–কোণা করে, আঁকা-বাঁকা লাইনে, কখনো কালো কালিতে, কখনো রঙিন কালি দিয়ে প্রায় ছবির মতো করে দিনের ঘটনাকে ইঙ্গিতে লিখে রাখার চেষ্টা করেছি। রুমীর নাম উল্লেখ করতে হলে উল্টে লিখেছি ‘মীরু’। মুক্তিযোদ্ধাদের যদি পাঁচ শ টাকা পাঠিয়েছিতো লিখেছি, পাঁচখানা কাপড় লীতে দেওয়া হয়েছে। বুদ্ধিতে যেমন কুলিয়েছে, তেমন করে লিখে রেখেছি। ভেবেছি, যদি হামলা হয়, যদি এ কাগজ হানাদারদের হাতে পড়ে, তবে ওরা একে পাগলের আঁকিবুকি ছাড়া আর কিছুই ভাববে না।’
বস্তুত জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ একদিকে যেমন একাত্তরের ঢাকার, তথা সংগ্রামী বাংলাদেশের এক দলিলবিশেষ, তেমনি একটি পরিবারের মর্মস্পর্শী কাহিনি হিসেবে অপার বেদনা, সাহস এবং সংগ্রামের এক বিস্ময়কর আলেখ্যবিশেষ।
আমার ইচ্ছে ছিল, জাহানারা ইমামের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, কেমন করে তিনি এই দিনলিপিগুলো তৈরি করেছিলেন, কেমন করে তাকে তিনি রক্ষা করেছিলেন।
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম
কিন্তু জাহানারা ইমাম, আমি শুনেছিলাম, ভয়ানকভাবে অসুস্থ।
’৭১-এর পরবর্তীকালে তাঁর মুখে ক্যানসার রোগ ধরা পড়ে। তার ফলে তাঁর পক্ষে স্বাভাবিকভাবে আহার করা, খাদ্য গ্রহণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। যাঁর সুন্দর, মার্জিত উচ্চারণের আলাপ-আলোচনা একদিন ঢাকার সাংস্কৃতিক মহলকে আকৃষ্ট এবং আনন্দিত করত, তাঁর কণ্ঠ আজ প্রায় স্তব্ধ৷ এ–ও জাহানারা ইমামের জীবনের আরেকটি ট্রাজেডি। আমার তাই সংকোচ ছিল, এমন অবস্থায় তাঁর কাছে গিয়ে তাঁর বিগত দিনের মর্মান্তিক জীবনের কথা জিজ্ঞাসা করা উচিত হবে কি না। তাঁকে দিয়ে কথা বলানোতে তাঁর কষ্ট বৃদ্ধি পাবে কি না।
আমার মনের ইচ্ছার কথা বলেছিলাম মিসেস বাসন্তী গুহঠাকুরতাকে। বাসন্তী গুহঠাকুরতা জাহানারা ইমামের যেমন সুহৃদ, তেমনি তাঁরই মতো ’৭১-এর ট্রাজেডির আরেক নায়িকা । বাসন্তী গুহ ঠাকুরতা কোনো বই লেখেননি। নিজের কথা নিজে কোথাও বলেননি। কিন্তু বাসন্তী গুহঠাকুরতার স্বামী অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্লাটে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। হানাদার বাহিনী তাঁর ফ্লাট আক্রমণ করে, বুটের লাথিতে দরজা ভেঙে অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার নাম জিজ্ঞাসা করে তাঁকে ধরে সিড়ির গোড়াতে নিয়ে সামনাসামনি গুলি করে চলে গিয়েছিল। ২৬ নয়, বোধহয় ২৭ মার্চ তাঁকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু তাঁর জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়নি। সচেতনভাবে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে কয়েকদিন পর তিনি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
সে–ও আর এক মর্মন্তুদ কাহিনি।
