লাইব্রেরি বাঙালির দুর্গ লিখেছেন দেব দত্ত গুপ্ত
বাঙালির পাঠাভ্যাস পৃথিবী-বিখ্যাত। সেকালের বহু বিদুষী পড়তেন রান্নাঘরের তেলের বাতিতে বা উনুনের লাল আঁচের আলোয়। অনেক আমোদিনী বা মানদাসুন্দরী তাঁদের বালিশের তলায় রাখতেন ভবানীচরণ, ‘রাজসিংহ’ কিংবা ‘মেঘদূ
বাঙালির দুর্গ
বাঙালির পাঠাভ্যাস পৃথিবী-বিখ্যাত। সেকালের বহু বিদুষী পড়তেন রান্নাঘরের তেলের বাতিতে বা উনুনের লাল আঁচের আলোয়। অনেক আমোদিনী বা মানদাসুন্দরী তাঁদের বালিশের তলায় রাখতেন ভবানীচরণ, ‘রাজসিংহ’ কিংবা ‘মেঘদূত’। বাঙালির তখন কালাপানির তালিকা বাড়ছে। স্বভাবতই বাড়ির ভিতরেই একটা পাঠাগার ছিল দস্তুর। জোড়াসাঁকো বাড়ি, সিংহিদের বাড়ির অভ্যন্তরীণ লাইব্রেরি তো ছিল চোখ-ধাঁধানো। আরেকটু অতীতে উঁকি দিলে মিলবে নালন্দা মহাবিহারের নিজস্ব পাঠাগারের বিবরণ, মিলবে জৈন ভাণ্ডারগুলোর কথা, যা পূর্ণাঙ্গ পাঠাগার বললে ভুল হয় না। কিন্তু সর্বসাধারণের গ্রন্থাগার দীর্ঘ সময় ধরে নির্মিত হয়নি। তবে, সে অভাব ঘোচাতে উদ্যোগ কিছু কম ছিল না। বাঙালির ভদ্রাসন থেকে কেউ কেউ যুদ্ধ করেই তৈরি করেছেন সে-আমলের এমন সব লাইব্রেরি, যার জুড়ি আজও মেলে না। সাহেবদের ভূমিকাও কিছু কম ছিল না এখানে। কেরি সাহেব, লঙ সাহেবদের অনবদ্য ভূমিকা ছিল এই বাংলায় গ্রন্থাগার তৈরিতে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম বছরে, উইলিয়াম কেরি-র চেষ্টায় শ্রীরামপুরে বই ছাপা শুরু হল। বইপোকা মাত্রেই জানেন শ্রীরামপুর প্রেসের বইয়ের সংগ্রহমূল্য আজ কীরকম। কিছু পরে কেরির সঙ্গে যোগ দিলেন মি. মার্শম্যান এবং মি. ওয়ার্ড। ১৮০০ সালে এঁরা এবং আরও কয়েকজন মিশনারি মিলে তৈরি করলেন শ্রীরামপুর মিশন। ততদিনে অনেক ভাষার বইপত্র প্রকাশ পেয়েছে কেরির ছাপাখানা থেকে। এই সময় এই মিশনের অন্যতম সংগঠক জন ফাউন্টেন-এর তত্ত্বাবধানে মিশনের লাইব্রেরিটি স্থাপিত হল। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠা হল। এবং তখন মিশনের গ্রন্থাগারটি কলেজ-লাইব্রেরি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হল। কলকাতার সেন্ট পল'স ক্যাথিড্রাল-এর বই-সম্ভারের এক বড় অংশ মিশন-গ্রন্থাগারে এসে হাজির হল। ১৯১০-এর পর লাইব্রেরির প্রাচীন গ্রন্থসংগ্রহটি আলাদা করে, উইলিয়াম কেরি স্থাপন করেন। ১৮৭০ সাল পর্যন্ত ভারতে ছাপা প্ৰায় সব ধরনের বই-ই এখানে সংগ্রহ করা হয়েছিল। এখানে দেখা যায় প্রাচীন পত্রপত্রিকার সংগ্রহ। সেই সময় মিশনারিরা ঘুরে-ঘুরে জোগাড় করেছিলেন ‘বৃহৎ কথাসরিৎ সাগর’, ‘দাতাকর্ণোপাখ্যান’, ‘দেবী