নাহার তৃণার কলাম
আজকের দিনে পাঠ প্রিয় মানুষের কাছে বই সহজলভ্য বস্তু। পকেটে পয়সা থাকলে এবং চাইলেই যে কেউ যে কোনো বই সংগ্রহ করতে পারেন। গ্রন্থাগারের মাধ্যমেও সেটি সংগ্রহ করা সম্ভব।
আজকের দিনে পাঠ প্রিয় মানুষের কাছে বই সহজলভ্য বস্তু। পকেটে পয়সা থাকলে এবং চাইলেই যে কেউ যে কোনো বই সংগ্রহ করতে পারেন। গ্রন্থাগারের মাধ্যমেও সেটি সংগ্রহ করা সম্ভব। এমন কি অন্তর্জালেও ছড়ানো আছে কাঙ্ক্ষিত বই সংগ্রহের একশ একটা পথের হদিশ। ক্রেতা কে, নারী না পুরুষ এমন অবান্তর প্রশ্নের ঝুট-ঝামেলা নেই। কিন্তু এমন একটা সময় ছিল যখন বই সংগ্রহ বেশ কঠিনসাধ্য ব্যাপার হিসেবে বিবেচিত হতো। বই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে পছন্দ-অপছন্দ তো দূরের প্রশ্ন। আর পাঠক হিসেবে কে পড়বার উপযুক্ত কে নয়, সে বিষয়ে বেঁধে দেওয়া ছিল নানান রীতিনীতি। বই সংগ্রহের ব্যাপারে সঙ্গত কারণে সমাজে বিশেষ সুবিধাভোগীদের তেমন সমস্যায় পড়তে হতো না। কিন্তু সাধারণ শ্রেণী এ ক্ষেত্রে নানামুখী প্রতিবন্ধকতার শিকার হতেন। সেটি সঙ্গত কারণেই। এই যখন অবস্হা, তখন নারীর জন্য বাধা-নিষেধের তালিকায় পঠন-পাঠনের নিষেধাজ্ঞার ঢ্যাঁড়া যে সশব্দেই পিটানো হয়েছিল তা বলাই বাহুল্য। সেসময় সচ্ছল পরিবারের ছেলের জন্য গৃহ শিক্ষক নিযুক্ত করার প্রচলন ছিল। সমাজের মান্যগণ্যেরা ঘরের ছেলেটিকে বাড়ি থেকে দূরের কোনো স্কুলে পাঠানোর পক্ষপাতি ছিলেন। তাতে করে বিভিন্ন স্হান থেকে আসা ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশার ফলে পরস্পর জ্ঞান- অভিজ্ঞতা আদান-প্রদানের সুযোগ ছিল; এতে তাদের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে- এমন মনোভাবের প্রতি সহমত ছিলেন অনেকেই। কিন্তু ঘরের মেয়েটির জন্য এরকম ব্যবস্হায় মান্যবরেরা খুব একটা সরব হননি। ফলে অধিকাংশ পরিবারের মেয়েরাই থেকে যেত অক্ষর জ্ঞানহীন। ছেলেটির অবাধ বিদ্যাশিক্ষার আয়োজনে সামিল হওয়ার অধিকার রাখলেও মেয়ের ক্ষেত্রে ছিল নিয়ম নীতির কড়াকড়ি; এবং অনেকক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষ। সেটা কী? না সেক্ষেত্রে ঘরের মেয়েটি যদি মঠ কিংবা গীর্জার নান্ অর্থাৎ সন্ন্যাসিনী বা মঠতপস্বী হতে রাজী থাকতো শুধুমাত্র সেই শর্তের ভিত্তিতে মেয়ের পড়ার ব্যাপারে বাধা তুলে নেওয়ার মহানুভবতা দেখানো হতো। আর মঠ বা গীর্জার তপস্বীদের বিভিন্ন দায়িত্বের মধ্যে যেহেতু চিঠিপত্র পড়া এবং তার জবাব দেবারও একটা ব্যাপার ছিল, তখন তাকে পড়াশোনা করতে না দিয়েও তো উপায় ছিল না।
