নাহার তৃণা একজন ক্যাথেরিন ম্যানসফিল্ড-এর বাঙালী অভিরুপ
উনি গল্প করতে গিয়ে মাষ্টারি করেন না বরং আমার আপনার জীবনের গল্প বয়ান করেন। তাঁর গল্প পড়লে মেজাজ চাঙ্গা হয়।
"মৃত্যু আমাদের গল্প ব্যতীত সবকিছুই কেড়ে নেয়।"
-জিম হ্যারিসন
ছোটগল্পকে একটি সর্বজনীন সংজ্ঞায় ধরা অসম্ভব। কেউ বলবেন গল্পকে ছোট হতে হবে, কেউবা বলেন গল্পটি থাকা চাই। ছোট শব্দটি কেমন? আবার গল্পহীন গল্পও তো আমরা পড়ছি হরহামেশা। উপন্যাস যেমন জীবনকে অনন্ত জটিলতার মধ্যে পরিকীর্ণ করে শাশ্বত জীবনের মূর্তি রচনা করে তেমনি জীবনের রূপকে একটি মুহূর্তের গভীর অতলে একান্ত করে বিম্বিত, সীমা-ব্যঞ্জিত করে ছোটগল্প। ছোটোগল্পের জন্ম কেন হল এ নিয়ে একটি অন্যতম মত হল কোনো আকস্মিকতা নেই এর পেছনে। আমার পুত্রের একটি পছন্দের কার্টুন হলো; পিনাটের চার্লি ব্রাউন। ছোটবেলায় আমারও পছন্দের কার্টুন ছিল চার্লি ব্রাউন। এর কমিক বইগুলিও আমি সমান আগ্রহ নিয়ে পড়ি। কেন? সেই গল্পটি বলি। একদিন চার্লি ব্রাউনের কমিকে দেখি, তার বন্ধু স্নুপি (বিগেল প্রজাতির কুকুর) ঘোষণা করে সে উপন্যাস লিখবে। এবং সাথে সাথে সে টাইপরাইটারে বসে লেখা শুরু করে। কিছুক্ষণ পরে চার্লি ব্রাউন এসে দেখে স্নুপি লিখছে ছোটগল্প। চার্লি ব্রাউন জানতে চায় ঘটনা কি তুমি উপন্যাস ছেড়ে হঠাৎ গল্প লিখতে বসলে কেন? স্নুপি খুবই বিচক্ষণতার সাথে উত্তর দেয়, আমার কাছে শুধু একখানা মাত্র কাগজ আছে! মোটামুটি ভাবে এই হলো আমার কাছে ছোটগল্পের সংজ্ঞা।
আপনিও পড়ুয়া'য় লিখুন। আমাদের কাছে লেখা পাঠাবার ঠিকানা editor@porua.net
রবিঠাকুর মনে মনে করেন ছোটগল্পের আকৃতিটা হবে গোল, যে মার লাগায় মর্মে। প্রমথ চৌধুরীও সুর মিলিয়ে বলেন ছোটোগল্প প্রথমত ছোটো হওয়া চাই, তার পর তা গল্প হওয়া চাই। নাহার তৃণার গল্পগুলিও তেমন। পূর্ণ চাঁদের আলোক-দোলায় নিজের অফুরন্ত গল্পগুলোকে তিনি বিম্বিত করে দেন। ওঁর গল্প পড়লে পূর্ণ হয় প্রশান্ত। আমাদের জীবনের স্তূপাকার একঘেয়েমির মধ্যে থেকে তিনি টেনে আনেন গল্প। তাঁর ভাষায়, "...প্রতিদিনের কথোপকথনে কি গল্প থাকে? খুব থাকে। পড়শি ‘দবির সাহেব ছোটো ভাই কবির সাহেবের সাথে অমুকদিন তমুক কাজটা ঠিক করেননি'র মতো হাজারো গালগপ্পো খুচরো পয়সার মতো গড়িয়ে পড়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের পকেট গলে"। তাঁর গল্পের ঘটনাগুলি শুক্তিতে নিহিত ক্ষুদ্র, নিটোল মুক্তা, ছোট ঝিনুকে পরিবেশিত এক বিন্দু জীবন-রসনির্যাস। জীবন সেখানে প্রাণতপ্ত কিন্তু নিস্তরঙ্গ। উনি গল্প করতে গিয়ে মাষ্টারি করেন না বরং আমার আপনার জীবনের গল্প বয়ান করেন। তাঁর গল্প পড়লে মেজাজ চাঙ্গা হয়।
ভাল গল্প কাকে বলে? ভাল গল্প মানেই কি ভাল লেখা? আমিও নিজেও একজন ভালো গল্প বলিয়ে, কিন্তু ভাষা কই? কাহিনি ও ভাষা এই দুই মিলিয়ে হয় ভালো গল্প। ছোটগল্পের প্রতিটি শব্দই হবে অপরিহার্য। "...কোনো কোনো উইকএন্ডের রাতে বিশেষ কারণে এই পথসংলগ্ন এলাকার নৈঃশব্দ্য ছত্রখান হয়ে পড়ে। সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে সারাদিনের জমকালো হৈহুল্লোড়ের ঠমক খুইয়ে রাত্রিকালে রাস্তাটা সাধারণত চুপচাপই পড়ে থাকে। যত রাত বাড়ে নিঃসঙ্গতার সাথে ঘোট পাকানো অন্ধকার তত পথটা জুড়ে আসনপিঁড়ি হয়।" (নো ওয়ান কিল্ড জেসিকা)। "...ছুটির দিন হলেও আজ জেসিকা কাউকে তার ঘরে আসতে দেয়নি। আজ সে আকণ্ঠ পান করবে তার নিজস্ব বিষাদ। আকাশের গায়ে গোলপানা একটা চাঁদ দেখেছিল কিশোরী রাতের ঘন হতে থাকা অন্ধকারে। সে নিশ্চয়ই এই মধ্যরাতে আরো পুরুষ্ট হয়েছে।" (নো ওয়ান কিল্ড জেসিকা)