জাহানারা ইমাম আমার বান্ধবীস্থানীয়। ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনের সময় আমরা এক সাথে রাস্তায় মিছিল করেছি। আমি বাংলা একাডেমিতে চাকরি করাকালীন তাঁকে বাংলা একাডেমির সকল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে এবং শ্রোতা-দর্শক হিসেবে নিয়মিত উপস্থিত হতে দেখেছি। তবু আজ একা তাঁর সামনে গিয়ে, তিনি কেমন আছেন, জিজ্ঞাসা করতে সাহস হচ্ছিল না। বাসন্তী গুহঠাকুরতা আমার চেয়ে বয়সে বড়। আর পাঁচজন বয়ঃকনিষ্ঠের মতো আমিও তাঁকে ‘দিদি’ বলে সম্বোধন করি। তিনি তাতে খুশি হন। তাঁকে জাহানারা ইমামের কাছে যাওয়ার কথা বলাতে তিনিই ফোনে যোগাযোগ করে তারিখ ঠিক করলেন। এবং সে অনুযায়ী আমরা দুজন ১০ এপ্রিল (’৮৮) তারিখে জাহানারা ইমামের ‘কণিকা’ ভবনে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম।
গিয়ে দেখলাম, তাঁর শরীর কিছুটা সুস্থ হয়েছে। আমাদের দেখে খুবই খুশি হলেন। পুরোনো দিনের এমন পরিচিত মানুষের সংখ্যাই আজ কম । আনন্দের রঙে তাঁর গৌঢ় মুখখানি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তবু দুঃখ লাগল আমার এই দেখে যে সে মুখ দিয়ে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে তাঁর এখনো কিছুটা কষ্ট হয়। অপারেশন হয়েছে। জিহ্বার সম্মুখ ভাগটি কিছুটা প্রলম্বিত হয়ে গেছে। বললেন, কথা বলতে পারেন। তবে কোনো শক্ত খাবারই জিহ্বায় দিতে পারেন না। জিহ্বা তা গ্রহণ করে গলায় দিতে পারে না। বাইরে বেরিয়ে আসে।
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম
তবু আমার সঙ্গে আলাপে কোনো কষ্টকে কষ্ট বলে স্বীকার করলেন না। কোনো নিষেধ শুনলেন না। নিজের হাতে আমাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন। মিসেস বাসন্তী গুহঠাকুরতারও আপ্যায়নের বৈশিষ্ট্যটি পরিচিত মহলে প্রবাদের খ্যাতি অর্জন করেছে। আমরা যে ছয় দিন জাহানারা ইমামের কাছে গিয়েছি, তার মধ্যে দুদিনই বাসন্তী দেবী তাঁর বাসা থেকে নিজের হাতে তৈরি পুডিং আর ক্ষীর জাহানারা ইমামের জন্য বাটিতে করে নিয়ে এসেছেন। তাঁদের দুজনের মধ্যে সখিভাব। পরস্পরের মধ্যে ‘তুমি’র সম্বোধন।
জাহানারা ইমাম আমার কাছে এসে বসলেন। আমাদের আলাপটি রেকর্ড করে রাখার জন্য আমি একটি শব্দগ্রাহকও নিয়ে গিয়েছিলাম। সেটি সামনে রেখে আমি জাহানারা ইমামকে আমার নিজের মনের আন্তরিক অনুভূতি প্রকাশ করে বললাম, ‘আপনার দেশব্যাপী আজ পরিচয়—আপনি রুমীর আম্মা। আপনার ‘একাত্তরের দিনগুলি’র মধ্য দিয়ে আমরা আপনার রুমীকে চিনেছি। রুমীর আব্বা শরীফ সাহেবকে পেয়েছি। এবং এক ভিন্নতর জাহানারা ইমামকেও পেয়েছি, যিনি কেবল একজন সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক কর্মী নন, যিনি ত্যাগে সাহসী, বিপদে স্থির এবং আত্মপ্রকাশে যিনি অবিশ্বাস্যরূপে সংযমী। আপনি আমাকে বলুন, কেমন করে এমন দিনলিপি আপনি সেই মহা বিপদের নয় মাস ধরে তৈরি এবং তাকে রক্ষা করেছিলেন।’
