ইমতিয়ার শামীমের জেগে ওঠা অভিজ্ঞান
এই বইয়ের দুই মলাটের মধ্যে লিপিবদ্ধ হয়েছে ইমতিয়ার শামীমের দৃষ্টিভঙ্গি।
গতকাল আমি একটি আস্ত বই গিলে ফেলেছি। ভেনি ভিডি ভিসি এর মতো। খুললাম পড়লাম গিললাম। ঠিক যেমন দান্তে নরকের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করেছিলেন, আমিও তেমন সেই বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো অতিক্রম করেছি, পৃষ্ঠার আগুন আমার আত্মাকে উত্তেজিত করেছে; ঠিক যেমন ফিটজেরাল্ড বিংশ শতকের জোয়ারকে তুলে ধরেছিলেন। আমি দাঁড়িয়েছিলাম শহরের এক রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে। ট্রেনের জন্য অপেক্ষা। প্রচণ্ড গরম। সামান্য একটু ছায়ায় দাঁড়িয়ে প্রহর গুনছি। এমন সময় এক হকার নিয়ে এলো একগুচ্ছ পত্রিকা। প্রথম আলো, কালের কণ্ঠের মাঝে উকি দিচ্ছিলো একটি কমলা রঙের বই। পরিচিত নাম তাই হাত বাড়িয়ে তুলে নিলাম। হকার বললো ভাই এই এক পিসই আছে। আমি মুচকি হেসে বললাম সবাই এমনি বলে। গ্রন্থটির নাম পাঠ-প্রান্তরে। লিখেছেন ইমতিয়ার শামীম। লেখকের সাথে আমার পূর্ব পরিচয় তাঁর গল্পে। গল্পপাঠের কুলদা রায় একদিনের ফোনালাপে বলেছিলেন, আপনি ইমতিয়ারের গল্প পড়েন নি? বলেন কি! তাড়াতাড়ি পড়েন! কুলদার কণ্ঠে এমন কিছু ছিল যে ইমতিয়ারের গল্প না পড়ায় আমার ভীষণ অন্যায় হয়েছে, আমার জীবনটাই বৃথা। বাকিটা ইতিহাস। প্রবন্ধের বই এই প্রথম। অবশ্য ইমতিয়ার বলছেন এগুলি প্রবন্ধ নয়। তাঁর জবানে, "..প্রবন্ধ বলতে সাধারণভাবে একটি লেখায় যতটা গভীরতায় যাওয়ার লক্ষ্য থাকে, একাডেমিক ব্যাপারস্যাপার থাকে, চিন্তার মৌলিকত্ব থাকে, এমনকি ভাষা ও বাক্যের বুননে যেমন আস্বাদ থাকে, সেসবের কতটুকু এতে আছে, তা নিয়ে আমার নিজেরই সংশয়-সন্দেহ রয়েছে।” "...বইয়ের গদ্যগুলোয় তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে মূলত বিভিন্ন গ্রন্থ বা গল্প, উপন্যাস, কবিতা কিংবা নন-ফিকশন বই পাঠের পর জেগে ওঠা অভিজ্ঞান, উপলব্ধি, ভুলে যাওয়ার পরও স্মৃতির মণিকোঠায় রয়ে যাওয়া আস্বাদ ও অমোঘ সত্যটুকু।” লেখকের স্বাভাবিক বিনয় এবং তাঁর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় ধরা রয়েছে এই বইয়ে।
বইটিতে সাহিত্যের পাশাপাশি রয়েছে দেশ-জাতি-সমাজের, ব্যক্তিগত স্মৃতিরও সম্পৃক্তি। পুর্ণাঙ্গ বইটির সমালোচনা বা আলোচনা কোনটাই এই পরিসরে সম্ভব নয়। তাই আমি তাঁর প্রথম নন-ফিকশন গ্রন্থের আলোচনা প্রসঙ্গে কিছু বলবো। এখানে উনি আলোচনা করেছেন সাংবাদিক নাওমী ক্লেইনের ‘দ্য শক ডকট্রিন : দ্য রাইজ অব ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম' বইটি। বইটির প্রথম প্রকাশ ২০০৭এ, এর পরেও এর নানান সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। আমি বইটি পড়ি ২০১১ সামারে। নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং বিপ্লব এত সহজ নয় যেমন তা মনে হতে পারে। দক্ষিণ আমেরিকার জুনটাই হোক, বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিপুল বৈদেশিকরণ বা ইরাকের পুনর্গঠন - সরকারী এবং অর্থনৈতিক নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনগুলি শুধু মাত্র জনগণের দাবি দ্বারাই গড়ে ওঠে না, বরং নতুন বাজারে প্রবেশের উপায় খুঁজছে এমন কোম্পানিগুলির দাবি দ্বারাও গড়ে ওঠে।
