মায়ের গায়ের গন্ধের মতো এখনো যেসব স্মৃতির গায়ে লেগে আছে ছোটবেলার একেবারে নিজস্ব গন্ধ, লাইব্রেরি তেমনই একটা শব্দ। আমাদের প্রজন্ম পর্যন্ত বই হাতে নেওয়া যেকোনো মানুষের কাছেই তা ছিল একটা পীঠস্থান। কিন্তু তারপর থেকে তার স্থান মাহাত্ব ধীরে ধীরে ম্লান হতে থাকে। নিঃশব্দ জলসাঘরের পরিত্যক্ত খিলানে জমে ঝুল। রিডিং রুমের গোল টেবিলের ওপর ঝুলে আসা টিমটিমে হলুদ আলোর নীচে জমে ওঠা সান্ধ্য আসরে ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত কিম্বা গায়ে শাড়ির আঁচল টানা বাঙালি প্রজম্ন ধীরে ধীরে প্রাগৈতিহাসিক জীবের মতো লুপ্ত হতে থাকেন। পুরোনো ঘড়ির পেন্ডুলামটা দেওয়ালে লেটকে থাকে স্থির হয়ে । বৃটিশ আমলের লম্বা লোহার দন্ডে ঝুলে থাকা চার ব্লেডের ফ্যানটা একদিন ঘটঘট শব্দ করে আচমকাই থেমে যায়। ধুলো জমে সর্বত্র। বইয়ের র্যাকে কিম্বা কাউন্টারে বসে থাকা ভারী চশমা পরা বয়স্ক লাইব্রেরিয়ানের মলিন জোব্বায়। নিজেকে অপ্রয়োজনীয় মনে হলে যেভাবে অবসাদ জমে গায়ে!
হ্যাঁ এখন গ্রামে গঞ্জে, শহরে, স্কুলে, কলেজে, জেলায়, সদরে, দেশে, বিদেশে সব জায়গায় লাইব্রেরিগুলোর এক চিত্র। আসলে ভবনগুলোর প্রয়োজন ফুরিয়েছে, একথা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই আর। অথচ রবীন্দ্রনাথ কী অপূর্ব করেই না বলেছিলেন, "মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারি যে, সে ঘুমাইয়া-পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে।" এই কাগজ কলমের জায়গায় যখন থেকে এলো কি বোর্ড, টেকলজির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পড়বার মাধ্যম গেল পালটে। মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এলো লাইব্রেরি। ল্যাপটপ আর মোবাইল ফোনই হয়ে উঠল পড়বার বিকল্প মাধ্যম। অতিরিক্ত কর্মব্যস্ততা,তজ্জনিত সময় অভাব এবং আলস্য লাইব্রেরিতে গিয়ে অবসর কাটানোর মতো অবস্থা রাখলো না আর হাতে। তাছাড়া অক্ষর যখন খোদাই করা ছিলো গুহাগাত্রে কিম্বা শিলালিপিতে তখন জ্ঞান পিপাসু মানুষ নিশ্চয়ই তাকিয়ে থাকতেন পাথরের গায়ে, তারপর বাঁশপাতা কিম্বা সাবাই ঘাস হয়ে কাগজ। মানুষ মুখ গুঁজলো বইয়ে। আর এখন ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, ট্রেনে বাসে পকেট বন্দি জ্ঞান। বুৎপত্তি গত অর্থের ধার দিয়ে না গিয়ে লাইব্রেরি শব্দটাকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ প্রয়াসে বই, সঙ্গীত, চলচ্চিত্রের যা কিছু সংগ্রহ ধরে রাখার প্রচেষ্টাকেই আমরা এই নামে অভিষিক্ত করেছি।
কত শব্দ প্রতিদিন পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, শুধু শব্দ কেন কত ভাষাই লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আবার কত শব্দ মানুষের কল্পনা থেকে বাস্তবে রূপ ধরছে প্রতিদিন। সেকালে আমার দাদু (মায়ের বাবা)ছিলেন আমাদের মফস্বল শহরের খ্যাতনামা ইংরেজির শিক্ষক। ইংরেজি ভাষা বা সাহিত্য নিয়ে কারো কোনো জিজ্ঞাস্য থাকলেই চলে আসতেন দাদুভাইয়ের কাছে। আর আমরা বাড়ির লোকরা তো ডিকশনারি খোলার ঝামেলাই নিতাম না। কারণ আমরা জানতাম দাদু মানেই মুভেবেল লাইব্রেরি। সেই কথাটাই আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে। দেবালয়ে যেমন দেবতা থাকেন না তেমনি জ্ঞানও থাকে না কোনো নির্দিষ্ট মহলে। জ্ঞানের ধর্মই তাই। সে মুক্ত, নদীর মতো। তবু কেন এই হাহাকার? কেন লুপ্ত সভ্যতার ক্রন্দনধ্বনি শিস দিয়ে যায় বাতাসে? তার কি সবটাই অহেতুকী। না তা বোধহয় নয়। ওই যে শতশত বইয়ের সম্ভার, তার মধ্যে গিয়ে দাঁড়ানো, রিডিং রুমের টেবিলের ওপর ঝুকে পড়ে বই পড়া এ অভিজ্ঞতা অনন্য। মোবাইল খুলে বই পড়ার সঙ্গে তার তফাৎ যেন ইউটিউব খুলে সমুদ্র দেখা আর সমুদ্রের জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়ানোর মধ্যের ব্যবধানটুকু ।
উচ্চমাধ্যমিকের পর দাদুর হাত ধরে প্রতিদিন বিকেলে লাইব্রেরির মাঠে গিয়ে বসা ছিল আমার প্রিয় অভ্যাস। তারপর ফিরবার সময় দুজনে দুটো বই নিয়ে বাড়ি ফেরা। আর সেই বই নিয়ে তর্ক। সমরেশ বসুর ‘বিবর’ নিলি? ওই বই এখুনি পড়বার দরকার কি তোর? ভুরু উঁচিয়ে আমি বলি, বা রে ক্লাস সিক্সে তুমি তো আমায় ‘ওয়াদিপাস’ পড়িয়েছ, তার বেলা! তার জন্যে দিম্মার কাছে কত্ত বকুনি খেয়েছিলে মনে আছে?