১৫শতকে ইউরোপের অনেক দেশের ক্ষমতাসীনেরা এই বিষয়ে মোটামুটি একমত ছিলেন। মেয়েদের বই পড়া অর্থাৎ পড়াশোনা নিয়ে এমন একটি বক্তব্য তুলে ধরলে তৎকালীন সমাজের চিত্র খানিকটা হয়ত বোঝা যাবে-- “It is not appropriate for girls to learn to read and write unless they wish to become nuns, since they might otherwise, coming of age, write or receive amorous missives,”! নারী যেহেতু দোজখের দ্বার; কাজেই দোজখ থেকে নিজেকে বাঁচাতে, সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে নিবিড়ভাবে জ্ঞানলাভের মাধ্যমে নারী নিজেকে পরিশুদ্ধ রাখতে পারে - এমন বিবেচনা থেকেও অনেক সমাজপতি মেয়েদের মঠ কিংবা গীর্জাধীন কনভেণ্টে পড়াশোনা করানোর পক্ষপাতি ছিলেন। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, একটা সময় এমন ছিল যখন চাইলেই একজন নারী পড়ুয়া হিসেবে বইয়ের সান্নিধ্যে যাওয়ার অধিকার রাখতেন না।
সময় উজিয়ে উনিশ শতকে ভার্জিনিয়া উলফের জীবনের দিকে চোখ রাখলে পাঠক হিসেবে ইংল্য্যন্ডের বিখ্যাত এক গ্রন্থাগারে প্রবেশ করা নিয়ে তাঁর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক বিধি নিষেধের কড়াকড়ি দেখে আঁতকে উঠতে হয়। যুগে যুগে নারীর জন্য সমাজের প্রায় প্রতিটা স্তরে তৈরি করা হয়েছিল কণ্টকযুক্ত পথ। সেই পথে হেঁটে গিয়ে প্রতি পদে একজন মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট, বেগম রোকেয়া, আশালতা সেন প্রমুখ নারীদের নিজেকে প্রমাণের মধ্যে দিয়ে হতে হয়েছে পড়ুয়া, সমাজসংস্কারক, লেখক এবং সর্বোপরি একজন মানুষ। নিজেকে প্রমাণের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী হাতিয়ার শিক্ষা- শিক্ষার প্রধান মাধ্যম বই।
আজকের স্তরে পৌঁছাতে বইয়ের যে দীর্ঘ যাত্রার ইতিহাস; সে গল্পটা খুব সংক্ষেপে আরেকবার শুনে নেওয়া যাক।
প্রাচীন যুগে ছাপানো বইয়ের বিকাশ পর্বের আগে পুথি সংরক্ষণের রীতি চালু ছিল। বিশেষ সংরক্ষণাগার বা পুথিশালায় পুথি সংরক্ষণ করা হতো। সেসময় অনেক মন্দির বা গীর্জার গোপন কক্ষে মূল্যবান পুথি সংরক্ষণের নজির ইতিহাসে পাওয়া যায়। বহিশত্রুর হাত থেকে মূল্যবান পুথি-পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের জন্য অনেক মন্দিরে ‘ভাণ্ডার’ তৈরি করা হতো। সম্ভবত জৈন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এটির অধিক প্রচলন ছিল। ভারতের ইতিহাস থেকে জানা যায় বহিশত্রুর আক্রমণের