ইমতিয়ার আলোচনা করেছেন বললে ভুল হবে উনি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পর্যালোচনা করেছেন। বিশ্ব-রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে যাদের আগ্রহ তারা নাওমী ক্লেইনের নাম শুনেই থাকবেন। মূল দ্য শক ডক্ট্রিন পড়লে জানতে পারবেন যে মিডিয়া ছাড়াও দুর্যোগ ও তার খবর থেকে অন্যান্যরাও লাভবান হয়। এই ধরনের সংকটগুলি ২% ধনী তাদের নিজস্ব স্বার্থে কুশলে ব্যবহৃত হয়। সাম্প্রতিক উদাহরণ কোভিড ও মেটা, আমাজনের অর্থনৈতিক স্বার্থ। ‘দ্য শক ডকট্রিন’ বইটি পড়লে পাঠক জানতে পারবেন, অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং শক থেরাপি চিকিৎসার মধ্যে কী সাদৃশ্য রয়েছে। কীভাবে মুক্ত বাজার অর্থনীতি চিলিকে পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র দেশের একটিতে পরিণত করেছে; এবং ইরাকি সরকারের আয়ের ৯৫ শতাংশ থেকে কীভাবে মার্কিন বনিকচক্র লুটেপুটে খেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন এক দেশ যার নিজের জন্য এক নিয়ম এবং অন্য সবার জন্য আলাদা নিয়ম। তাই এসব বনিকচক্রদের কোন শাস্তি হয় না। ইমতিয়ার দেখিয়েছেন কিভাবে এই অর্থনৈতিক শক থেরাপি বাংলাদেশকেও ছাড়েনি। লেখকের জবানীতে, "...যেমন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি, ১৯৭৫ সালের আগস্টে শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে খুলে দেওয়া হয়েছিল ধর্মীয় রাজনীতির ও মুক্তবাজারের দরজা, রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল জাতীয়করণ করা শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক-বিমাগুলো ব্যক্তিখাতে ফিরিয়ে আনা। এবং এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আরও এক সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে সম্ভব হয়েছিল বেসরকারিকরণকে আরও গতিশীল করা কিংবা বেসামরিক প্রশাসনে সামরিক কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়ার মতো স্পর্শকাতর ইস্যুকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা । পরে কথিত নির্বাচনকেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর পক্ষেও তাই আর অসম্ভব কিংবা কঠিন হয়নি সেই ব্যক্তিখাতের বিকাশ প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখা কিংবা সামরিক শক্তিকে বেসামরিক প্রশাসনের অংশীদার করে তোলা ।” যারা মূল ‘দ্য শক ডকট্রিন’ বইটি পড়েন নি তাঁদের অনুরোধ করবো বইটি সংগ্রহ করে পড়ার। এ এক চমৎকার বই। নাওমী ক্লেইন নিজেও একজন পুঁজিপন্থি কিন্তু "অনিয়ন্ত্রিত বাজার তাকে বারবার শোকার্ত করেছে, কেননা তিনি দেখেছেন যে ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজমের এই উত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তবাজার অর্থনীতিকে সাময়িকভাবে সুসংহত মনে হলেও শেষ পর্যন্ত তা সুসংহত থাকতে পারছে না”।
ইমতিয়ারের বইটি পড়ে আমি মুগ্ধ। আমার তেমন বলার কিছু নেই। সবই ইমতিয়ারের কথা। চমৎকার এই বইটিতে রয়েছে,
নাওমী ক্লেইনের ‘দ্য শক ডকট্রিন : দ্য রাইজ অব ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম
জাক রঁসিয়ের ‘হ্যাট্রেড অব ডেমোক্র্যাসি'
আবুল আহসান চৌধুরীর ‘লালন সাঁই : প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ‘ইতিহাস নির্মাণের ধারা'
জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি',
সনৎকুমার সাহার “ভাবনা অর্থনীতির বিশ্বায়ন, উন্নয়ন ও অন্যান্য'
মামুন হুসাইনের ‘কথা ইশারা’
পরিশেষে বলতে হচ্ছে এই বইয়ের দুই মলাটের মধ্যে লিপিবদ্ধ হয়েছে ইমতিয়ার শামীমের দৃষ্টিভঙ্গি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ভালো বই পড়িবার সময় মনে থাকে না বই পড়িতেছি। আমিও তেমন বই নয় যেন কিছুক্ষণ আড্ডা চলল ইমতিয়ারের সাথে।
পাঠ-প্রান্তরে
ইমতিয়ার শামীম
কথাপ্রকাশ, ২০২৩