মায়ের ভাষা ও বই পড়া
বনানী বাবলি লিখছেন; বন্ধুরা সবাই একসাথে আড্ডা ছিলো মূল লক্ষ্য আর নুতন বইয়ের ঘ্রান নিয়ে, পাতা উল্টে, একটু পড়ে কিছু বই কিনে পৃথিবী জয়ের আনন্দে ছিলো আমাদের ঘরে ফেরা । মাসব্যাপী এই বই মেলা ছিলো।
ছোট্ট একটা জীবন। তবুও এই অল্প সময় জেনেই আমরা গড়ি স্বপ্ন দিয়ে প্রাসাদ। কখনো স্বপ্ন দিয়ে তৈরী করি এক একটা জীবনের মুহূর্ত। ঠিক সেই রকম কিছু মুহূর্ত ছিলো কোনো এক বসন্ত উৎসবের বই মেলায়। সেই সময় ঢাকাতে থাকতে এই বই মেলা ছিলো আমাদের প্রাণের উৎসব, আমাদের তারুণ্যের বহিঃপ্রকাশ, আমাদের আনন্দ প্রকাশের একটি নির্ভরযোগ্য স্থান।
বন্ধুরা সবাই একসাথে আড্ডা ছিলো মূল লক্ষ্য আর নুতন বইয়ের ঘ্রান নিয়ে, পাতা উল্টে, একটু পড়ে কিছু বই কিনে পৃথিবী জয়ের আনন্দে ছিলো আমাদের ঘরে ফেরা । মাসব্যাপী এই বই মেলা ছিলো আমাদের নুতন এক দিগন্তকে আবিষ্কার। কে কার বই কিনলো, কে কোন বইটি কেনার পেছনের রহস্য, কে কোন কবির কবিতাকে তখন জীবনের আদর্শ ভাবছি - সে এক অন্য জগৎ। সেই রঙিন জগৎ থেকে ছিটকে একদিন আমাদের কয়েকজন বন্ধুরাও পৃথিবীর নানা প্রান্তে হারিয়ে গেলাম।
আজ আর সেই দিনগুলি নেই। হারিয়ে গেলো হটাৎ করে । স্মৃতিগুলি রয়ে গেলো- বারে বারে যারে খুঁজে ফিরি।
আমরা যে পাঠকরা দেশের বাইরে থাকি তারা বাংলা বই হাতের কাছে পাওয়া মানে এক রকম দিবাস্বপ্ন তুল্য। এখানে বইয়ের দোকানে যদি পছন্দের বই পাওয়া যায় তবে অগ্নিমূল্য আপনাকে আশাহত করবে নিঃসন্দেহে। তাই আমাদের নির্ভর করতে হয় পিডিএফ বইয়ের উপরে। অথবা যদি কেউ উপহার হিসাবে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসেন তাহলে সোনায় সোহাগা। মনের আনন্দ চেপে রাখা দায় তখন। বাংলাদেশের বই মেলাকে ভীষণ অনুভব করি তখন, অনুভব করি ঢাকার নীল ক্ষেতের পুরানো দোকানের সেই সারি সারি বইয়ের দোকান, মনে পড়ে নিউ মার্কেটের বইয়ের দোকানে ভর দুপুরে হেঁটে হেঁটে বই কেনার সেই দিনগুলি কিংবা সেই বেইলি রোডের সাগর পাবলিশার্স, এসো বই পড়ি দোকানের কাঁচের দেয়ালে সাজিয়ে রাখা অমৃতভাণ্ডার সব বই । এই স্মৃতিগুলি মলিন হয়নি এখনো। দেখতে পাই এখনো। সবুজ সতেজ ।
আপনিও পড়ুয়া'য় লিখুন। আমাদের কাছে লেখা পাঠাবার ঠিকানা editor@porua.net
কিন্তু বই পড়া? বই কেনো পড়ি আমরা? এই মুহূর্তে মনে এলো সেই আলোর ফেরিওয়ালা পলান সরকারকে - যিনি কাঁধে বইয়ের ঝোলা নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামে বই পৌঁছে দিতেন পাঠকের কাছে । কোন আলো তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন ? কী সেই তৃষ্ণা তিনি বয়ে নিয়ে চলতেন ? আর আমাদের বিদ্যার সাগর বিদ্যাসাগরের কুপি বা হারিকেনের আলোর অভাবে রাতের ল্যাম্পপোস্টের নিচে গিয়ে পড়ার কথা ভুলে যাবে কি শিশু কিশোরেরা ?