লুণ্ঠন পর্বে মূল্যবান ধন-সম্পদের তালিকায় ‘পুথি’ও ছিল একটি আদরনীয় উপাচার। এরকম আক্রমণের মুখে বহুবার ভারতকে পড়তে হয়ছে। একাদশ-দ্বাদশ শতকে বহিশত্রুর আক্রমণের মুখে অনেক বৌদ্ধভিক্ষু জীবন বাঁচানোর তাগিদের পাশাপাশি মূল্যবান পুথি সঙ্গে নিয়ে পালাতে দ্বিধা করেননি। মূলত তাঁরা পালিয়ে তিব্বতে আশ্রয় নেন। মন্দের ভালো, তাঁদের কারণে অনেক পুথি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পায়। পশ্চিম ভারতেও সমকালের কিছু জৈন পুথি লুণ্ঠনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল মন্দিরের গোপন ‘ভাণ্ডারে’ রক্ষিত থাকার কারণে।
এসব পুথি পাঠের অধিকার সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ছিল না। মন্দির গীর্জা বা মঠের সাথে জড়িত হর্তাকর্তা এবং শিক্ষার্থীরাই সেগুলো পাঠের অধিকার রাখতেন। এর মধ্যে আনুমানিক ৪০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ স্ক্রোল বা গোটানো বইয়ের কদর একেবারেই স্তিমিত হয়ে আসে। তার পরিবর্তে আধুনিক বইয়ের পূর্বসূরী মলাটের মধ্যে সমান মাপের চামড়ার পাতাওয়ালা বইয়ের প্রচলন শুরু হয়। এরকম বইয়ের চামড়ার দুই পিঠেই লেখা থাকতো। ক্রমশ চামড়া ভাঁজ করার রীতি চালু হয়। দু’ভাগে বিভক্ত পার্চমেন্টকে বলা হতো ফোলিও, চার ভাগ করলে কোয়ার্টো, আটভাগে ভাগ করা হলে বলা হতো অক্টাভো। ষোড়শ শতকে ইউরোপে বইয়ের পাতা ভাগের এই রীতি বিধিবদ্ধ করা হয়। সেই সাথে অনেক স্হানে এই রীতি বরখেলাপের শাস্তিযোগ্য দৃষ্টান্তও চালু হয়। ফ্রান্সের নরপতি প্রথম ফ্রাঁসোয়া( Francois) ১৫২৭ সালে ঘোষণা করেন- “ইচ্ছামতো কেউ চামড়ার বইয়ের পাতা ভাঁজ করতে পারবে না; করলে দণ্ড।” বর্তমানের যে সমস্ত পাঠক নির্দয়ভাবে বইয়ের পাতা ভাঁজ করা, অযথা পাতায় দাগানো, ছবি আঁকাআঁকিসহ নানাভাবে বইয়ের অযত্ন করে থাকেন, তারা প্রথম ফ্রাঁসোয়ার সময়কালে জন্মালে কপালে ব্যাপক মাত্রার খারাবি ছিল। আমেরিকার অনেক অঞ্চলে দাসেদের জন্য বই পড়া তো দূরের কথা, স্পর্শ করারও অধিকার ছিল না। এই নিয়ম ভঙ্গ করলে অশেষ নির্যাতনের শিকার হতে হতো।
সভ্যতার অগ্রগতির নানা ধাপের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে চলতে এক সময় কাগজের বইয়ের আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকেই মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল ভৌগোলিক বাধাবিঘ্নকে সে অতিক্রম করবে। নিরন্তর চেষ্টায় সেটাতে সে সক্ষমও হয়। মানুষের এসব বিজয়ের ইতিহাস বইয়ের