‘জাপানী ভূত’, মাসুদ রানা এবং গণি স্কুলের হক স্যার
সৈয়দ মূসা রেজা | হক স্যার এক নাগাড়ে বোর্ডে লিখছেন আর অঙ্ক বুঝিয়ে চলেছেন। ক্লাসে হালকা চালে ফিসফাসও চলছে। কানে আসছে তবে মনে ঢুকছে না। চোখ ও মনের পুরোটাই জুড়ে রয়েছে তখন ‘জাপানী ভূত।’
অঙ্কের ক্লাস চলছে। ক্লাস নিচ্ছেন হক স্যার। ক্লাসে মন দেওয়ার মতো ‘বাজে’ সময় নেই আমাদের। সিক্স বা সেভেনের ঘটনা। লাস্ট বেঞ্চে বসে গোগ্রাসে গিলছি ‘জাপানী ভূত।’ ভাড়ায় আনা বই ফেরত দিতে হবে। না হলে জরিমানা! আর পাশে বসে মহন পড়ছে মাসুদ রানা। পড়া শেষ হলে বই বদল হবে। মাসুদ রানা প্রথমেই আমি পড়তে চেয়েছিলাম। বইটা ‘জাপানী ভূতের’ চেয়ে মোটাসোটা। পড়তে বেশি সময় লাগবে। ক্লাসের অন্যতম সেরা ছাত্র মহন। বই পড়ার গতি সদ্য চালু হওয়া ঢাকা-চিটাগাংয়ের তুখোড় ট্রেন উল্কার মতোই। আমার অর্ধেক সময়ে ওরকম দুইটা বই পড়ে শেষ করতে পারে মহন। মহনের জন্য এ কাজ শিষ দেওয়া, দুই আঙ্গুলে তুড়ি বাজানো বা হাততালি দেয়ার মতোই ‘কঠিন!’ তাছাড়া, বইটা বাসায় নিতে পারলে রসিয়ে রসিয়ে পড়া যাবে। এক্সপ্রেস ট্রেনের গতিতে গিলতে হবে না। তাই আগে পড়ার লোভ ছাড়তে পারলে আখেরে লাভ বেশি - বিবেচনা করেই বইটা ওকে দেওয়া হয়। এ ছাড়া, মহন, আমার এবং কামালের পাঠ্য বইয়ের তলে লুকান আছে আরও গল্পের বই।
হক স্যার এক নাগাড়ে বোর্ডে লিখছেন আর অঙ্ক বুঝিয়ে চলেছেন। ক্লাসে হালকা চালে ফিসফাসও চলছে। কানে আসছে তবে মনে ঢুকছে না। চোখ ও মনের পুরোটাই জুড়ে রয়েছে তখন ‘জাপানী ভূত।’
সে সময় বাজার মাত করে ফেলেছে কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা। কুয়াশা। লাইলি প্রেমিক মজনুর ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষা করি কখন আসবে এ দুই সিরিজের নতুন বই। মাসুদ রানা প্রথম পড়তে দিয়েছিল কামাল। নীহারঞ্জন গুপ্তের বইও প্রথম আমাদের যুগিয়েছিল ওই। ওর ছিল বিশাল এক টিনের তোরঙ্গ। আর সেটা বোঝাই ছিল ‘নভেলে।’ ওই ভাণ্ডারের বেশির ভাগই ছিল ডিটেকটিভ বই। ওর বাসায় যাইনি কখনো। কথাটা বলেছিল বসির বা ইত্তেহাদ। ওদের সাথেই কামালের ‘বিড়ি ফুঁকার’ গভীরতা ছিলও।
আমাদের ক্লাসে, নাকি গোটা স্কুলে এমনকি শহরে, পাঠ্য বইয়ের চেয়ে অ-পাঠ্য বই মানে তখনকার প্রচলিত কথায় ‘নাটক-নভেলের’ প্রতি দুর্দমনীয় টান ছিল তাদের মধ্যে প্রথম কাতারে ছিলাম আমি, মহন, খলিল, কামালসহ আরও দুয়েকজন। পাঠ্যবই বাদ দিয়ে ‘নাটক-নভেল’ দিনরাত নাওয়া-খাওয়া ভুলে নাক ডুবিয়ে বসে থাকাকে সে সময় অনেকেই ভালো চোখে দেখতেন না। এমনকি এর বিরোধিতাও করতেন অনেক অভিভাবক। বিরোধিতার ভাষা মোটেও মোলায়েম ছিল না। কাকের ডাক, ট্রাকের হর্নের চেয়েও কর্কশ ছিল। এদিক থেকে আমার বাসায় পাঠ্যসূচির বাইরের বই পড়াকে উৎসাহিত করা হতো। তবে ডিটেকটিভ বইয়ের বিষয়ে কিছু মানা ছিল। সে মানাকে লুকিয়ে ডিটেকটিভ বইয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে উদার সহায়তা করেছে কামাল। ওই আমাদেরকে প্রথম নর-নারী নামের প্রাপ্তবয়স্কদের সাময়িকীও পড়তে দিয়েছিল।
মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার আগেই কামালের বাবা বদলি হয়ে যায়। ওরা চাঁদপুর ছেড়ে চলে যায়। শুনেছি অনেক দিন কুমিল্লায় ছিল। এরও অনেক পরে প্রথম সংখ্যা রহস্য পত্রিকায় কামালের ছবিসহ চিঠি ছাপা হয়েছিল। কিন্তু কামালের সঙ্গে আমার আর দেখা হয় নি।
সে দিন গল্পের বই পড়ার ফাঁকে হঠাৎ খেয়াল করলাম ক্লাসের সব ফিসফাস, স্যারের গলা সবই থেমে গেছে। চলন্ত গাড়ি থেমে গেলে জেগে ওঠে ঘুমন্ত যাত্রী। সে ভাবে পড়া বাদ দিয়ে ‘জেগে’ উঠলাম! কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে অনেক। সামনে দাঁড়িয়ে আছে যমদূত! স্বয়ং হক স্যার!