কিংবা ধরা যাক দিনমজুর জয়নালের কথা। যার নেশা হলো বই পড়া। শুধু কী নেশা? জয়নাল সাড়ে তিন হাজার বই দিয়ে গ্রামে তৈরী করেছেন পাঠাগার। তাহলে বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজ কেনো বই পড়া থেকে পিছিয়ে গেলো ? আমি এখনো আশাবাদী l আমি মনে করি সকল নৈরাজ্যের মূল হলো আমাদের মানবিক দিকগুলি গড়ে উঠছে না বইয়ের পাঠক শ্রেণী তৈরী না হওয়ার কারণে।
সেই সময় একটি শিশু ছোটবেলা থেকেই গল্প শুনে বড়ো হতো যৌথ পরিবারে। গল্প শুনে সেই শিশু কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করে। এরপর ধীরে ধীরে সে বইয়ের রাজ্যে বিচরণ করতে শিখে। তারপর হয়তো সাহিত্যের প্রতি মোহ জন্মে যায়, বোধ জন্মায়, যুক্তি জন্মায়, বিনয়, সততা, দয়া, ভালোবাসাও জন্মে যায় তার চারিপাশের গাছপালা, প্রাণী জগৎ ও মানুষের প্রতি। বই যে ভালোবাসে সে জানে এই বই তার মনের খাদ্য।
বইটি কিনে হোক বা ধার করে হোক, এমন কী ক্ষেত্র বিশেষে চুরি করে হোক - বই তার পড়া চাইই চাই মনকে খোলা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে। আর বইটি যদি বাংলা ভাষাতে হয় তাহলে মনে হয় বইটির সম্পূর্ণ নির্যাসটুকু যেনো তুলে আনা যায়। কেনো আজও জানি না। মন বলে তখন মায়ের ভাষার মতো এতো মধু আর কোন ভাষাতে পাই?
এই মায়ের ভাষাকে আমরাই বাঁচিয়ে রাখতে পারি যদি বাংলা ভাষার বইগুলিকে নুতন প্রজন্মকে পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে পারি। আমরা যদি বাংলাকে সত্যিকারের ভালোবাসি, ভাষা শহীদদের কথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে পারি, মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রথম সৈনিক অকুতোভয় বীর ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে মানুষের অন্তরে রেখে দিতে পারি তাহলে বেঁচে থাকে আমাদের চির দুঃখিনী বাংলা মা।
বাংলাকে বহুল মাধ্যমে ব্যবহার করা হলে তবেই এই ভাষাটিও টিকে থাকবে হাজারো ভাষার ভিড়ে - বিশেষ করে যেখানে ইংরেজি ভাষার এতো আধিপত্য পৃথিবীতে । প্রসঙ্গত কানাডায় দুইটি অফিসিয়াল ভাষা, ইংরেজি এবং ফরাসি। কিন্তু এই দেশের সরকার অভিবাসীদের নিজস্ব ভাষা অর্থাৎ তাদের মাতৃভাষাকে সংরক্ষণ করার জন্য বিভিন্ন রকমের ফান্ড দিয়ে রাখে। এর কারণ হিসাবে এখানে বলা হয়ে থাকে যে নিজের ঐতিহ্য ও শিকড়কে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। শুধু তাই নয় - এটাকে টিকিয়ে রাখা অভিবাসীদের একটি অধিকার। যার ফলশ্রুতিতে চার্টার অফ রাইট( The Charter of Rights and Freedoms 1982) অনুসারে সরকার সমস্ত ধরণের সহায়তা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত অভিবাসীদের ভাষাকে রক্ষা করার জন্য। তাই এখানে অভিবাসীরা ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষার পাশাপাশি বাঙালিরা নিজের ভাষাকেও চর্চা করতে পারে বিভিন্ন কমিউনিটি বা অভিবাসী অফিসগুলিতে প্রয়োজন অনুসারে। আর বাচ্চাদের জন্য আছে আফটার স্কুল প্রোগ্রাম যেখানে বাঙালি শিক্ষক দিয়ে শিশুদের বাংলা ক্লাস নেওয়া হয়। কোথায় যেনো পড়েছিলাম - যারা মাতৃভাষায় দক্ষ তার অন্য ভাষাতেও তুখোড় হতে পারে।
সম্পূর্ণ বিশ্বকে আমরা দেখতে পেতে পারি যদি আমরা বই পড়ি। প্রতিটা লেখকের অভিজ্ঞতার প্লট ভিন্ন। আমরা যখন বিভিন্ন লেখকের বই পড়ি তখন জানতে পারি অন্যান্য মানুষেরা কী নিয়ে চিন্তা করছেন। প্রতিটা লেখক বা মানুষ বড়ো হয় সে তার নিজের পৃথিবী ঘিরে। প্রতিটা মানুষের পৃথিবীটা ভিন্ন অন্য একজনের পৃথিবী থেকে। তাইতো প্রতিটা মানুষের জীবনের গল্প ভিন্ন। এমন কী স্থান-কাল- পাত্র সব সময় এক এক রকম এক এক জনের। এই ভিন্নতা আছে বলেই আমরা তারতম্যটা বুঝতে পারি। ভিন্ন এক দৃষ্টি কোন নিয়ে দেখার সুযোগ হয়। দেখি নূতনত্ব। ফলাফলে এক এক গল্প এক একটা অভিজ্ঞতার আলোকে প্রকাশ। কোনো গল্প কী ছোটো ? না। কোনো গল্পই কোনো অংশে ছোটো বা ক্ষুদ্র নয়। এই কারণে একটি প্রবাদ আছে যে গ্রামের একজন বয়োবৃদ্ধ যখন দেহ রাখেন তখন একটি পাঠাগারের মৃত্যু হয়। প্রতিটা মানুষ এক একজন জীবন্ত গল্প। এইভাবেই প্রাচীন কালে মুখে মুখে গল্প ছড়িয়ে যেতো যখন বইয়ের আবির্ভাব হয় নাই।
বই পড়ায় কোনো উপকারিতা আছে কি?
