একটা কাহিনী কি এমনি এমনি বলা হয়ে যায়? না তার জন্য কিছুটা হলেও প্রস্তুতি লাগে? এই যে মানুষ এত এত উপন্যাস লিখে ফেলে, আমি অবাক হয়ে যাই। এত গল্প মানুষের মধ্যে জন্মায় কি করে?
আমার কষ্ট হয়, খুব কষ্ট হয়, মানুষ কবিতার কথা কেন এত কম বলে? কবিতার থেকে বড় আশ্রয় আজ অবধি পেলাম না কোথাও। মানুষের সব সৃষ্টি কোথাও যেন কিছুমাত্র হলেও স্রষ্টার ইচ্ছানুযায়ী চলে। কবিতা চলে না। কবিতা ভীষণ নির্মম। ভীষণ অভিমানী। ভীষণ আত্মমগ্ন।
আমি ঈশ্বরে বিশ্বাসী, সে শুধু কবিতাকে বিশ্বাস করি বলে। যে ঈশ্বরের গল্পে কবিতা নেই, সে ঈশ্বর আমার কাছে পড়ন্ত বেলার রোদ। মিলিয়ে যেতে যতক্ষণ। আমি গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে, বক্তৃতায়, অভিনয়ে, সিনেমায়, সঙ্গীতে শুধুমাত্র কবিতা খুঁজি। নিঃশব্দ কবিতারা আমায় রাতদিন ঘিরে থাকে। আমায় ঘিরে ঘিরে কথা বলে। আমি তাদের ভাষায় আমার কবিতা লিখতে চাই। পাই না, হাতড়ে মরি শব্দ, হাতড়ে মরি উপমা, হাতড়ে মরি কমা, দাড়ি, সেমিকোলন, মাত্রা, ছন্দ... কখনও বিদ্যুতের চমকের মত ধরা দেয়, বেশির ভাগ সময়েই পাই না। কি অসহ্য যন্ত্রণা রাতদিন সবক'টা স্নায়ু ঘিরে! রাতদিন শব্দের দরজায় হত্যে দিয়ে পড়ে থাকি, গভীর জঙ্গলে বাঘ দেখার তীব্র ঔৎসুক্য নিয়ে অপলক চেয়ে থাকি, একটা শব্দের জন্য। যা আমার কবিতায় দেবে, পাই কই?
আমার আশ্রয়, আমার আস্থা, আমার বিশ্বাস, আমার আশা, ভরসা সব কিছু কবিতা। কবিতা আমি কারোর সামনে পড়ি না। কবিতার সঙ্গে আমার নিষিদ্ধ সুখ। কবিতা যখন আসে, যেন স্নান সেরে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, বিবস্ত্রা। তার নগ্নতায় যেন শুধু আমারই অধিকার, কেউ যেন তার এলোচুল, তার স্নিগ্ধ সৌরভ, গভীর চোখের মণির দিকে না তাকায়। সে আমার, শুধু আমারই। আমি ডুবে যাই। আমার সামনে খোলা বইয়ের পাতায় লেখা কয়েকটা শব্দে, মাত্র কয়েকটা শব্দে আমার যুগান্তরের মৌন স্নায়ু ভাষা পায়। আমি কাঁদি। আমি গভীরে কাঁদি। আমার সমস্ত স্নায়ু ভিজে যায় আমার মুগ্ধতায়, আমার স্নানে। যেন মহাকাশ এসে বসেছে একটা প্রজাপতি হয়ে আমার বোধের জানলায়, জ্যোৎস্না মাখামাখি হয়ে, আলো আঁধারিতে স্পষ্ট-অস্পষ্ট তার রূপ। আমি আমাকে খুঁজে পাই। আমার মধ্যে জাগা অনন্ত তৃষ্ণাকে দেখি ঘাসের মত সত্য। আমি অনুভব করি আমি অনন্ত। আমার ক্ষয় নেই। আমার সীমা নেই। এ সমস্ত সৃষ্টি আদতে তো একটা কবিতা। একটা গোটা কবিতার কয়েকটা ছোটো ছোটো শব্দ, দাড়ি, কমা আমরা। রবীন্দ্রনাথ হয় তো একটা সম্পূর্ণ বাক্য। তবু সে একটা বাক্যই মাত্র।
আমি একবার লিখেছিলাম, আমি কবিতা পড়ার সময় কবির নাম দেখি না। সত্য অর্থেই দেখি না। ওই যে বললাম, কবিতা ভীষণ স্বতন্ত্র। খ্যাতনামা কি অখ্যাত কোনো কবির ধার সে ধারে না। কোন হৃদয়ে সে প্রতিভাত হবে সে বোধ করি তার হৃদয়ও জানে না। নইলে এ কবিতা জন্মায় কি করে?