পাতায় অনাগত ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখার যতটা না আকুতি, তারচে বুঝি ঢের বেশি ছিল নিজেকে মহাকালের গর্ভে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলার ভয়। হয়ত সেই ভাবনা থেকে অতীতের মানুষেরা জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিভিন্ন আবিষ্কারের ঘটনা, পরিস্হিতি মোকাবেলার নানা কীর্তিকাহিনি লিপিবদ্ধের তাগিদ অনুভব করেছিল। বইয়ের পাতায় সেসব লিখে যাবার আগ্রহ জেগেছিল। বই সেই লক্ষ্যের একটি বড়সড় পদক্ষেপ।
বই প্রসঙ্গ এলে সঙ্গতভাবে লাইব্রেরির কথাও চলে আসে। স্ক্রল বই, পুথি যেভাবে সংরক্ষণ করা হতো বই সংক্ষরণের শুরুটাও অনেকটা তেমনই ছিল। অনুমান করা হয় মিশরের এক গীর্জায় বই সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগারের সূচনা। লাইব্রেরি শব্দের উৎপত্তি কমবেশি অনেকেরই জানা। যাঁদের জানা নেই তাঁদের জন্য আরেকবার আওড়ে নেওয়া যাক; গ্রন্থাগার বা পাঠাগারের ইংরেজি লাইব্রেরি (Library) প্রতিশব্দের উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ লিবার(Liber) থেকে। এর অর্থ হলো বই বা পুস্তক। লিবার শব্দটি এসেছে লাইব্রিয়াম( librium) শব্দ থেকে। যার অর্থ বই রাখার স্হান। লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার এমন একটি স্হান যেখানে পাঠক গ্রন্থপাঠ, তথ্যানুসন্ধান, গবেষণা ইত্যাদির সুযোগ পেয়ে থাকেন।
সর্ব বিষয়ে বাঙালির ভাবনা ঋদ্ধের জাদুকর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লাইব্রেরি বিষয়ে কী বলেছেন প্রসঙ্গক্রমে সেটাও শুনে নেওয়া যেতে পারে:
“মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া-পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে । ইহারা সহসা যদি বিদ্রোহী হইয়া উঠে, নিস্তব্ধতা ভাঙিয়া ফেলে, অক্ষরের বেড়া দগ্ধ করিয়া একেবারে বাহির হইয়া আসে ! হিমালয়ের মাথার উপরে কঠিন বরফের মধ্যে যেমন কত কত বন্যা বাঁধা আছে, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে মানবহৃদয়ের বন্যা কে বাঁধিয়া রাখিয়াছে !
বিদ্যুৎকে মানুষ লোহার তার দিয়া বাঁধিয়াছে, কিন্তু কে জানিত মানুষ শব্দকে নিঃশব্দের মধ্যে বাঁধিতে পারিবে ! কে জানিত সংগীতকে, হৃদয়ের আশাকে, জাগ্রত আত্মার আনন্দধ্বনিকে, আকাশের দৈববাণীকে সে কাগজে মুড়িয়া রাখিবে ! কে জানিত মানুষ অতীতকে বর্তমানে বন্দী করিবে ! অতলস্পর্শ কালসমুদ্রের উপর কেবল এক-একখানি বই দিয়া সাঁকো বাঁধিয়া দিবে!