আমার এমন আবেগে জাহানারা ইমামের চোখও আজ বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে এল। তিনি আঁচল দিয়ে চোখের কোণ মুছলেন। বললেন, ‘এটা আমার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। নিজের খাতায় টুকিটাকি লিখে রাখা। দিনাদিনের ঘটনা। কিন্তু একাত্তরের ঢাকায় বসে এসব লেখার বিপদ আমি জানতাম। তবু অভ্যাস ছাড়তে পারিনি। কেবল নিজের বুদ্ধিতে আজেবাজে খাতার পাতায় এ-কোণা ও–কোণা করে, আঁকা-বাঁকা লাইনে, কখনো কালো কালিতে, কখনো রঙিন কালি দিয়ে প্রায় ছবির মতো করে দিনের ঘটনাকে ইঙ্গিতে লিখে রাখার চেষ্টা করেছি। রুমীর নাম উল্লেখ করতে হলে উল্টে লিখেছি ‘মীরু’। মুক্তিযোদ্ধাদের যদি পাঁচ শ টাকা পাঠিয়েছিতো লিখেছি, পাঁচখানা কাপড় লীতে দেওয়া হয়েছে। বুদ্ধিতে যেমন কুলিয়েছে, তেমন করে লিখে রেখেছি। ভেবেছি, যদি হামলা হয়, যদি এ কাগজ হানাদারদের হাতে পড়ে, তবে ওরা একে পাগলের আঁকিবুকি ছাড়া আর কিছুই ভাববে না।’
জাহানারা ইমামের বাসায় হামলা হয়েছিল। সেই আক্রমণেই গ্রেপ্তার হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধা রুমী। গ্রেপ্তার হলেন শরীফ সাহেব। তবে জাহানারা ইমামের দিনলিপির খাতা সেদিন রক্ষা পেয়েছিল। ‘বিচিত্রা’র সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরী, ‘সচিত্র সন্ধানী’র সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দীন—এঁদের কাছে অন্য সব পাঠকের মতো আমি অসীম কৃতজ্ঞতা বোধ করছি। যখন জাহানারা ইমামকে জিজ্ঞাসা করি, ‘কেমন করে আপনি “একাত্তরের দিনগুলি” তৈরি করলেন, তখন গভীর মমতা নিয়ে তিনি বললেন, ‘এর জন্য দায়ীতো “বিচিত্রা” সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরী, “সচিত্র সন্ধানী”র গাজী শাহাবুদ্দীন, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী—এঁরা। ’৭১-এর পর আমার শরীর ও মনেরতো চরম বিপর্যস্ত অবস্থা চলছিল। আমি কেবল রুমীর পথ চেয়ে থাকি। রুমী ফিরে আসবে। কিন্তু রুমী আর আসে না। আমি ছিলাম সেই একচক্ষু হরিণীর মতো। একচক্ষু হরিণী সমুদ্রের দিকে ওর কানা চোখটা রেখে ডাঙার দিকে রেখেছিল ভালো চোখটা। ও ভেবেছিল, বিপদ আসবে ডাঙার দিক থেকে, সমুদ্রের দিক থেকে নয়। ওর কী হয়েছিল, তা আমি জানি না। কিন্তু আমার বিপদতো দুদিক থেকেই এল। রুমী দুরন্ত। রুমী ভবিষ্যতের দিকে দ্রুতবেগে ছুটে যেতে চায়। ওকে আমি হারাতে পারি সে আশঙ্কা আমার ছিল। তাই উদ্বিগ্ন চোখ রেখেছিলাম কেবল ওর দিকে। রুমীর আব্বা শরীফের দিকে ছিল আমার কানা চোখ আর বিশ্বাস। এদিক থেকে বিপদ আসবে, কল্পনা করিনি। অথচ রুমী আর ওর আব্বাকে হানাদাররা ধরে নিয়ে যাওয়ার পর নির্মম অত্যাচার করে রুমীর আব্বাকে ফেরত দিলেও শরীফের শরীর ভেঙে পড়ল। বিশ্বাস হতে না চাইলেও শরীফ আর আমিতো জানতাম, রুমীর কী হয়েছে। কিন্তু আমার চেয়েও শরীফের বেদনা অনেক বেশি দুঃসহ। এমপি হস্টেলে ওর বুক থেকেইতো ছিনিয়ে নিয়েছে রুমীকে জল্লাদের দল। তারপর রুমীকে কীভাবে হত্যা করেছে, তা কল্পনা করা ছাড়া আমাদের আর জানারতো কোনো উপায় ছিল না। সেই দুঃসহ কল্পনাতেই শরীফের ওপর আঘাত এল। একদিন মূর্ছিত হয়ে পড়ল। তারপর ১৪ ডিসেম্বর হাসপাতাল থেকে ফিরে এল এক নিষ্প্রাণ দেহ হয়ে। কানা চোখ হরিণী আমি। আমার বিপদ এল দুদিক থেকেই।’