ক্লাসে বয়ে গেলো কালবৈশাখী। সবার বইখাতায় চলল তল্লাশি। গল্পের সব বই বাজেয়াপ্ত করা হলো। হক স্যার ঘোষণা করলেন,- হেড স্যারকে দেওয়া হবে এগুলো।
মাসুদ রানার ভাষায় মেরুদণ্ড দিয়ে শিরশির করে শীতল স্রোত বয়ে গেলো। হেডস্যারের কাছে এ সব বই দেওয়া হলে তিনি জানাবেন আব্বাকে। তারপর? হ্যাঁ তারপর কি হবে? আসন্ন সেই ভবিষ্যত কিয়ামত ডেকে আনবে। এর বেশি কিছু ভাবতেই পারছিলাম না।
একদিন দুইদিন পাঁচদিন সাতদিন এক সপ্তাহ করে করে একমাস গেলো। সে নালিশের কোনো ফল দেখতে পেলাম না। এর মধ্যে ভাড়া বইগুলোর দাম মিটাতে হলো। আমাদের কাছ থেকে নতুন বইয়ের দামই আদায় করা হয়েছিল। এ জন্য বাজারে হাতসাফাই, মায়ের আঁচল থেকে পয়সা সরানো, নানীর কাছ থেকে পয়সা আদায় করা এবং মুরব্বির চোখ এড়িয়ে পুরানো খাতা-কাগজ বিক্রি করতে হয়েছে। এ টাকা মেটাতে যেয়ে কুয়াশাও কেনা হয় নি। টাকা না দিলে বাসায় নালিশ করবে বলে হুমকি দিয়েছিল। তাতেই পপাত আমরা!
এ ঘটনার কয়েক বছর পরের কথা। কামাল চলে গেছে। মেট্রিকের আগে প্রিটেস্ট পরীক্ষা আসন্ন। গণি স্কুলের সে সময়কার ঐতিহ্য অনুযায়ী টেস্টে তেমন কড়াকড়ি করা হতো না। তবে প্রিটেস্টে নির্ধারিত নম্বর না পেলে মেট্রিকের জন্য এলাউ করা হতোই না। পাথরে মাথা ভেঙ্গে ফেললেও করা হবে না। এমনি নিয়ম সে সময় চালু ছিল কাদের স্যারের পরিচালিত স্কুলে। চাইলে টিসি নিয়ে অন্য স্কুলে চলে যেতে পারতো ‘ফেলুদারা।’ প্রিটেস্টকে আজরাইলের থাবার মতো কঠোর করার কারণ ছিল। সে সময়ে টিসি নিয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ থাকতো। কিন্তু টেস্টের পর সে সুযোগ একেবারেই থাকত না। কাজেই প্রিটেস্টের আগে ছাত্রদের সবার মাথাই একটু গরম থাকতো।
এই প্রিটেস্টের কিছু আগে, হক স্যারের কাছে গেলাম আমি ও মহন। কেনো গেছিলাম মনে নেই। সাধারণত কোনো বড় ধরনের কাজ না থাকলে টিচার্স রুমের ছায়া থেকে দূরে থাকতাম আমরা। স্যার তার ডেক্স খুললেন। সেখানেই দেখা মিলল বাজেয়াপ্ত সেই সব বই। সবার উপরে চকচক করছে মাসুদ রানা! সাহস করে স্যারকে বললাম, স্যার বইগুলো ফেরত দিয়া দেন।
-সবগুলোতো তোগো বই না।
-জি স্যার। কিন্তু বইগুলোর দাম আমাদেরকেই দিতে হইছে। আর কামালতো নেই।
-আইচ্ছা। কাইল নিস। এটা একটু পইড়া দেখি। বলতে বলতে মাসুদ রানা হাতে তুলে নিলেন। বইটা ছিল, যতদূর মনে পড়ে, “স্বর্ণমৃগ”।
পরের দিন সত্যিই মাসুদ রানাসহ সব বই আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছিলেন স্যার। মাসুদ রানা নিয়ে কোনো কথা বলেন নি আমাদের।
গণি স্কুলের ছাত্রদের চোখের মণি ছিলেন হক স্যার। ছাত্রদের অপদস্থ হতে হয় এমন কাজ করেন নি তিনি কখনোই। শাসন করেছেন। কখনো কখনো কড়া দাগে বেত চালিয়েছেন। কিন্তু না অপদস্থ করেন নি। অপদস্থ হতে দেন নি। কোন গুণের কল্যাণে স্যার ছাত্রদের চোখের মণি হয়ে উঠেছিলেন তা বুঝতে কারোই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।