'লোকজন বই পড়ে না'
লোকজন বই পড়ে না, কথাটি পুরোটা সত্য নয়। আংশিক সত্য। তাই আসুন আলোচনা করি, কি পড়ে, কোন ধরনের বই পড়ে সেটাই এখানে চিন্তার খোরাক হতে পারে। হয়ত আমার, আপনার পছন্দের বই পড়ে না। প্রতিটি পাঠকের নিজস্ব পছন্দ-অপছন
বইয়ের হাট এর ফেসবুক গ্রুপে রুমান শরীফ একটি প্রশ্ন ছুড়েছেন, 'লোকজন বই পড়ে না'। তাঁর প্রশ্নের আলোচনা করতে গিয়েই আমার এই লেখাটি।
'লোকজন বই পড়ে না'। এই কথাটি বহু পুরনো। প্রথম সেই কথাটিতে আসি। রবীন্দ্রনাথও বলেছেন যে কেউ বই পড়ে না। তাঁর 'বাংলা লেখক' প্রবন্ধে বলছেন,
"লেখকদিগের মনে যতই অভিমান থাক্, এ কথা অস্বীকার করিবার জো নাই যে, আমাদের দেশে পাঠক-সংখ্যা অতি যৎসামান্য। এবং তাহার মধ্যে এমন পাঠক "কোটিকে গুটিক' মেলে কি না সন্দেহ, যাঁহারা কোনো প্রবন্ধ পড়িয়া, কোনো সুযুক্তি করিয়া আপন জীবনযাত্রার লেশমাত্র পরিবর্তন সাধন করেন। নির্জীব নিঃস্বত্ব লোকের পক্ষে সুবিধাই একমাত্র কর্ণধার, সে কর্ণের প্রতি আর কাহারও কোনো অধিকার নাই।
পাঠকের এই অচল অসাড়তা লেখকের লেখার উপরও আপন প্রভাব বিস্তার করে। লেখকেরা কিছুমাত্র দায়িত্ব অনুভব করেন না। সত্য কথা বলা অপেক্ষা চতুর কথা বলিতে ভালোবাসেন। সুবিজ্ঞ গুরু, হিতৈষী বন্ধু, অথবা জিজ্ঞাসু শিষ্যের ন্যায় প্রসঙ্গের আলোচনা করেন না, কূটবুদ্ধি উকিলের ন্যায় কেবল কথার কৌশল এবং ভাবের ভেলকি খেলাইতে থাকেন।
এখন দাঁড়াইয়াছে এই-- যে যার আপন আপন সুবিধার সুখশয্যায় শয়ান, লেখকদিগের কার্য, স্ব স্ব দলের বৈতালিক বৃত্তি করিয়া সুমিষ্ট স্তবগানে তাঁহাদের নিদ্রাকর্ষণ করিয়া দেওয়া।
মাঝে মাঝে দুই দলের লেখক রঙ্গভূমিতে নামিয়া লড়াই করিয়া থাকেন এবং দ্বন্দ্বযুদ্ধের যত কৌশল দেখাইতে পারেন ততই নিজ নিজ সম্প্রদায়ের নিকট বাহবা লাভ করিয়া হাস্যমুখে গৃহে ফিরিয়া যান।
লেখকের পক্ষে ইহা অপেক্ষা হীনবৃত্তি আর কিছু হইতে পারে না। এই বিনা বেতনে চাটুকার এবং জাদুকরের কাজ করিয়া আমরা সমস্ত সহিত্যের চরিত্র নষ্ট করিয়া দিই।
মানুষ যেমন চরিত্রবলে অনেক দুরূহ কাজ করে, অনেক অসাধ্য সাধন করে, যাহাকে কোনো যুক্তি, কোনো শক্তির দ্বারা বশ করা যায় না তাহাকেও চরিত্রের দ্বারা চালিত করে, এবং দীপস্তম্ভের নির্নিমেষ শিখার ন্যায় সংসারের অনির্দিষ্ট পথের মধ্যে জ্যোতির্ময় ধ্রুব নির্দেশ প্রদর্শন করে-- সাহিত্যেরও সেইরূপ একটা চরিত্র আছে। সে চরিত্র, কৌশল নহে, তার্কিকতা নহে, আস্ফালন নহে, দলাদলির জয়গান নহে, তাহা অন্তর্নিহিত নির্ভীক, নিশ্চল জ্যোতির্ময় সত্যের দীপ্তি।
আমাদের দেশে পাঠক নাই, ভাবের প্রতি আন্তরিক আস্থা নাই, যাহা চলিয়া আসিতেছে তাহাই চলিয়া যাইতেছে, কোনো কিছুতে কাহারও বাস্তবিক বেদনাবোধ নাই; এরূপ স্থলে লেখকদের অনেক কথাই অরণ্যে ক্রন্দন হইবে এবং অনেক সময়েই আদরের অপেক্ষা অপমান বেশি মিলিবে।
এক হিসাবে অন্য দেশ অপেক্ষা আমাদের এ দেশে লেখকের কাজ চালানো অনেক সহজ। লেখার সহিত কোনো যথার্থ দায়িত্ব না থাকাতে কেহ কিছুতেই তেমন আপত্তি করে না। ভুল লিখিলে কেহ সংশোধন করে না, মিথ্যা লিখিলে কেহ প্রতিবাদ করে না, নিতান্ত "ছেলেখেলা" করিয়া গেলেও তাহা "প্রথম শ্রেণীর" ছাপার কাগজে প্রকাশিত হয়। বন্ধুরা বন্ধুকে অম্লানমুখে উৎসাহিত করিয় যায়, শত্রুরা রীতিমতো নিন্দা করিতে বসা অনর্থক পণ্ডশ্রম মনে করে।