‘এমন অবস্থায় ’৭২ থেকে ’৮২ কিংবা ’৮৪ পর্যন্ত ’৭১-এর দিনলিপিগুলোর ওপর যখনই চোখ বুলিয়েছি, তখনই কেবল কান্নায় ভেঙে পড়েছি। বোধহয় ’৮৪ কি ’৮৫–তে শাহাদাত এসে বলল, “আম্মা, আপনাকে একাত্তরের কাহিনি লিখতে হবে। আপনার ডায়রির ভিত্তিতে।’
রুমী-হারানো জননী অনেক সন্তানকে ফিরে পেয়েছেন। বললেন, ‘শাহাদাত ওরাতো আমার রুমীর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে ছিল। তার সঙ্গে অ্যাকশন করেছে। রুমী ফেরেনি। কিন্তু ওরা ফিরে এসে আমায় অক্লেশে ‘আম্মা’ বলে ডাক দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। ওদের দাবিতেই আমাকে একাত্তরের দিনলিপি দিয়ে তৈরি করতে হয়েছে “একাত্তরের দিনগুলি”।’
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম
আমি বললাম, ‘“একাত্তরের দিনগুলি” দেশ-কালের বেড়া ডিঙিয়ে কতদূর যে বিস্তারিত হয়েছে, তা কি আপনি জানেন না জাহানারা ইমাম? পশ্চিম বঙ্গের জনপ্রিয় কবি এবং উপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘পূর্ব-পশ্চিম’-এ আপনার নাম, রুমীর নাম উল্লেখ করে ‘একাত্তরের দিনগুলি’র ওপর নির্ভর করে তৈরি করেছেন।
জাহানারা ইমামের মুখ কথাটিতে আনন্দিত হয়ে উঠল। বললেন, ‘সুনীলও এসে বললেন একবার, “মুক্তিযুদ্ধের ছেলেরা সকলে আপনাকে আম্মা বলে। আমিও আপনাকে আম্মা বলব। আমি কতবার পড়েছি আপনার “একাত্তরের দিনগুলি”। যতবার পড়েছি, ততবার আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে, আবেগ আর বেদনার অশ্রুতে। আমিও আপনাকে “আম্মা” বলে ডাকব।’
মানুষের বাস্তব জীবন কল্পনারও কত অধিক। একাত্তরের ফেব্রুয়ারিতেও আমরা একাত্তরের মার্চকে কল্পনা করতে পারিনি। এবং একাত্তরের ১ কিংবা ৭ মার্চ যে জাহানারা ইমাম, তাঁর স্বামী শরীফ সাহেব, টগবগে ফুটফুটে ছেলে রুমী গাড়িতে ঘুরে ঘুরে, রিকশায় চড়ে চড়ে শেষ সাহেবের মিটিং দেখেছেন, বাড়িতে ঘটনার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ আর বিতর্কে পরস্পর খুনসুটি করেছেন, তাঁরা কল্পনা করতে পারেননি তাদের জীবনের পরবর্তী ঘটনাবলিকে। আর সব মিলিয়ে জাহানারা ইমামের নিজের যে রূপান্তর, তা–ও তাঁর কল্পনাকে অতিক্রম করে গেছে।
আমি আলাপ শেষে ওঠার আগে কথাটা তুলেছিলাম। ‘একাত্তরের দিনগুলি’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক টেস্টমেন্ট বিশেষ। দলিল। কেবল তা–ই নয়। এ সততায়, সত্যে, আবেদনে, পরিমিতিতে, সংযমের অত্যাশ্চর্য প্রকাশে একখানি আকর গ্রন্থের রূপ ধারণ করেছে। বাংলাদেশের হাজার হাজার পাঠকের ঘরে এ গ্রন্থ আজ রক্ষিত। রক্ষিত হওয়ার মতো গ্রন্থ। বাংলাদেশে কততো পুরস্কার আর সম্মান প্রদানের প্রতিষ্ঠান আছে। বাংলা একাডেমি আছে। খোদ সরকার আর রাষ্ট্রীয় পদকের কথা বাদই দিলাম। কিন্তু বাংলা একাডেমির তরফ থেকে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ এবং তার লেখককে কি উপযুক্ত কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে? প্রশ্নটা আমার মনে অনেক দিন থেকেই জাগছিল। আমি দ্বন্দ্বে ছিলাম। হয়তো দিয়েছে। আমি জানি না। কিংবা হয়তো দেয়নি। জাহানারা ইমামকে এ কথা জিজ্ঞাসা করতে আমার সংকোচ হচ্ছিল।
