বাবার বেশ ভালই লাইব্রেরি ছিল। মেজদির বিয়ের পর মন্টিদার লাইব্রেরি তার সঙ্গে জুড়ে একটা বিশাল লাইব্রেরিতে পরিণত হয়েছিল। এ বাড়িতে এসে আমার প্রথম জন্মদিনে মা আমাকে ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ উপহার দেন। বইটা পড়তে পড়তে আমি যেন কোন জগতে চলে গেলাম। আমার মনে হয় পৃথিবীতে যত সেরা বই লেখা হয়েছে ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ তার অন্যতম। এখনও উল্টেপাল্টে দেখি। বারবার পড়েও যেন আশ মেটে না। তার পরের জন্মদিনে পেলাম ‘অ্যালিস থ্রু দ্য লুকিং গ্লাস’। আমাকে পায় কে! আনন্দে আত্মহারা হয়ে বাগানে বসে-বসে পড়তে শুরু করলাম।
লাইব্রেরি থেকেও প্রচুর বই নিয়ে পড়তাম। অ্যাডভেঞ্চারের গল্প আমার খুব ভাল লাগত। আলেকজান্ডার ডুমা-র ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’, ‘কুইনস্ নেকলেস’, তা ছাড়া জুলে ভার্ন, রবার্ট লুইস স্টিভেনসনের বই নিশ্বাস বন্ধ করে পড়তাম। এরপর ডিকেন্সে হাত পড়ল। শুরু হল ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ আর ‘অলিভার টুইস্ট’ দিয়ে। সারাক্ষণ হাতে বই নিয়ে ঘুরতাম।
প্রথম বাংলা বই পড়েছিলাম শরৎচন্দ্রের ‘বিন্দুর ছেলে’। আমার দারুণ ভাল লেগেছিল। এরপর একে একে ওঁর বই পড়তে লাগলাম। এখনও শরৎচন্দ্রের প্রতি আমার প্রচণ্ড দুর্বলতা রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্কিমচন্দ্র পরে পড়েছি। তখনও ওঁদের বই পড়ার বয়স হয়নি।
মানিক যখন কলকাতার বাইরে যেতেন তখন আমিও বাবুকে নিয়ে প্রায়ই বেড়াতে বেৱোতাম। একবার ক্যালকাটা ক্লাব-এ চিলড্রেনস ফ্যান্সি ড্রেস পার্টি হল। আমি বাবুকে পিটার প্যান সাজিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার বন্ধু লক্ষ্মী নিয়ে গিয়েছিল, কারণ ওর স্বামী মোহিত ক্লাবের মেম্বার, মেম্বারের স্ত্রীরা অতিথি নিয়ে যেতে পারেন। মানিক মেম্বার ছিলেন না। ক্লাবের মেম্বার হতে যাবেন কোন দুঃখে। তার থেকে বাড়িতে বসে কাজ করা অনেক ভাল। মেম্বার হলে আমাদের যে অনেক সুবিধা হত, সেটা উনি জানতেন না, আমিও কোনওদিন বলিনি। এ বাড়িতে এসে (বিশপ লেফ্রয় রোড) আমি জোর করে ওঁকে মেম্বার করিয়েছিলাম। বাড়ির এত কাছে—ইচ্ছে করলে লাঞ্চ খেয়ে আসা যায়। গেস্ট এলে বাড়িতে হাঙ্গামা না করে ওখানে খাওয়ানো যায়। ভাল বেকারি আছে, সেখানকার রুটি-কেক কেনা যায়, আর সব থেকে ওঁর যেটা খুব পছন্দ হয়েছিল, লাইব্রেরিটা খুবই ভাল। উনি প্রায়ই লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে আসতেন, আর বলতেন, “ভাগ্যিস মেম্বার হয়েছিলাম। এদের বই-এর স্টক দারুণ।” খেতে যেতে চাইতেন না, কারণ এখানে কড়া নিয়ম ছিল যে, হয় ন্যাশানাল ড্রেস নয় লাউঞ্জ স্যুট এবং স্লিপারের বদলে জুতো পরতে হবে। খুব বিরক্ত হতেন। কারণ নিজে তো পাজামা, পাঞ্জাবি ও চটি পরে সারাজীবন কাটিয়েছেন। শুধু বিদেশে গেলে ভাল স্যুট ও জুতো পরতেন। ভাল টাইয়ের উপর অসম্ভব ঝোঁক ছিল এবং সুন্দর ডিজাইনের স্কার্ফ বা মাফলার। বিদেশ থেকে যখনই ফিরতেন, ২/৩টি নতুন টাই ও মাফলার কিনে আনতেন। আমি অনেকবার বলেছি, “এত টাই আর মাফলার দিয়ে কী হবে? এখানে তো পাজামা পাঞ্জাবি ছাড়া কিছু পরো না। সারা বছরে একবার-দু’বার বিদেশে যাবার জন্য এত টাই আর মাফলারের কী দরকার ?” আমার কথায় কর্ণপাত না করে বলতেন, “দ্যাখো, এই টাইটা কী সুন্দর।” আমি শেষে বলা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কারণ, জানতাম যে কোনও লাভ হবে না। এখনও আলমারিতে বাক্স-বোঝাই টাই আর মাফলার রয়েছে। আমার নাতি শীতের সময় প্রায়ই দাদুর মাফলার ব্যবহার করে। আমার ছেলে কিন্তু তা করে না। ওর পোশাক হল চোস্ত পাজামা এবং লম্বা পাঞ্জাবি, আর শীতের সময় জহরকোট আর শাল। জুতো-মোজার বালাই নেই, বারোমাস কোলাপুরি চটি। ঠান্ডাও লাগে না, আশ্চর্য! শীতের সময় শুটিং থাকলে অবশ্য জিন্স-শার্ট। আর জ্যাকেট পরে।
লেখকের বানানরীতির পরিবর্তন করা হয়নি।