অমৃতলোক প্রথম আবিষ্কার করিয়া যে যে মহাপুরুষ যে-কোনদিন আপনার চারিদিকে মানুষকে ডাক দিয়া বলিয়াছিলেন ‘তোমরা সকলে অমৃতের পুত্র, তোমরা দিব্যধামে বাস করিতেছ’ সেই মহাপুরুষদের কণ্ঠই সহস্র ভাষায় সহস্র বৎসরের মধ্য দিয়া এই লাইব্রেরির মধ্যে প্রতিধ্বনিত হইতেছে।”
লাইব্রেরি সৃষ্টির ইতিহাস বইয়ের মতোই সুপ্রাচীন। সভ্যতার ইতিহাসে ঠিক কবে কখন গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল তার সঠিক দিনক্ষণ জানা সম্ভব হয়নি। ইতিহাসের নানা উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞেরা এই ধারণায় পৌঁছেছেন যে, প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতায় গ্রন্থাগারের উন্মেষ ঘটেছিল। ডঃ মাহফুজ পারভেজের প্রবন্ধ ‘পৃথিবীর প্রথম গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার’ থেকে জানা যায়: “খ্রিষ্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্য-এশিয়া মাইনর কেন্দ্রিক অ্যাসিরিয়ান সভ্যতার অন্যতম রাজা আসুরবানিপাল (Assurbanipal) তার নিজস্ব সংগ্রহশালার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি একাধারে সেনাপতি ও যোদ্ধা, শাসক ও প্রশাসক এবং গ্রন্থপ্রেমী ও বাস্তব গ্রন্থাগারিক ছিলেন। এই রাজার ইতিহাস সম্পর্কে অনেকগুলো গবেষণায় যা বলা হয়েছে, তাতে তাঁর গ্রন্থাগারিক পরিচিয়টি স্পষ্ট। একটি উক্তি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে: Assurbanipal was first of all a warrior, then an administrator, and finally a librarian. মানবেতিহাসে আর কোনও শাসকের পরিচয় ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করার সময় গ্রন্থাগারিক-এর মর্যাদা আরোপ করা হয় নি, যেমনটি বলা হয়েছে অ্যাসিরিয় শাসক আসুরবানিপাল সম্পর্কে।”
এই সমস্ত সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ এবং প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পাওয়া। হয়ত ভবিষ্যতে এমনও হতে পারে নতুন অনুসন্ধানের মাধ্যমে আজকের পাওয়া সিদ্ধান্ত উল্টে গেল। কারণ মানব সভ্যতার শুরুর দিককার সবটা আজও আমাদের অজানাই থেকে গেছে। মহাকালের গর্ভ থেকে কবে কখন কোন সত্যি আমাদের সামনে উপস্হিত হয় সেটা আমরা জানিনা। নতুন কোনো সত্য উদঘাটনের সম্ভাবনা তাই থেকে যাচ্ছে।
তবে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত, এবং দেশ-দেশান্তরে চলমান অনুশীলন থেকে এটা বেশ স্পষ্ট যে পুরুষের পাশাপাশি পড়ুয়া, শিক্ষার্থী কিংবা কোনো কাজে দক্ষ হিসেবে নিশর্তভাবে নারীকে মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে তৎকালীন সমাজ মোটেও উদার ছিল না। আজকের সময়েও বিষয়টা সর্বস্তরে খুব চর্চিত সেকথাও সপাটে বলা যাবে না। তারপরও যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অবস্হার পরিবর্তন ঘটেছে। নারীকে নানাভাবে কোণঠাসা করার রীতি সুপ্রাচীন। নারীবাদ, পুরুষবাদ কিংবা নারী-পুরুষের সমাধিকার নিয়ে যদিও এই কলাম নয়। কিন্তু বই জগতের নানা বিষয়আশয়ের হাত ধরে এই আলোচনাও সময়ে সময়ে উঠে আসবে- যা মোটেও অপ্রাসঙ্গিক নয় বলেই মনে করি। বিশ্বাস করি বই দুনিয়ার ইতিহাসের একচেটিয়া বক্তা কিংবা প্রবক্তা একা পুরুষ নন- নারীও সে যাত্রার সঙ্গী ছিলেন। সমাজব্যবস্হার কারণে সপাটে নারীর ভূমিকা রাখার হয়ত সুযোগ ঘটেনি। কিন্তু এই ইতিহাসে নারীর কোনো ভূমিকা নেই এমন দাবী মনে হয়না শুভবুদ্ধির বোদ্ধা পাঠকেরা করবেন।