দাদু বলেন আহা ওটা তো ক্ল্যাসিক।
ও এটা বুঝি ক্ল্যাসিক নয়!
অস্থির ভাবে মাথা নাড়েন দাদু। তারপর যুক্তির পর যুক্তি। পরদিন ক্ল্যাসিকের সংজ্ঞা বুঝাতে লাইব্রেরিতে নতুন বইয়ের অনুসন্ধান।
পরিবেশ একটা মাদকতা তৈরি করে পাঠকের মনে। যেন এক গুপ্তধনের গুহা। আরও ছোটবেলায়, এই ক্লাস থ্রি ফোর, স্কুলে টিফিনের পর লাইব্রেরি পিরিওড। লম্বা লাইন দরজার সামনে। লাইনের পিছন থেকে মাথা ঝুঁকিয়ে দেখা যাচ্ছে টেবিলের ওপর বইয়ের পর বই সিড়ির মতো উঠে গেছে উঁচু হয়ে। নিজের পছন্দের কোনো জায়গা নেই। লাইব্রেরিয়ান দিদি ক্লাস অনুযায়ী বরাদ্দ করে রেখেছেন সব বই। তোমার হাতে যেটা উঠবে সেটাই নিতে হবে। রীতিমতো একটা গোটা সোনার দোকানের মালিক মনে হতো ওই দিদিটাকে। আবার খুব রাগও হতো তার ওপরে। আমাকে কেন জিম করবেট দিলো! শিকারের গল্প পড়তে আমার একটুও ভালো লাগে না। পিয়ালী পেয়েছে জুলেভার্ন। আমার ওইটি চাই। ইশ,নাইন টেনের দিদিদের কী মজা। তারা নিজের ইচ্ছেমতো বই নিতে পারে। আর ওই উপরের তাকে ঝুলে ঢেকে গেছে কী বই ওগুলো? ওগুলো কাউকে পড়েতে দেবে না?
লাইব্রেরিয়ান দিদি বলতেন,না ওগুলো রচনাসমগ্র। ওগুলো ছাত্রীদের ইস্যু করা হয় না। এখানে বসে পড়তে পারো অফ পিরিওডে।
অফ পিরিওড কখন?
বড় হও। তখন অফ পিরিওড পাবে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন দিদি।
দুষ্টু মেয়ের মতো দিদির হাতটা তখন খাঁমচে দিতে ইচ্ছে করত আমার। কেন ছোটরা কেন পাবে না! ছোটদের বুঝি ইচ্ছে করে না। কিন্তু সেসব কথা বলবার সাহস পেতাম না মোটেই। আলিবাবা আর চল্লিশ চোরের গল্প পড়তে পড়তে কাশেমের সেই ধনরত্ন ভরা গুহাটার কথা মনে হলেই আমি স্কুলের লাইব্রেরি ঘরটার কথা মনে করতাম।
স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি, শহরের পাব্লিক লাইব্রেরি, জেলা লাইব্রেরি এসব তো ছিলই, তাছাড়া কত লাইব্রেরি যে আমি খুঁজে নিয়েছি লেখালেখির জন্যে। হ্যাঁ এখনো। সবই ইন্টারনেটের মাধ্যমে পাওয়া যাবে মোটেই এমনটা নয়। কারণ সেখানেও তো কাউকে না কাউকে নথিভুক্ত করতে হয়। আর সব নথিভুক্ত বোধহয় এখনো হয়নি। তাছাড়া ওই মন্দির মসজিদে গেলে নাস্তিক মানুষের মনেও যেমন ধর্মভাব জাগ্রত হয় এও যেন তেমনি। যখন সিপাহী বিদ্রোহের কাল নিয়ে পড়াশোনা করতে যাচ্ছি চারিদিকে তা নিয়ে এতো বই যেন সেই যুগে ঢুকে যেতে পারছি আমি। ভয় পাওয়ার মানুষ আমি ছিলাম না। সব বিষয়ে জানার প্রতি ছিল আমার অদম্য কৌতুহল। লিখবার জন্যে যা যা পড়াশোনা করার দরকার তা নিয়ে আমার কোনো ছুতমার্গ ছিল না। কত ধরনের মানুষ। কত রকমের পেশা। সেই সবরকম বই পড়েছি নির্দ্বিধায়। শুধু আমি কেন আমার বন্ধু বান্ধবদের অনেকেরই স্কুল কলেজের দিন গুলোতে ছিল