মাহাত্ম্যচণ্ডী’, ‘গীতাচিন্তামণি’, ‘চৈতন্য চরিতামৃত’, গোবিন্দ দাসের পদাবলি-সহ অসংখ্য পুঁথি। হুগলি জেলায় সেদিনের সেই উদ্যোগ বাঙালি-রেনেসাঁর অন্যতম সহায়ক হয়েছিল। আর কেরির সঙ্গী মার্শম্যান লর্ড বেন্টিঙ্ক-এর কাছ থেকে বেশ কিছু পুস্তিকা পেয়েছিলেন, সেগুলিরও এক অসামান্য সংগ্রহ রয়েছে এখানে। ঠগী, সতী, নবজাত শিশুহত্যার ওপর প্রচুর তথ্য পাওয়া যায় ৷
হুগলি জেলার ‘জয়কৃষ্ণ সাধারণ গ্রন্থাগার' তৈরির ইতিহাসটিও বেশ অন্যরকম। বালি গ্রামের উত্তরে, উত্তরপাড়া গ্রামে এই লাইব্রেরি তৈরি করেন জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। ১৮৩৬ সালে, চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর, উত্তরপাড়ার উন্নতি নিয়ে জয়কৃষ্ণ ভাবনাচিন্তা শুরু করেন। ১৮৪৮ নাগাদ একটি ইংরেজি স্কুল আর একটি ঔষধালয় স্থাপন করেন। এরপর ভাবতে থাকেন একটি লাইব্রেরি তৈরির কথা। সরকারের কাছে আর্থিক সাহায্য চেয়ে আবেদন করেন, কিন্তু সাড়া মেলে না। দমে যাওয়ার পাত্র নন জয়কৃষ্ণ। নিজেই নেমে পড়লেন কাজে। ৮৫,০০০ টাকা খরচ করে হুগলি নদীর তীরে একটি অট্টালিকা তৈরি করলেন। প্রসিদ্ধ পণ্ডিত গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ বিখ্যাত ‘সম্বাদভাস্কর’ পত্রিকায় ১৮৫৭ সালের ২৭ জানুয়ারি লিখলেন, ‘জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় মহাশয় উত্তরপাড়া গ্রামে নিজ ব্যয়ে এক পুস্তকালয় নির্মাণ করাইতেছেন।...বাবু সংকল্প করিয়াছেন সংস্কৃত ভাষায় যত গ্রন্থ পাইবেন সমস্ত আহরণ করিয়া গ্রন্থালয়ে রাখিবেন এবং প্রয়োজনীয় ইংরেজি পুস্তকাদিও থাকিবে, আর বাংলা ভাষায় সমুদয় পুস্তক ও সকল ভাষার সমাচার পত্র এই গ্রন্থালয়ে রাখিবেন।' জয়কৃষ্ণের একক, অক্লান্ত প্রয়াসে সংগৃহীত হয় প্রায় বারো হাজার বই ! এটি এশিয়ার প্রথম নিঃশুল্ক বেসরকারি গ্রন্থাগার। ১৮৬৬ সালের ১৪ জুলাই এই গ্রন্থাগার দেখতে এসেছিলেন বিদ্যাসাগর ও ইংরেজ শিক্ষাব্রতী মেরি কার্পেন্টার। এছাড়াও এই গ্রন্থাগারে এসেছেন উইলিয়াম হান্টার, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, আরও অনেকে। এবং অবশ্যই, মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ‘মধুমান্ অস্তসূর্যঃ’ নিবন্ধে বরুণ চট্টোপাধ্যায় লিখলেন, 'গ্রন্থাগার ভবনটিতে হঠাৎ উৎসবের আমেজ। জয়কৃষ্ণের চোখের ব্যাধি প্রকট হওয়ার পর থেকে তিনি স্বয়ং আর তেমন বাইরে বেরোন না। কিন্তু তাঁর পুত্র প্যারীমোহন ঘনঘন আসছেন লাইব্রেরিতে। ভবনের দ্বিতলে দক্ষিণ-পুব খোলা ঘরটির তদারক করে যাচ্ছেন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। প্যারীমোহনের পুত্র, জয়কৃষ্ণের পৌত্র রাসবিহারী সারা বছরই এই গ্রন্থাগারে দিনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেন। তাঁর বিদ্যানুরাগ প্রসিদ্ধ। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর প্রাণাধিক প্রিয়। প্রকাশিত প্রতিটি গ্রন্থ অতি সযত্নে বাঁধিয়ে তিনি তাঁর নিজের ডেস্কটিতে সাজিয়ে রেখেছেন। সযত্নে বাঁধানো হলেও বইগুলো ঢিলে হয়ে এসেছে। প্রতিদিন একাধিকবার বইগুলো পড়তে পড়তে প্রায় উন্মত্ত হয়ে যান রাসবিহারী। গ্রন্থের সৌষ্ঠবের দিকে নজর দেওয়ার কথা তাঁর মনে থাকে না। তাঁর ব্যক্তিগত আমলা গঙ্গাধর মাইকেলের বইয়ের একাধিক কপি কিনে নিজের কাছে রেখে দেয়। কারণ অধিকাংশ বই-ই রাসবিহারীর অত্যাচারে বেশিদিন আস্ত থাকে না। গঙ্গাধর সন্তর্পণে জীর্ণ কপিটি সরিয়ে নতুন একটি কপি রেখে যায়। অবশ্য স্বয়ং মাইকেল সপরিবার গ্রন্থাগার ভবনে অতিথি হবেন জানার পর রাসবিহারীর নাওয়া-খাওয়া মাথায় উঠেছে। গ্রিক, লাতিন, তামিল ভাষার যাবতীয় মহাকাব্য দিয়ে তিনি মাইকেলের ঘরের শেল্ফটি সাজিয়েছেন। শেক্সপিয়র ও মিলটনের বই যে আছেই তা বলা বাহুল্য। আনা হয়েছে চিনামাটির ডিনার সেট, টি-সেট আর অবশ্যই মহার্ঘ কয়েকটি সুরাপাত্র। একটি আলাদা দেরাজে রাখা আছে খাঁটি ফরাসি দ্রাক্ষাসব। মাইকেলের প্রিয় হুইস্কি রাসবিহারী নিজ হাতে রাখতে পারেননি। ডাক্তার সূর্যকুমার গুডিভ চক্রবর্তী তাঁকে আগেই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন উগ্র কোহল মাইকেলের স্বাস্থ্যের পক্ষে গরল বিশেষ।' আর মাইকেলকে আনার আয়োজন? পাঠানো হয়েছে এমন এক ঘোড়ার গাড়ি, যার ঘোড়াগুলো বিলিতি ওয়েলার, জোরকদমে চলার জন্য খ্যাত। সেই গাড়ি চালাচ্ছে জয়কৃষ্ণের খাস কোচোয়ান হরিহর উড়ে। ঘোড়াকে প্রায় উড়িয়ে চালায় বলে জয়কৃষ্ণ তাকে ‘উড়ে’ উপাধি দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এ নিয়ে প্রায়ই তুলকালাম বাঁধে। বইয়ের পাশে সযত্নে লেখা মার্জিন নোস খুঁজে না পেয়ে রাসবিহারীর মতো শান্ত মানুষও অস্থির হয়ে ওঠেন। মনিবের মন গঙ্গাধর বোঝে। এমন ঘটলেই সে আবার পুরনো কপিটি চুপিসারে মনিবের ডেস্কে রেখে আসে। সে হিসেব কষে দেখেছে গত দু'বছরে মেঘনাদবধ কাব্যের মোট সাতটি কপি খরিদ করতে হয়েছে তাকে। জয়কৃষ্ণের আমন্ত্রণে হরিহরকে রাসবিহারী দশ দিন ধরে কসরত করে শিখিয়েছেন ‘বঙ্গভূমির প্রতি' কবিতাটি! হাজার হোক মাইকেলকে আনতে যাচ্ছে তো!