সকলেই জানেন, বঙালির নিকটে বাংলা লেখার, এমন-কি লেখামাত্রেরই এমন কোনো কার্যকারিতা নাই, যেজন্য কোনোরূপ কষ্ট স্বীকার করা যায়। পাঠকেরা কেবল যতটুকু আমোদ বোধ করে ততটুকু চোখ বুলাইয়া যায়, যতটুকু নিজের সংস্কারের সহিত মেলে ততটুকু গ্রহণ করে, বাকিটুকু চোখ চাহিয়া দেখেও না। সেইজন্য যে-সে লোক যেমন-তেমন লেখা লিখিলেও চলিয়া যায়।"
লোকজন বই পড়ে না, কথাটি পুরোটা সত্য নয়। জনশুমারি ২০২২ এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে বর্তমানে স্বাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত প্রায় ১ কোটি ১৫ হাজার জন শিক্ষার্থী। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৩৯ লক্ষ, মাদ্রাসা শিক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ, প্রফেশনাল শিক্ষায় মোট শিক্ষার্থী ৮০ হাজার, কারিগরি শিক্ষায় মোট শিক্ষার্থী প্রায় ৬ লাখ। দেশের উচ্চ শিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ৫ লাখ। তো মোটামুটি বই পড়ার মতো মেধা রয়েছে মোটের উপরে ২ কোটির একটু বেশি মানুষের। সেখানে আমরা কত শতাংশ আশা করতে পারি সৃজনশীল পড়ুয়া। তাই আমার মনে হয় লোকজন বই পড়ে না, কথাটি পুরোটা সত্য নয়। আংশিক সত্য। তাই আসুন আলোচনা করি, কি পড়ে, কোন ধরনের বই পড়ে সেটাই এখানে চিন্তার খোরাক হতে পারে। হয়ত আমার, আপনার পছন্দের বই পড়ে না। প্রতিটি পাঠকের নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দের বিষয় আছে।
আপনার লেখাটি পড়ে আমি চ্যাটজিপিটিকে জিজ্ঞাস করলাম সুইডেনের লোকজন কেন বই পড়ে না? সে আমাকে মোটামুটি এই একি রকম উত্তর দিলো। চ্যাটজিপিটি তো একটা ইন্টারফেস মাত্র। এরও অনেক আগে থেকে জিপিটি ২, ৩ ও ডিপমাইন্ড নিয়ে কাজ করেছি নিজের পেশাগত কাজে, তাই চ্যাটজিপিটির সীমাবদ্ধতার কথা আমার জানা। সেটা এখানে আলোচনার মূল ক্ষেত্র নয়। তাই ওর কথা বাদ রাখছি।
বই পড়ার অভ্যাস বদলেছে, বিষয় বদলেছে, সেই সুবাধে পাঠকের রুচি বদলেছে। সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদে লেখকেরা কি আমাদের বিচিত্রপূর্ণ লেখা দিতে পারছেন? যদি না পারেন তাহলে পাঠক পড়বে কেন? নতুন প্রজন্মের পাঠক নতুন ধরনের বই চায়। নতুন বিষয়ের বই চায়। মূল কথা ভালো বই চায়। উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় এই ভালো বই কে বলেছেন, "সৎ বই—অর্থাৎ সুলিখিত সাহিত্য-শিল্পসমৃদ্ধ বই, অসৎ বস্তুর মালিন্য থেকে যে বই মুক্ত। এবং অসৎ বস্তু অর্থে আমি বলতে যাচ্ছি সেই সমাজবিরোধী অশ্লীল কার্যকলাপের অপরিমিত বিলসন, যা পাঠকচিত্তকে খুশি যত-না করুক, তাকে বহুগুণে করে উত্তেজিত।" আজও ফেলুদার বই প্রচুর বিক্রি হয় দুই বাংলাতেই। হুমায়ুন আহমদের বই এখনো বইমেলায় বিক্রির শীর্ষে থাকে। আমাদের দেশের নতুন লেখকদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন লেখক ছাড়া সবাই হিপোক্রেট। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অনেক আগেই সাবধান করেছেন, "যা সত্যই জানো না, তা কখনো লিখো না। যাকে উপলব্ধি করোনি সত্যানুভূতিতে যাকে আপন করে পাওনি, তাকে ঘটা করে ভাষার আড়ম্বরে ঢেকে পাঠক ঠকিয়ে বড়ো হতে চেয়ো না।.....আপন সীমানা লঙঘন করাই আপন মর্যাদা লঙঘন করা।" কোনও সৃষ্টির মধ্যে যদি অন্তর্নিহিত শক্তি না থাকে, তাহলে শুধু চোখধাঁধানো মনভোলানোর জাদুতে দিনের পর দিন পাঠককে মজিয়ে রাখা যায় না।