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম
তবু প্রশ্ন করতে বললেন, ‘আমার বড় পুরস্কারতো অগণিত তরুণপ্রাণ পাঠকের কৃতজ্ঞতা। তারা পড়েছে এই বইখানা। তারা এখনো নানাভাবে, নানা উপঢৌকনে, নানা প্রশংসায় তাদের মনের আবেগের প্রকাশ দিয়ে আমাকে আপ্লুত করে দিচ্ছে। তাদের ভালোবাসার শেষ নেই। বাংলা একাডেমির কথা আপনি জিজ্ঞাসা করাতে আমি বিব্রত বোধ করছি। তার মহাপরিচালক বয়সে আর প্রীতিতে আমার স্নেহাস্পদ । এ বই তিনি পাঠ করেছেন। তাঁর ভালো লেগেছে। তাতেই আমি খুশি হয়েছি। এ তাঁর ব্যক্তিগত প্রকাশ।’
আমি বুঝলাম, আমার কথাটা জিজ্ঞাসা করা সংগত হয়নি। আর তা ছাড়া ‘একাত্তরের দিনগুলি’কে প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলা একাডেমি কিংবা বাংলাদেশের বর্তমান সরকার স্বীকৃতি জানাবে, তাকে অধিকতরসংখ্যক পাঠক সাধারণের কাছে লভ্য করে তুলবে, এমন যদি বাস্তব পরিস্থিতি হত, তাহলে একাত্তরের পরবর্তীকালে যে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং নৈতিক সংকট এমনিভাবে ঘনীভূত হচ্ছে, সে পরিস্থিতি হয়তো সৃষ্টি হত না । এখনো যদি জাহানারা ইমামকে সরকার তাদের প্রচুর খাদমিশ্রিত স্বর্ণের, তথা সম্মানের একটি পদক প্রদান করে, তবে তাও করা হবে ‘একাত্তরের দিনগুলি’কে ম্লান করারই জন্য। তাকে উজ্জ্বল করার জন্য নয়। তাই জাহানারা ইমাম যে আজও বাংলা একাডেমি কিংবা বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো স্বীকৃতি বা সম্মান লাভ করেননি, তাতে এখন আর আমি দুঃখবোধ করি না। এবং এ প্রশ্নে জাহানারা ইমামের জবাবটিতে আমি অনুপ্রাণিত বোধ করেছি। জাহানারা ইমাম, আমার উঠে আসার আগে বললেন, ‘আমি মাটির প্রদীপ। আমার কর্তব্যটুকু সলতের শেষ তেলবিন্দুটি পর্যন্ত করে যাওয়ার চেষ্টা করব। তাতেই আমার সার্থকতা।’
ওঠার আগে আমি আবার রুমীর সামরিক পোশাক পরা তেলচিত্রটির দিকে তাকালাম। ২০-২২ বছরের তরুণ। কোমরের বেল্টে হাত গুজে, মাথায় সামরিক টুপি পরে দূরের দিকে আত্মবিশ্বাসের চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে ।
গেরিলা যোদ্ধা রুমী স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্ত আলোয় এমন পোশাক পরতে পারেনি। এমন পোশাকে রুমী, তার আম্মার নিশ্চয়ই কল্পনা। কিন্তু আপনি ঘরে ঢুকলে এই রুমীর দিকে না তাকিয়ে পারবেন না। রুমীর পোরট্রেটটির নিচে উৎকীর্ণ রয়েছে কবি জীবনানন্দ দাশের এই উক্তিটি— ‘আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়।’
রুমীর আম্মা যথার্থই বিশ্বাস করেন তাঁর রুমী আবার, ‘আসিবে ফিরে এই বাংলায়।’
‘রুমীর আম্মা ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ - সরদার ফজলুল করিম বইটির প্রকাশ করেছিল জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