নিজে নারী বলেই প্রাচীন কিংবা আধুনিক ইতিহাসের পাঠক হিসেবে, লেখক হিসেবে, সর্বোপরি একজন মানুষ হিসেবে নারীর অবস্হান নিয়ে বিশেষ আগ্রহ আছে। সেই আগ্রহের স্হান থেকে আলোচনায় মাঝে মধ্যে এই বিষয়টি উঁকি দেওয়া অসঙ্গত নয় বলে মনে করি। একে তর্ক উসকে দেবার মানসিকতা না ভেবে ‘সত্যেরে লও সহজে’ বলে গ্রহণ করলে সবদিক থেকেই বিষয়টা সুখময় হবে।
এই বিষয়টা কেন মনে উদয় হলো সে গল্পটা একটু খুলে বলা দরকার। টেড টকে(TED Talk) ব্রিটিশ থিয়েটার পরিচালক, প্রডিউসার Jude Kelly এর বক্তব্য শুনতে গিয়ে ভাবনায় টোকা দেবার মতো কিছু তথ্য জানতে পারি। বক্তব্যের শুরুতেই জুড কেলি যে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেন সেটা এমন: Why do we think that stories by men are deemed to be of universal importance, and stories by women are thought to be merely about women?” এমন বক্তব্য কেন দিলেন কেলি? এই বক্তব্যের পেছনের গল্পটা হচ্ছে, কেলি আফ্রিকার একটি দেশ সোমালিল্যান্ডে ঘুরতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি লাস গীল গুহা (The Lass Geel caves) দেখতে যান। লাস গীলে বিশ্বের প্রাচীনতম কিছু গুহাচিত্র রয়েছে। যেগুলো অনুমানিক ৯,০০০ থেকে ১১,০০০ বছরের পুরোনো। গুহাচিত্রগুলো তিনি ঘুরেঘুরে দেখেন। প্রাচীনকালে যখন মানুষের অক্ষরজ্ঞান ছিল না ছবির মাধ্যমেই তো সে তার দৈনন্দিন জীবন, স্মৃতি ইত্যাদি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতো। সেরকম কিছু নমুনার মধ্যে একটি ছোট্ট ছবি দেখে কেলির মনে হয় ওটা ছোট্ট এক মেয়ের। চিত্রটা তাঁর মনে এমন ভাবনা উসকে দেয়, মেয়েটি যেন তিনি, যেন একলহমায় তাঁর আনন্দময় শৈশব ছবির মধ্যে উঁকি দিয়ে গেল। তাঁর খুব জানতে ইচ্ছে করে, এই ছবির আঁকিয়ে কে? কৌতূহলে তিনি গুহার তত্ত্বাবধানে থাকা কিউরেটরের কাছে জানতে চান। তাঁদের কথোপকথনটা কেলির বয়ানেই শুনি আসুন : “Tell me about the men and women who painted these.” And he(the curator) looked at me absolutely askance, and said, “Women didn’t paint these pictures.” And I said, “Well, it was 11,000 years ago.” I said, “ How do you know?”
And he said, "Women don't do these things. Men made these marks. Women don't."
বহু বহু বছর উজিয়ে আসা কারো কথার ধ্বনি কি কানে বাজলো আপনার? বেজে থাকলে ঠিকই শুনেছেন। দুইহাজার ৩০০ বছর আগে মহামতি অ্যারিস্টটল উচ্চারণ করেছিলেন - “নারী পুরুষের তুলনায় অক্ষম এবং কমবুদ্ধি সম্পন্ন।” ওই বৃত্তের ভেতর দাঁড়িয়ে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের চিবুক নাড়াটা যে কলের পুতুলের মতোই হবে সে তো বলাই বাহুল্য! এমন চিন্তাবদ্ধের সারিতে যে শুধু লাস গীলের কিউরেটর মহাশয় আছেন তো নয়- এমন ব্যক্তিরাও আছেন যাঁদের বক্তব্য আমাদের শুধু বিস্মিতই করে না একই সাথে ক্ষুদ্ধও করে। ক্ষুদ্ধ এই জন্য যে সভ্যতার এতটা বছর পরও কেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত একজন মানুষের ভাবনা পুরোনো ভাবনার গণ্ডিতেই আটকে থাকবে?