হুগলি জেলার চন্দননগরে রয়েছে আরও দু'টি প্রাচীন লাইব্রেরি। প্রায় একশো বছরেরও আগে, চন্দননগর যখন চনমনে ফরাসি উপনিবেশ ফরাসডাঙা, সেখানে একটি শখের থিয়েটার-দল গড়ে উঠল। দলের কাপ্তেন যদুনাথ পালিত আর সহকারী মতিলাল শেঠ। কলকাতা থেকে এসে এই দলে অভিনয় করেন রসরাজ অমৃতলাল বসু, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি-র মতো নামী অভিনেতারা। ড. ক্ষীরোদচন্দ্র পালিতের বাড়িতে প্রথমেই অভিনীত হল মনমোহন বসুর ‘প্রণয়-পরীক্ষা'। শুরুতেই নিষিদ্ধ নাটক করে ব্রিটিশ সরকারের কোপে পড়লেন এঁরা। নাট্যসংস্থা বন্ধ হয়ে গেল। তাতে কী হয়েছে, থিয়েটার দলের আসবাব-পত্তর, সিন-সিনারি বিক্রির টাকায় নতুন কিছু বই কিনে, নিজের বই আর বন্ধুবান্ধবদের পুরনো বই জোগাড় করে, উর্দি বাজারে একটি বাড়ি ভাড়া করে যদুনাথ পালিত ‘চন্দননগর পুস্তকাগার' খুলে বসলেন। দিনটা ছিল ১ অক্টোবর ১৮৭৩। ১৮৮০ সালের সদস্য-তালিকায় রয়েছেন চন্দননগরের প্রথম বাঙালি মেয়র দীননাথ দাস। এই চন্দননগরের আরেকটি প্রাচীন গ্রন্থাগার হল ‘বিবলিওথেক মিউনিসিপ্যাল দ্য শ্যাদারনাগোর’। পরে এখান থেকে ফরাসি ইনস্টিটিউটের গ্রন্থাগারে প্রচুর বই যায় আমাদের বাংলা মুলুকে বর্ধমানের রাজাদের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বর্ধমানরাজ মহাতাব চাঁদ। তাঁর অর্থানুকূল্যে, ‘বাল্মিকী রামায়ণ'-এর ‘আদিকাণ্ড'-র পদ্যানুবাদ প্রকাশিত হয় ১৮৫৪ সালে। অনুবাদক ছিলেন দুই রাজসভাপণ্ডিত বিপ্রদাস তর্কবাগীশ, উমাকান্ত ভট্টাচার্য। এই রাজসভাতেই ‘মহাভারত’-এর অনুবাদ শুরু হয় ১৮৫৮ সালে। ছাব্বিশ বছর ধরে এই কাজ চলে। এই রাজপরিবারে গড়ে ওঠে এক সুবিশাল লাইব্রেরি। মহাতাব চাঁদ ও পরবর্তীকালে বিজয় চাঁদের আমলে এই গ্রন্থাগার সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এর একটি অংশ এখন ‘রাজ কালেকশন' শিরোনামে সংরক্ষিত রয়েছে। বর্ধমানের মতো কাশিমবাজার রাজবাড়ির লাইব্রেরিটিও বিখ্যাত। মহারানি স্বর্ণময়ী এই লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন, দেওয়ান রাজীবলোচনের পরামর্শে। পরে রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী ও রাজা শ্রীশচন্দ্র নন্দীর আমলে গ্রন্থাগারটি বিশেষভাবে বেড়ে উঠেছিল।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও সংস্কৃত কলেজ গ্রন্থাগারে এই রাজবাড়ি থেকে গ্রন্থ ও পুঁথি দান করা হয়েছে।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সুভাষগ্রামের কাছে দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ-এর জন্ম। ১৮৫৬ সালে দ্বারকানাথের বাবা একটি মুদ্রণযন্ত্র কেনেন। তিনি মনে করেছিলেন এই যন্ত্র দিয়ে নিজের ও কৃতী পুত্রের লেখাগুলো ছাপাবেন। সেই ইচ্ছা পুরণ হয়নি। দ্বারকানাথ তখন এই যন্ত্রে ‘গ্রিসের ইতিহাস' ও ‘রোমের ইতিহাস’ প্রকাশ করেন। এরপর তাঁর ছাপাখানা থেকে ‘সোমপ্রকাশ' সাময়িক পত্রিকা প্রকাশ হতে শুরু করে। সেই বাড়িতেই তৈরি হয় ‘বিদ্যাভূষণ গ্রন্থাগার’।
