ওরিয়েন্টালিজম কি?
বিগত দুই শতকের পণ্ডিতিচর্চায় 'ওরিয়েন্টালিজম্' শব্দটির ব্যঞ্জনা প্রায় আমূল পাল্টে গেছে।
আভিধানিক অর্থে প্রাচ্য বা ‘ওরিয়েন্ট’ নিয়ে যাকিছু গবেষণা—নৃতাত্ত্বিক, সমাজতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক কিম্বা ভাষাতাত্ত্বিক—তাই হল ‘ওরিয়েন্টালিজম্' অথবা 'প্রাচ্যবাদ' এবং এরকম যে কোন ধারার পণ্ডিতই হলেন ‘ওরিয়েন্টালিস্ট' অথবা ‘প্রাচ্যবাদী’। ঐতিহাসিকভাবে শব্দটির অর্থ আরেকটু নির্দিষ্ট। আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মূলত উইলিয়ম জোনসের ব্যক্তিত্ব এবং এশিয়াটিক সোসাইটির (১৭৮৪) কর্মকাণ্ডকে ঘিরে যে জ্ঞানচর্চার পত্তন হয় তার সূত্রেই পণ্ডিতিমহলে ‘ওরিয়েন্টালিজম্' শব্দটি প্রচলন লাভ করে। পরবর্তী শতকে তা বিস্তৃতিলাভ করে ফরাসি শিল্প আন্দোলন এবং ব্রিটিশ ও জার্মান রোম্যান্টিক জাগরণের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। ইস্ট- ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতবর্ষের আইনকানুন অনুযায়ী ভারতবর্ষকে শাসন করা উচিত এবং সেজন্য তার কর্মাধ্যক্ষদের প্রয়োজন ভারতবর্ষীয় ভাষা এবং সংস্কৃতিতে অবগাহন করা—এমন এক ধারণা থেকেই ব্রিটিশ ‘ওরিয়েন্টালিজম্'-এর জন্ম। এই ধারণার অন্যতম প্রবক্তা, প্রথম বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক উভয় দিক থেকেই এর যাথার্থ্য নিরূপণ করেন। তাঁর মতে যেকোনো জ্ঞানের সঞ্চয়ে বিশেষত শাসিতের সঙ্গে সামাজিক আন্তঃক্রিয়ার মাধ্যমে যে জ্ঞান সঞ্চয় তা সবসময়ই রাষ্ট্রের পক্ষে উপকারী। সামাজিক আন্তঃক্রিয়ার ফলে উভয়গোষ্ঠীর মধ্যে যে সহমর্মিতার সৃষ্টি হয় তা শাসকের (এক্ষেত্রে ব্রিটিশ) মানবতাকেই কেবল সমৃদ্ধ করে না, তা তাদের আধ্যাত্মিক উন্নতিরও সহায় হয়। এই নীতি উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বহাল থাকে যতদিন না ইভাঞ্জেলিকাল ধারা এবং উপযোগিতাবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এরপর থেকে ভারতবর্ষের প্রতি ব্রিটিশ নীতি দুটি দিশায় বিভক্ত হয় ইঙ্গবাদী এবং প্রাচ্যবাদী। সিপাহিবিদ্রোহ-পরবর্তীকালে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে রোখার জন্য মুসলমান সভ্যতা- সংস্কৃতিকেন্দ্রিক ‘ওরিয়েন্টালিস্ট চর্চা' নতুন করে সক্রিয় হলেও স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত ভারতবর্ষের নীতি নির্ধারণ করে মূলত ইঙ্গবাদীরাই। এসব সত্ত্বেও বহুকাল পর্যন্ত ‘ওরিয়েন্টালিজম্’ শব্দটি ব্যবহৃত হত একটি মূল্য নিরপেক্ষ বর্ণনামূলক শব্দহিসেবে, প্রাচ্য বিষয় গবেষকদের অনুসন্ধিৎসা বোঝানোর জন্য। এর সঙ্গে কোনো মতাদর্শের প্রশ্ন জড়িয়ে ছিল না।