একজন নারীর পড়াশোনার ক্ষেত্রে যেমন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-ধ্যান ধারণা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। লেখক হিসেবে নারীর আবির্ভাবেও সেই একই মানসিকতা পথ রোধ করে দাঁড়াতে চেয়েছে। অথচ পুরুষের ক্ষেত্রে ‘এসো মোর দাদা’ বলে দুহাত বাড়িয়ে গ্রহণ করার মানসিকতা দেখা গেছে। ছোট্ট একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
থমাস পেইন(Thomas Paine: February 9, 1737 – June 8, 1809) এবং মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট্ ( Mary Wollstonecraft: April 27, 1759, September 10, 1797) দুজনেই ছিলেন অষ্টাদশ শতকের ইউরোপের এনলাইটেনমেন্ট যুগের চিন্তক। এই দুজনের প্রায় কাছাকাছি সময়ে দুটি বই প্রকাশিত হয়। থমাস দুই খণ্ডে লিখেছিলেন দ্য এইজ অফ রিজন(The Age of Reason- 1794) এবং মেরি লিখেছিলেন অ্যা ভিন্ডিকেশন অফ দ্য রাইটস অফ উইমেন A Vindication of the Rights of Woman (1792)। বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে দুটি বইই ছিল অমূল্য। অথচ দুই বইয়ের ভাগ্যে একই সমাদর জুটেনি। থমাস পেইনের দ্য এইজ অফ রিজন প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে- যার ঢেউ পৃথিবীর অনেক দেশে আছড়ে পড়েছিল। অথচ মেরির বইটিকে সেই সমাদর অর্জন করতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরো পঞ্চাশ বছর!
চিন্তার দৈনতায় নিজেদের ক্ষয় আত্মগোপন করে থাকে। জ্ঞান সাধনার জগত জ্ঞানীর জন্য আনন্দধাম, সেটা যুযুধানের জায়গা হতে পারে না।
অথচ বইয়ের আলোকিত জগতে এমন অনেক ইতিহাস জমা আছে যা পাঠ করে পাঠক বিস্মিত হবেন; কিছু বিষয় তাকে ভাবিত করবে। চিন্তার জগতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবে --- সভ্যতার এতটা পথ হেঁটে এসে, পাঁজা পাঁজা বই পড়ে- সাহিত্যের মহা পুরস্কারে ভূষিত হয়েও কেন একজন ভি এস নাইপল তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দকে অতি সরলীকরণ ভাবে উচ্চারণ করে বিভেদ রেখা টানতে উৎসাহিত হন?-- “I can read two paragraphs and know immediately if it’s written by a woman, and I just stop reading, because it’s not worthy of me.” অন্যকে তুচ্ছ করার মতো এমন উচ্চারণ কী চারপাশের এত এত কাজ কে তুচ্ছ করে তোলে না? পণ্ড মনে হয় না সবটা? সব আয়োজন ম্লান করার এমন মানসিকতা আদৌও কী স্বাস্হ্যকর?
শেষ করার আগে শ্রীপান্থের “পড়ার বইয়ের বাইরের পড়া” থেকে কিছু উজ্জ্বল ইতিবৃত্ত পাঠকদের জন্য উপহার হিসেবে দেওয়া হলো। যাঁরা জানেন তাঁদের কথা আলাদা, আমার মতো যারা জানতেন না তাঁদের তথ্যগুলো হয়তো মনে হবে রীতিমতো চাঞ্চল্যকর। পৃথিবীর অনেক দেশেই, অনেক সমাজেই পিতৃতন্ত্রের সৌজন্যে নারীদের পড়ার কোনও অধিকার ছিল না। কিন্তু আশ্চর্য এই, প্রাচীন পৃথিবীতে দশজন বাক্ সিদ্ধই ছিলেন নারী। তাদের জিহ্বাগ্রে উচ্চারিত হয়েছিল মানুষ ও সভ্যতার ভবিষ্যৎ। এই দ্রষ্টাদের সদুক্তি সংকলন হাজার হাজার বছর ধরে নিয়ন্ত্রণ করেছে মানুষের ভাগ্য। শক্তিধরেরাও মুক্ত ছিলেন না তাঁদের প্রভাব থেকে!