এমনই ইতিহাস। এমনকি তাদের অনেকেরই বাড়িতে যেসব বই খোলার অনুমতি ছিল না (যদিও আমার বাড়িতে কোনো বই পড়া নিয়েই কোনো সমস্যা ছিল না শুধু মাত্র রঙচঙে ছবি দেওয়া সিনেমা পত্রিকাগুলো ছাড়া) তারা সেসব বই শেষ করত লাইব্রেরিতে বসেই। তাহলেই বুঝুন, অবয়বের কি কোনো গুরুত্ব নেই? তবে তো একদিন বাড়ি ঘর মানুষের বেঁচে থাকা সবই ঢুকে যাবে কৃত্রিম আলোক তরঙ্গের ভিতরে! শূন্য আর দৃশ্যমানতার ভুলভুলাইয়াতে দিশাহারা হয়ে যেতে হবে আমাদের।
তখন জেরক্স মেশিনেরও প্রচলন হয়নি এদেশে। মায়ের কাছে গল্প শুনেছি মাস্টার্স ডিগ্রির সময় লাইব্রেরিতে বসে দিস্তার পর দিস্তা লিখে নিতে হতো বই থেকে। ফলে অনেকটা সময় সেখানে কাটানো ছিল প্রায় বাধ্যতামূলক। তাই পুরনো চলচ্চিত্রে লাইব্রেরিতে প্রেম জমে ওঠার দৃশ্যের ছড়াছড়ি। বাস্তবে ঘটতও তাই। আমাদের সময়ও প্রেমিক প্রেমিকা যুগলের দেখা করার খুব কমন জায়গা ছিল লাইব্রেরি চত্ত্বর। নির্জন রিডিং রুমে পাশাপাশি বই পড়তে পড়তে আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে দেওয়া, পায়ে পা ছুঁয়ে দেবার সেই অপূর্ব অনুভূতিই ছিল আলাদা। বইয়ের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি। তাছাড়া লাইব্রেরি যাচ্ছি বলার মধ্যে কেতাও ছিল অন্যরকম। ছিলো ফরাসি শব্দের সুবাসিত তথাকথিত আঁতেল হয়ে ওঠার এক নিতান্ত প্রয়াস।
আসলে মানুষের মানসিকতারও ঘটলো আমূল পরিবর্তন। বই নয়, জ্ঞান নয়, দামী মোবাইল ফোন কাছে থাকা, কিম্বা ব্র্যান্ডেড জুতো হয়ে উঠল মানুষের অহংকার। তার বাড়িই হলো তার পরিচয়। ফলে ব্যক্তি আমি হারিয়ে গিয়ে বস্তু আমি প্রধান হয়ে উঠলো। তা-ও আবার ছোট আমি। মুঠোয় বন্দি আমি। সিনেমা হল না ওটিটি,পত্রিকা নয় ওয়েব ম্যাগ। ব্রডকাস্ট নয় পডকাস্ট। গ্রাঞ্জার নেই, উদ্দামতা নেই। ধূলিধূসরিত আমাদের সোনালি অতীত। লাইব্রেরিগুলো যেন আজ বিভিন্ন অনুদানে কিম্বা সরকারি অনুগ্রহে জোর করে টিকিয়ে রাখেছে নিজের অস্তিত্ব ।
কিন্তু এ বুঝে নেবার বোধহয় সময় এসেছে জোর করে কোনো কিছুই টিকিয়ে রাখা যায় না। কালের নিয়মেই বৃহৎ এর অবসান আসন্ন। ডাইনোসর কিম্বা ম্যামথ তো কোন ছাড়, মানুষের দৈঘ্যই খর্ব হয়েছে দিনে দিনে। স্কুল, কলেজ, লাইব্রেরি এসব ছিল না একদিন, আবার কালের নিয়মেই তা একদিন নেই হয়ে যাবে হয়তো। কিন্তু মানুষের অজানাকে জানবার, অচেনাকে চিনবার যে অদম্য ইচ্ছা, যে জ্ঞান পিপাসা তা আগেও ছিল ভবিষ্যতেও থাকবে। মানুষ আবার শূন্য থেকে শুরু করবে। প্রকৃতি থেকে আহরণ করবে জ্ঞান। প্রকৃতির চেয়ে বড় লাইব্রেরি আর কোথায়ই বা আছে। মহাজ্ঞানী রূশো থেকে রবীন্দ্রনাথ তাই বারবার ফিরে গিয়েছেন প্রকৃতির কাছে। ওই আসন তলে। মাটির পরে।