আমার মাঝে তোমারি মায়া জাগালে তুমি কবি।
আপন-মনে আমারি পটে আঁকো মানস ছবি॥
তাপস তুমি ধেয়ানে তব কী দেখ মোরে কেমনে কব,
আপন-মনে মেঘস্বপন আপনি রচ রবি।
তোমার জটে আমি তোমারি ভাবের জাহ্নবী॥
তোমারি সোনা বোঝাই হল, আমি তো তার ভেলা--
নিজেরে তুমি ভোলাবে ব'লে আমারে নিয়ে খেলা।
কণ্ঠে মম কী কথা শোন অর্থ আমি বুঝি না কোনো,
বীণাতে মোর কাঁদিয়া ওঠে তোমারি ভৈরবী।
মুকুল মম সুবাসে তব গোপনে সৌরভী॥
এ কোন কবিকে উদ্দেশ্য করে বলা? জানি না। কিম্বা হয় তো জানি। জীবনের সব সুখ-দুঃখে ভরা অভিজ্ঞতাগুলোকে যে আমার চিত্তের মধ্যে সাজিয়ে সাজিয়ে আমায় তৈরি করছে, সেকি কবি নয়? নইলে তার এত তৃষ্ণা কেন কবিতার প্রতি? চিত্তে যখন সঞ্চয়ের তৃষ্ণা, তখন সে বাইরে তাকিয়ে, স্রোতের ভাঙাগড়ায় ভাসছে উঠছে, সেই চিত্ত যখন সারাদিনের সঞ্চয় নিয়ে একা বসল, তখন সে কবি। সে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে তার কবির দিকে। যে তাকে ছন্দে দীক্ষা দেবে। যে তার সমস্ত সুখ-দুঃখের একটা সুর দেবে, তাকে সার্থক করে যাবে।
আমাদের প্রত্যেকের অন্তরে একজন কবি থাকে। যে বাইরের কবিকে ডেকে ফেরে। খুঁজে ফেরে। প্রত্যেক মানুষের একজন নির্দিষ্ট কবি থাকে। যার নিজস্ব একটা গন্ধ থাকে। সে সেই গন্ধে নিজেকে খুঁজে পায়। ততদিন ধরে চলে তার অন্বেষণ। সেই কবির অন্বেষণ। সেই কবিকে পেলেই সে বলে আজ থেকে আমি মুক্ত, আমি শাশ্বত, আমি নিত্য।
সেই কবিতার খোঁজে, সেই কবির খোঁজেই চলেছি আজও। যা কিছু পাই তার সামনে এসে দাঁড়াই। বিচার করি না। অনুভব করার চেষ্টা করি। কখনও সুরে বাজি, কখনও বাজি না। পরে আসব - বলে আবার সামনের দিকে পা বাড়াই। এই তো চলা। বাকিটুকু তো শুধু সময়ের খাতার পাতা উল্টানোর শব্দ। সেখানে আমিও নেই, তুমিও নেই। আমাদের আমি শুধু কবিতায়। শুধুই কবিতায়।