পুরনো লেখকদের বই কেউ পড়ে না কারণ তারা ক্লাসিক। এখনকার বাস্তবতার সাথে মিল নেই। সকলেই তো আরা মার্কেজ বা রবিঠাকুর নয়। মার্ক টোয়েনের সেই কথাটি মনে হচ্ছে, ক্লাসিক বইয়ের সকলে প্রশংসা করে কিন্তু কেউ পড়ে না। প্রতিবছর বইমেলার হিসেব অনুযায়ী কোটি কোটি টাকার বই বিক্রি হচ্ছে, এই সব বই যাচ্ছে কই? একজন প্রকাশক যখন আনন্দে বলছেন এবার বইমেলায় তাঁর বেশ ভালো বিক্রি হয়েছে আবার সাহিত্যের আড্ডায় বলছেন "লোকজন বই পড়ে না" তাহলে এদের হিপোক্রেট ছাড়া আর কি বলবো? আমাদের জীবনে মাতামাতি করার মতো জিনিসের অভাব নেই। কিন্তু বই নিয়ে অমর একুশের মেলার মত্ততাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। লোকে বই কিনছে, পড়ার জন্যেই কিনছে।
আমাদের দেশে বই-বিমুখতা যে-ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বই সম্পর্কে অনাগ্রহ বেড়েছে সর্বস্তরে। ছাত্ররা পাঠ্যক্রমের বাইরে আর কিছু পড়ার কথা ভাবতে পারছে না, জীবনযাপন আর একটু উন্নত করার লক্ষ্যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কোনও অতিরিক্ত উপার্জনের পিছনে দৌড়চ্ছে। সামাজ ও রাষ্ট্রের এখানে অনেক কিছু করার আছে। রাষ্ট্র কি করবে জানি না। কিন্তু সামাজিক জীব হিসেবে আমাদের অনেক কিছু করার আছে। কোন এক কেন্দ্রের উপড়ে ভরসা করে বসে থাকলে চলবে না। আমরা যারা বই ভালোবাসি, বইকে আত্মার আত্মীয় মনে করি তাঁদের নিজেদের গণ্ডির ভেতরে যার যেমন সামর্থ সেভাবে বই পড়ার অভ্যাস ও আন্দোলনটা এগিয়ে নিতে হবে। ‘আ গুড বুক ইজ দি বেস্ট অফ ফ্রেন্ডস্, দি সেম টুডে অ্যান্ড ফর এভার’। বইয়ের সাথে আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি জড়িত। 'লোকজন বই পড়ে না' আমি একথা বিশ্বাস করি না। তবু তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই তাই, তাহলে আমার ব্যাক্তিগত যুদ্ধ হবে এই ধসের বিরুদ্ধে, আমার লক্ষ্য হবে বই পড়ার প্রবণতাকে ফিরিয়ে আনা। এই কাজ সফল করার জন্য আমি সকল গ্রন্থপ্রেমিককে পাশে চাই। আপনাকেও!
কি করণীয়ঃ
আমি মনে করি বইপড়া একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা যা প্রত্যেকেরই থাকা উচিত। এটি আমাদের নতুন জিনিস শিখতে, বিভিন্ন সংস্কৃতি বুঝতে এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করতে সহায়তা করে। আমি মনে করি লোকেদের বইপড়াতে উত্সাহিত করা গুরুত্বপূর্ণ। লোকদের পড়াতে উত্সাহিত করার অনেক উপায় আছে। একটি উপায় হল বইগুলিকে আরও সহজলভ্য করা। গিগাবাইট বা তাক ভর্তি বই থাকলেই যে ভালো পাঠক কেউ হয়ে উঠবে তাও না। ভালো পাঠক হয়ে উঠতে হলে চাই চর্চা। জনসাধারণের হাতের নাগালে চাই লাইব্রেরি, বিনামূল্যে বা স্বল্প মূল্যে ই-বুকগুলি সহজলভ্য করা। পড়াকে উত্সাহিত করার আরেকটি উপায় হল এটিকে সামাজিক মিডিয়া এবং অন্যান্য চ্যানেলে প্রচার করা। আমরা আমাদের প্রিয় বইগুলির বই পর্যালোচনা, আলোচনা এবং উদ্ধৃতি ভাগ করতে পারি। আমরা বইপড়ার সুবিধাগুলি এবং এটি আমাদের নিজস্ব জীবনকে কীভাবে সমৃদ্ধ করেছে সে সম্পর্কেও কথা বলতে পারি। আমি বিশ্বাস করি যে যদি আমরা সবাই একসাথে কাজ করি, আমরা বইপড়ার লোকের সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে পার্থক্য করতে পারি। আসুন সবাইকে একটি বই তুলে নিতে এবং আজই পড়া শুরু করতে উত্সাহিত করি!
ধন্যবাদ।