দ্বিতীয় চমকপ্রদ সংবাদ- বিশ্বের প্রথম লেখক যিনি, তিনি নারী। ভার্জিনিয়া উলফ একবার বলেছিলেন নামহীন যত উক্তি এবং রচনা, সবই নারীর-“আ্যানোনিমাস ইজ ওম্যান”। মাঙ্গোয়েল যে-রচনার কথা বলেছেন সেটি স্বাক্ষরিত। নাম তাঁর এনহেদুয়ান্না (Enheduanna) | তিনি রাজদুহিতা। পশ্চিম এশিয়ার প্রাচীন আক্কাড (Akkad) দেশের রাজা প্রথম সারগন-এর (Sargon) কন্যা তিনি। চাঁদের দেবী নান্না-র (Nanna) পূজারি এই রাজকন্যা প্রেম এবং যুদ্ধের দেবী ইনন্নার (Inanna) উদ্দেশে কিছু গীত রচনা করেছিলেন। মাটির ফলকে সেগুলি এখনও উৎকীর্ণ রয়েছে। তলায় রাজকুমারীর স্বাক্ষর। এ-ঘটনা
খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০ অব্দের।
তৃতীয় সংবাদ; পৃথিবীর প্রথম উপন্যাসিকও একজন নারী। তিনিও পূর্বদেশীয়। পিতৃতন্ত্রের কঠোর কঠিন শাসন, পায়ে নিষেধের নিগড়, আধখানা আকাশও চোখের আড়ালে। রেশমের বাহারি পর্দার আড়ালে মসৃণ অন্তঃপুর। সেখানে নানা আয়োজনে সুখের অনন্তসাগর। তবু মনে বিষাদ, হৃদয়ে চাঞ্চল্য। সুতরাং, একাদশ শতকে সূর্যোদয়ের দেশের এক অসূর্যম্পশ্যা অভিজাত নারী মুরাসাকি (Lady Murasaki) কাগজ কলম নিয়ে বসলেন। রচিত হল নতুন ধারার রচনা-উপন্যাস। নাম, বাংলায় বললে-’গেস্তির উপাখ্যান'। ইংরেজিতে 'টেল অব গেঞ্জি' বিশ্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস হিসাবে আজ দেশে দেশে বন্দিত সেই বই। মুরাসাকি এই রচনা শুরু করেন ১০০১ খ্রিস্টাব্দে, আর তামাম শোধ ১০১০-এ।
আরও আছে। চতুর্থ চমক, বিশ্বের প্রথম পেশাদার বই-সমালোচকও একজন নারী। তিনি আমেরিকার প্রথম বৈদেশিক সংবাদদাতা, সম্পাদক এবং লেখক মার্গারেট ফুলার। বই.সমালোচনা বা আলোচনাকে তিনিই প্রথম গ্রহণ করেন সর্বক্ষণের পেশা হিসাবে। মার্গারেট ফুলার উনিশ শতকের মানুষ। তিনি ওয়াল্ট হুইটম্যান-এর সমসাময়িক। ফুলার তৎকালের একজন বিশিষ্ট নারীবাদীও বটে। তাঁর আবেগমথিত রচনা “ওম্যান ইন দ্য নাইনটিনথ সেঞ্চুরি” এখনও নাকি বিবেচিত হয় নারী-চেতনার এক মুল্যবান দলিল হিসাবে।”
কৃতজ্ঞতা:
A History of reading: Alberto Manguel
পড়ার বইয়ের বাইরের পড়া: শ্রীপান্থ
নারীর লেখা নারীর কথা: দীপা বন্দোপাধ্যায়
লাইব্রেরি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
TED Talk : Youtube
উইকিপিডিয়া