মানুষের বাস্তব ও কল্পনার জগৎকে কেন্দ্র করেই গল্প রচিত হয়। মানুষের জীবনধারা, সমাজ পরিপ্রেক্ষিত, আদর্শ, উদ্দেশ্য, প্রত্যয় সব ব্যাপারই গল্পের পটভূমিকায় কখনও প্রত্যক্ষভাবে, কখনও-বা পরোক্ষে নানা ধরনের রং-রস-ভাব সৃষ্ট করে, নাহার আমাদের সত্যের মুখোমুখি দাড় করিয়ে দেন। বাকি কাজটা পাঠকের। তাঁর গল্পের মূল উপাদান হল মানুষের বাস্তব জীবন, তাঁর না না, সমস্যা, সংশয়, নানা ভাব, কল্পনা, আদর্শের বিচিত্র সমারোহ। বাস্তবকে অতিক্রম করে জীবনের সত্যকে সন্ধান করেন নাহার। উনি বলেন, "...বাস্তব বঞ্চিত সাহিত্য এক ধরনের পলায়নপর মনোভাব। একজন লেখক বাস্তবতা এড়িয়ে থাকতে পারেন না। পরিবার-রাষ্ট্র-সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা থাকে।" মানুষ সমাজের মধ্য দিয়েই চায় ভালোভাবে বেঁচে থাকতে। সে চায় সুন্দর জীবন, সে স্বপ্ন দেখে সার্থক জীবনের। সুন্দর ও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অন্তরায় যে সমাজ ব্যবস্থা, সেই সমাজ ব্যবস্থার অভিশাপ তাঁর গল্পের আঁচড়ে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। সমাজব্যবস্থার জমে থাকা গ্লানি থেকে সমাজের বুক চিরে উঠে আসে গল্পকারের রক্তগোলাপ। নাহার বলেন, "...লেখক হিসেবে পাঠকের ভেতর সূক্ষ্মভাবে গ্লানিবোধ তৈরির একটা চেষ্টা হয়তো থাকে। সেরকম বিভিন্ন বিষয়ে গল্পগুলো তৈরির আন্তরিক চেষ্টা এ বইতে আছে। কতটা পেরেছি সে বিচারের স্বাধীনতা পাঠকের হাতে তুলে দিচ্ছি।" পাঠক হিসেবে আমি বলবো তিনি পেরেছেন, বেশ ভালো ভাবেই পেরেছেন। জব ওয়েল ডান।
নাহার চিৎকার, বাক্যাংশ, ইঙ্গিত, অনুভূতি বা দর্শনের মুহূর্তকে গল্পে রূপান্তর করতে পারেন। প্রমাণ স্বরূপ পড়ুন তাঁর "অন্ধসময় এবং একজন আহাদ সাহেবের গল্প"। তাঁর গল্পগুলো প্রায়শই শুরু হয়, যেখানে অস্থির অবস্থায় মানুষ ও ঘটনা উপস্থিত থাকে - চলমান চরিত্র, পরিবর্তনের প্রান্তে, নির্দিষ্ট কাজ এড়াতে চাইছে বা তা তাদের এড়িয়ে যাচ্ছে। অবস্থানের অস্পষ্টতা তাদের চরিত্রদের ভুলভ্রান্তির অবস্থাকে ধরে রাখে, তাঁর মজাদার কথোপকথনে গল্পের ফ্যাব্রিক এক অন্যমাত্রা ধারণ করে ।
২০১৩ সালে কেনাডিয়ান লেখিকা এলিস ম্যানরো উপন্যাস ছাড়াই শুধু গল্প লেখার জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, তিনি মন্তব্য করেছিলেন, 'আমি খুবই আশা করি পুরস্কারটি মানুষকে গল্পকে গুরুত্বপূর্ণ একটি কলা হিসাবে দেখতে সাহায্য করবে, শুধুমাত্র উপন্যাস লেখার জন্য গল্প খেলার মতো কিছু নয়।' আমি তাঁকে বলতে চাই, যতটুকু পারেন লিখুন, লিখে লিখে হাতের আঙ্গুল ফাটিয়ে ফেলুন, কিবোর্ডের 'কি' ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাক। আমরা বাঙালী পাঠকেরা খেয়াল করি নাই যে আমাদের নিজেদের মধ্যেই একজন ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড হয়ে উঠছেন। যদি আমরা বড় লেখকদের যেমন অমর মিত্রকে বাদ দেই, তাহলে সমকালীন গল্প চর্চা নাহার তৃণার নামের সাথেই শুরু করতে হবে।
নো ওয়ান কিল্ড জেসিকা ও অন্যান্য গল্প নাহার তৃণা প্রথম প্রকাশ : নভেম্বর ২০২২ প্রকাশক :জলধি মূল্য:৩০০ টাকা