গবেষকেরা (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ) ২০১৩ সালে MRI স্ক্যান করে দেখতে পান যে একটি উপন্যাস মানুষের ব্রেইনে প্রতিফলন ঘটায়। গবেষণায় দেখা যায় যে যখন উপন্যাসের টেনশন অর্থাৎ মুখ্য উত্তেজনার জায়গাগুলিতে পাঠক পড়ে সেই সময়গুলিতে ব্রেইনের কোষগুলিও বাতির মতো জ্বলে উঠে। সেই উপন্যাসটির নাম ছিলো "পম্পেই(Pompeii)" যেটা নয় দিন পড়া পর্যন্ত স্টাডি ছিলো। সেই ব্রেইন স্ক্যানের মাধ্যমে পাওয়া যায় যে সেই নয় দিনের সময়টুকুর পর পড়ুয়াদের ব্রেইনের সংযোগগুলি বেড়ে গেছে, বিশেষ করে somatosensory cortex, এবং শুধু তাই নয়- ব্রেইনের সেই অংশগুলি শারীরিক অনুভূতির (physical sensations) প্রতিক্রিয়া করে (যেমন সঞ্চালন এবং ব্যথার কথা উল্লেখ করা হয়েছে)।
“বই পড়ার কারণে মানুষের জীবনে পজেটিভ প্রভাবে ব্রেইনের কার্যকারিতা বেড়ে যায়, অনুভূতিপ্রবণ ও সংবেদনশীলতা বেড়ে যায়, স্ট্রেস কমিয়ে দেয়, ঘুমাতে সাহায্য করে, cognitive স্কিল বাড়িয়ে দেয়, বিষন্নতাকে সংকোচন করে এবং সর্বোপরি মানুষের গড় আয়ু বাড়াতে সাহায্য করে” - এই তথ্যগুলি উঠে এসেছে www.healthline.com এ যেটা Medically review (on October 15, 2019) করেছিলেন Heidi Moawad, M.D. এবং Rebecca Joy Stanborough, MFA.
বই আমাদের বিজ্ঞানমনষ্কতা, সত্যানুসন্ধানতা, মানবিকতা, নুতন চিন্তার বিকাশে সাহায্য করে। তাই পৃথিবীর সাথে এক সাথে পথ চলতে হলে দরকার অন্বেষণ। আমি স্বপ্ন দেখি একদিন বাংলাদেশেও বাস, রেল ও অন্যান্য যান বাহনে যাত্রী-পাঠকরা বই পড়ছে নীরবে ঠিক উন্নত বিশ্বের প্রাত্যহিক দৃশ্যের মতো। মানুষ বই কি শুধুমাত্র আনন্দের জন্য পড়ে? অথবা এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে? বিজ্ঞান একই প্রশ্নের উত্তরে পুনরাবৃত্তি করে বলে,"Yes," বই পড়া শারীরিক এবং মানসিকভাবে উপকার করে যেটা সারা জীবনকে শুধু উপকারই করে গিয়ে জীবনকে দীর্ঘায়ু করে । প্রিয় পাঠক, সুতরাং বই হোক আমাদের নিত্যসঙ্গী !
বিভিন্ন ভাষার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে আমরা জানতে পারি ভাষার জন্ম হলেও মৃত্যু হতে কিছু সময়ের ব্যাপার মাত্র । আমার মৃত্যু মানে বাংলাভাষীর এক মৃত্যু। একটি ভাষার মৃত্যু। চলুন আমরা সবাই মিলে এই প্রিয় মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখি। আসুন বাংলায় কথা বলি, বাংলায় গান শুনি আর বাংলা বই পড়ি।
তথ্যসূত্রঃ
Books, minds, and umbrellas only work if they are open – Author Unknown
Educating the mind without educating the heart is no education at all – Aristotle