বিগত দুই শতকের পণ্ডিতিচর্চায় 'ওরিয়েন্টালিজম্' শব্দটির ব্যঞ্জনা প্রায় আমূল পাল্টে গেছে। যে অর্থে আজকের গবেষক মহলে শব্দটি ব্যবহৃত হয় তা প্রচলন লাভ করে মূলত আনোয়ার আব্দেল মালেক (সিভিলাইজেসন অ্যান্ড সোশাল থিয়োরি, ১৯৬৩) এবং পরবর্তীকালে এডওয়ার্ড উইলিয়াম সাইদের (ওরিয়েন্টালিজম্, ১৯৭৮) গবেষণার মধ্যে দিয়ে। প্রাচ্যবাদ, সাইদের মতে, প্রাচ্য প্রতীচ্যের মধ্যে জ্ঞানতান্ত্রিক এবং সত্তাতাত্ত্বিক বিভাজনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এক বিশেষ চিন্তাশৈলী। এই মূলগত বিভাজনকে স্বতঃসিদ্ধ মেনেই পশ্চিমের কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিক ও অর্থনীতিবিদরা নিজেদের সাহিত্যে, কাব্যে, সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিবৃতিতে প্রাচ্যের মানুষ, তাদের রীতিনীতি, মনন, ভবিতব্য সব কিছুরই আলোচনা করেছেন। এই প্রাচ্যবাদের চত্বরে ইসকাইলাস থেকে হুগো, দান্তে, কার্ল মার্ক্স সকলেরই আনাগোনা। তবে আঠারো শতকে প্রাচ্যবাদ ইতিহাসগত এবং বস্তুগতভাবে এক ভিন্ন তাৎপর্যলাভ করে। এই সাম্রাজ্যবাদের যুগে প্রাচ্যবাদ দেখা দেয় প্রাচ্য নিয়ে কারবার করার এক বিশেষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে। প্রাচ্যকে শাসন করার মধ্যে দিয়ে তাকে শিক্ষিত, সভ্য করে তোলার মধ্যে দিয়ে, তার রীতিনীতি নির্ধারণ করার মধ্যে দিয়ে প্রাচ্যবাদ প্রাচ্যকে পুনর্গঠন করার, প্রাচ্যের উপর পশ্চিমি আধিপত্যকে নিশ্চিত করার এক বিশেষ হাতিয়ার হিসেবে তৈরি হয়। সাইদের এই তত্ত্বায়নের পেছনে বিশ শতকের দুটি তাত্ত্বিক ধারা মূলত কার্যকর হয়েছে। প্রথম, মিশেল ফুকোর ডিসকোর্সের ধারণা--অর্থাৎ ভাষাতাত্ত্বিক আধার, যার মধ্যে জ্ঞান ব্যক্ত হয় ক্ষমতার রূপ হিসেবে। দ্বিতীয়, এর সঙ্গে সাইদ যুক্ত করেন আন্তোনিও গ্রামসির সাংস্কৃতিক প্রভুত্বের তত্ত্ব, যে সাংস্কৃতিক প্রভুত্বের মাধ্যমে উচ্চকোটির মানুষের নিম্নকোটির উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয় এবং বহাল থাকে। সাইদের এই তত্ত্বায়নের ফলে প্রাচ্যবাদ আর নিছক প্রাচ্যবিষয়ক জ্ঞানচর্চার সংজ্ঞায় আটকে থাকে না, তা পরিবর্তিত হয় একটি বিশেষ মতবাদে যার দ্বারা পশ্চিম নিজেকে সঞ্চারিত করার জন্য প্রাচ্যকে রূপান্তরিত করে প্রাক্কল্পিত এক মিথধর্মী কাঠামোয়। অন্যভাবে বলা চলে প্রাচ্যবাদের মূল কারবার সে অর্থে ‘প্রত্যক্ষ’ ‘বাস্তব’ প্রাচ্যকে নিয়ে নয়, তার আসল লক্ষ্য পশ্চিমের বিপরীতে এক ‘অন্য’-এর রূপকল্প সৃজন যার অস্তিত্বে নিহিত থাকবে পাশ্চাত্যের প্রভুত্বের, কর্তৃত্বের যাথার্থ্য। অতএব ঐতিহাসিকভাবে প্রাচ্যপ্রতীচ্যের যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা হল ক্ষমতার, আধিপত্যের এবং প্রভুত্বের জটিলতার। সাইদ আরো বলেন যে, প্রাচ্যের যে প্রাচ্যকরণ' হয় তা কেবল উনিশ শতকীয় প্রতীচ্যের সাধারণ কল্পনায় প্রাচ্য এভাবে ধরা পড়েছিল বলে নয়, এটা সম্ভব হয়েছিল প্রাচ্য তার এই রূপকল্পকে মেনে নিয়েছিল বলেই।
