মার্জিনের গল্প
নায়লা নাজনীন | কারো বাড়িতে বেড়াতে গেলে মূল এবং একমাত্র কাজ ছিলো কোথাও পড়ার মত কিছু আছে কিনা খুঁজে বার করা - টেবিল, তাকের ওপর, বালিশ-তোষকের নীচে, সম্ভাব্য সব জায়গায়। পত্রিকা, ম্যাগাজিন যা কিছুই হোক,পড়
সময়টা নব্বইয়ের দশক। তারুণ্যের সিঁড়িতে পা রাখা 'স্প্যানিশ ললাবাই' প্রজন্মের অবসর কাটে চলতি হিন্দি সিনেমার গান বা উঠতি জনপ্রিয় ব্যান্ডের গান গুনগুনিয়ে। জন্মদিন, নববর্ষ বা ঈদ শুভেচ্ছায় প্রিয়জনকে কার্ড বা বই দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর চল চলছিলো তখন। আন্তর্জালের রাক্ষুসি থাবা তখনও ভবিষ্যত পরিকল্পনায় ব্যস্ত। ওইসময় টেলিভিশনের পরে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে অন্যতম ছিলো বই -গল্পের বই! দিনের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত সময় ছিলো বই হাতে বসে চোখের সামনে মেলে ধরার মুহূর্তটি। এই বই নিয়ে বইপ্রেমীদের কত সুপার এক্সাইটিং গল্প থাকে!একটা বই পড়া শুরু করলে শেষ না হওয়া অবধি মনে যে অস্থিরতা কাজ করে তা পাঠক মাত্রই জানেন বোধকরি।
মনে আছে, ক্লাস নাইন এ পড়ি যখন, স্কুলে ক্লাস চলাকালীন সময়ে একদিন পাঠ্যবইয়ের নীচে লুকিয়ে গল্পের বই পড়ার সময় টিচারের চোখে পড়ে যাই। কেবলমাত্র বকুনি খেয়েই এই পর্ব শেষ হয়ে যায়নি! এরপর থেকে উনি আমাকে দস্যু বনহুর ব'লে ডাকতেন। তাঁর দেখাদেখি আরও দুই-একজন টিচারও...'কি নায়লা! দস্যু বনহুর..হু...'! গল্পের ট্রাজেডি হলো ওই বই মোটেও দস্যু বনহুর ছিলোনা।
পাশে খোলা বই রেখে একবার ঝালমুড়ি মাখানোর সময় সরিষার তেলের পরিবর্তে মুড়ির ওপর ডেটল ঢেলে দিয়েছিলাম!
একইভাবে আরেকদিন, ভাতের হাড়িতে চা পাতা ...
কারো বাড়িতে বেড়াতে গেলে মূল এবং একমাত্র কাজ ছিলো কোথাও পড়ার মত কিছু আছে কিনা খুঁজে বার করা - টেবিল, তাকের ওপর, বালিশ-তোষকের নীচে, সম্ভাব্য সব জায়গায়। পত্রিকা, ম্যাগাজিন যা কিছুই হোক,পড়ার মত কিছু, ছাপার অক্ষরে! নিদেনপক্ষে বাংলা পাঠ্যবই বা চয়নিকা! একদিন এভাবেই অ্যাডাল্ট বই পড়ার দুর্ভাগ্য হয়ে ছিল! দুর্ভাগ্য এইজন্য যে, বয়সটা তখন সাত কি আট!
বই পড়া নিয়ে এমন উৎপটাং ঘটন-অঘটনের তালিকা আমাদের কারোরই খুব ছোট নয় মনেহয়।
সাল ২০২১ এ এসে আমরা অনেক কিছু থেকেই বিস্মৃত। আঙুলের ফাঁক গলে সময়ের সাথে সাথে বহু কিছুই আজ চলে গেছে জীবন থেকে, অভ্যেস থেকে। দৈনন্দিনের গতানুগতিকতায় ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত আমরা বিনোদনও খুঁজি এখন 'শর্টকাট এ্যান্ড ওয়ানটাইম'! আর নতুন প্রজন্ম (সংখ্যাগরিষ্ঠতায়) তো বেড়েই উঠছে আন্তর্জালেই বন্দী হয়ে!
একদা ওমর খৈয়ম বলেছিলেন, 'রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা..'
একখানা ভালো বই আসলে অনন্ত যৌবনাই হয়। একখানা ভালো বই আমাদের মনের দৈন্যদশা দুর করে।
অশুভ সময়ের সরণী ধরে চলতে চলতে আমাদের মনুষ্যত্ব, মানবিকতার ধ্যান-ধারণা আজ তলানিতে এসে ঠেকেছে। কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, চেতনায় বিপ্লব ঘটাতে বইয়ের বিকল্প নেই। চলুন আমরা মানুষকে বই পড়ায় উৎসাহিত করি, এতে সময় নষ্ট হবার সুযোগ নেই, সমস্তটাই প্রাপ্তি।