নদিয়া-র প্রাচীনতম গ্রন্থাগার হল ‘কৃষ্ণনগর পাবলিক লাইব্রেরি'। উনিশ শতকের নবজাগরণের সময় ১৮৪৬ সালে কৃষ্ণনগর কলেজ স্থাপিত হয়। ১৮৫৬ সালে, সেই সময়ের নদিয়া জেলার বিদ্যালয়গুলোর পরিদর্শক হজসন প্র্যাট—আইসিএস, কৃষ্ণনগরে একটি লাইব্রেরি তৈরির পরিকল্পনা করেন। নদিয়ার মহারাজা জমি দেন এই প্রকল্পে। এবং আরও অনেকের সহযোগিতায় ১৮৫৯ সালে বর্তমান গ্রন্থাগার ভবন তৈরি হয়।
এই নদিয়া জেলাতেই ১৮৮৪-র ২৬ ফেব্রুয়ারি রাণাঘাট পাবলিক লাইব্রেরি তৈরি হয়। প্রথমে একদল ছাত্র এটি নির্মাণ করেন। পরে শ্রীবৃদ্ধি হয়। এছাড়া, কৃত্তিবাসের জন্মস্থান ফুলিয়াতে ‘কৃত্তিবাস স্মৃতিভবন’-এ একটি গ্রন্থাগার আছে। কল্যাণীতে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব গ্রন্থগার। এছাড়া এখানে বিড়লা কলেজের গ্রন্থাগার এবং কৃষি অনুষদের নিজস্ব গ্রন্থাগার ছিল।
‘উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগার'-টি রয়েছে কোচবিহারে। এটির প্রতিষ্ঠা ১৯৬৯ সালে। এ অঞ্চলের প্রাচীনতম লাইব্রেরি ‘কোচবিহার রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগার'। এটির প্রতিষ্ঠা আনুমানিক ১৮৭০ সালে। কোচবিহারের মহারাজা নরেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর পর তাঁর শিশুপুত্র নৃপেন্দ্রনারায়ণ রাজা হন। সেই সময় রাজসম্পত্তি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ছিল ব্রিটিশ সরকার নিযুক্ত কর্নেল জে সি হটন-এর ওপর। ১৮৭০ সালে হটন ইংল্যান্ডের এক বিখ্যাত বই-বিক্রেতার কাছ থেকে একগুচ্ছ মূল্যবান প্রাচীন গ্রন্থ কিনে কোচবিহারে আনেন। বইগুলো চমৎকার ভাবে বাঁধিয়ে কোচবিহারের নীলকুঠিতে নিয়ে, এই লাইব্রেরি তৈরি হয়।
আরও বহু উল্লেখযোগ্য লাইব্রেরি আমাদের জেলায়-জেলায় ছড়িয়ে রয়েছে। চব্বিশ পরগনার ‘ঋষি বঙ্কিম গ্রন্থাগার’, ‘বঙ্কিমচন্দ্র 'টাউন লাইব্রেরি', নদিয়ার ‘কৃষ্ণনগর পাবলিক লাইব্রেরি'। নদিয়ার কালেক্টরির রেকর্ডরুমে রয়েছে অবিভক্ত নদিয়া জেলার সহস্র তায়দাদ সমীক্ষণ। এখানে চুয়াল্লিশটি তায়দাদ নথি খাতার মধ্যে পাওয়া যায় তেতাল্লিশ হাজার পাঁচশো জনকে নিষ্কর ভূমিদানের বিস্তৃত বিবরণ-সহ আরও নানা মূল্যবান খবর। আবার বীরভূমের
শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী' বিশ্ববিদ্যালয়-কে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে ‘বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার’, ‘রবীন্দ্রভবন গ্রন্থাগার'। রবীন্দ্রচর্চায় এই দুই গ্রন্থাগারের গুরুত্ব অসীম।
বাঙালি এভাবেই তার নিজের ভিত শক্ত করে চলেছে। তার প্রকৃত দুর্গগুলো গড়ে চলেছে, তার আদত নিশান প্রোথিত করে চলেছে। এই লাইব্রেরিগুলোই বাঙালির রাজধানী, এরাই বাঙালির অতীতের গৌরবকেন্দ্র, ভবিষ্যতের মানুষ-গড়ার কারখানা। আজকের ইন্টারনেট আর মোবাইলের যুগে, বই-বিমুখতার জমানায়, এদের মূল্য যেন আরও বেড়ে চলেছে। এরা পারে আমাদের স্থিত করতে ও সমৃদ্ধ করতে। এ-কথা ভুললে চলবে না।