প্রাচ্যবাদকে মূলত একটি ঈঙ্গ-ফরাসি প্রকল্প হিসেবে দেখা উচিত। অর্থাৎ আঠারো শতকে ইংরেজ এবং ফরাসি জাতির সঙ্গে প্রাচ্যের (এ সময়ে মূলত ভারত এবং বাইবেল ভূমি) যে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা হয় তারই প্রকাশ ঘটে প্রাচ্যবাদে। উনিশ শতক থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত প্রাচ্যের বর্ধিত ভৌগোলিক পরিধিতে ইঙ্গ-ফরাসি আধিপত্যই বজায় থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এদের জায়গা নিয়ে নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
বলা বাহুল্য যে কোনো নতুন তত্ত্বায়নের মতো প্রাচ্যবাদের এই তাত্ত্বিক উপস্থাপনাও তুমুল বিতর্কের শিকার হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে পাঠ্যবস্তু নির্বাচনের প্রথাহীনতা নিয়ে, প্রাচ্য প্রতীচ্যের সম্পর্কের উচ্চাবচ রকমফের অগ্রাহ্য করা নিয়ে, নিম্নকোটি এবং উচ্চকোটি সংস্কৃতির ভেদাভেদকে নিশ্চিহ্ন করা নিয়ে, সংস্কৃতির অস্থায়িত্ব, বহুত্ব, মিশ্রতা এবং অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধকে উপেক্ষা করা নিয়ে এবং সর্বোপরি প্রাচ্যবাদের সমালোচনা করতে গিয়ে এক চিরন্তন প্রতীচ্যকে নির্মাণ করা নিয়ে। এ সমস্ত অভিযোগ অনেকাংশে যুক্তিগ্রাহ্য আবার অনেকাংশে সাইদের গ্রন্থের বিভ্রান্তিমূলক পাঠজনিত। সাইদের মূল উদ্দেশ্য প্রাচ্যবাদ সংক্রান্ত যে বিপুল সাহিত্যভাণ্ডার তার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ কিংবা প্রাচ্যের ‘প্রাচ্যকরণ'কে মেনে নেওয়ার প্রক্রিয়ার দোলাচল কিম্বা জটিলতা উদ্ঘাটন করা নয়। সাইদ দেখতে চেয়েছেন পশ্চিমি 'মন' কীভাবে নিজেকে চিহ্নিত এবং সঞ্চারিত করবার জন্য এক অধস্তন প্রতিপক্ষ নির্মাণ করতে চেষ্টা করেছে যা কোনো ঐতিহাসিক পর্যায়ে বিশ্লেষিত নয়, যা আবহমান কালের, যা চিরন্তন। এর ফলে জ্ঞাতে কিম্বা অজ্ঞাতে পশ্চিম নিজেরও এক চিরন্তন ভাবমূর্তি তৈরি করে ফেলেছে। কিছুকাল আগে মার্টিন বার্নাল (ব্ল্যাক এথেনা, ১৯৮৭) ধ্রুপদী সভ্যতার আদিসূত্র অনুসন্ধান করতে গিয়ে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। গ্রিক সভ্যতাকে পশ্চিমি সভ্যতার অঙ্গীভূত করার চেষ্টা, তাঁর মতে, এই আদিকল্প নির্মাণের হিসেবেই দেখা উচিত।
বহুস্তরের বিতর্কের ফলে সাইদ প্রণীত প্রাচ্যবাদের তত্ত্ব বিভিন্নভাবে সংশোধিত এবং পরিবর্ধিত হচ্ছে। তবে প্রাচ্যবাদের পুরোন সংজ্ঞা থেকে এই নতুন তাত্ত্বিক অভিক্ষেপ কেবল আঠারো-উনিশ শতকের সাম্রাজ্যবাদী মনকেই নতুন আলোকে উপস্থাপিত করেনি, ঔপনিবেশিত এবং উত্তর ঔপনিবেশিক অবস্থানকে বিশ্লেষণ করার আরো এক সম্পূর্ণ ভিন্ন দিশা দিয়েছে।