পৃথিবীর বুকে আমাদের সময় কম। সেই কম সময়ে আমাদের অনেক কিছু করতে হয়। তার মধ্যে বর্ণমালা চিনে, অক্ষরকে মস্তিষ্কে স্থান দিয়ে, শব্দ সাজিয়ে ভাষাকে কব্জা করতে হয়। সেই ভাষা দিয়েই আমাদের সমস্ত সৃষ্টি। অন্য অনেক কিছুর মতই সাহিত্যও আমাদের বিবর্তনের ফল। ত্রিশ হাজার বছর আগে, প্যালিওলিথিক গুহায় যে মানুষ পশু শিকারের চিত্রকর্ম এঁকেছিল নিজের অজান্তেই সে প্রথম সাহিত্য সৃষ্টি করেছিল। তার গোষ্ঠীর মানুষেরা নিশ্চয় সেই শিল্পকর্ম দেখে লিটিল ম্যাগাজিনে লেখেনি যে, “আমাদের চিত্রকর হরিণের শিংটা বড় বাঁকা করে এঁকেছে,” কিন্তু তারা বুঝে নিয়েছে তাদের মধ্যে কোন শিল্পীর মান কত উন্নত। এই যে সহজাত বোধ তা শিল্পকলার প্রথম পরীক্ষা। এর মধ্যে শ্রেণীসংগ্রাম নেই, ভাষার বিনির্মাণ নেই। এই কলা হচ্ছে ব্যক্তিমানুষের সঙ্গে প্রকৃতির বোঝাপড়ার ফসল। এই প্রাচীন চিত্রকলাকে তাই মহৎ বলা চলে। সেজন্য হয়তো আধুনিক সময়ের লেখকেরা তাদের রচনার পাশে, হাতের লেখার পাশে, তাদের চরিত্রদের রূপ দেবার জন্য তাদের চিত্র আঁকতেন। এডগার অ্যালেন পো তো ভাল আঁকিয়েই ছিলেন, সেরকমই প্রতিভা ছিল কিপলিং, বদলেয়ার, নাবোকভের। নাবোকভ কাফকার গ্রেগর সামসার কীটে পরিণত হবার ঘটনা তেলাপোকা বা গুবড়ে পোকার মতো কিছু একটা এঁকে বুঝতে চেয়েছিলেন। দস্তয়েভস্কি ‘অপরাধ ও শাস্তি’তে রাসকোলনিকভকে এঁকেছেন, জেমস জয়েস এঁকেছেন ইউলিসিসের লিওপল্ড ব্লুমের কার্টুন, রবীন্দ্রনাথ এঁকেছেন আত্মপ্রতিকৃতি মহাবিশ্বের মধ্যে জীবনদেবতার স্থান খুঁজতে, ফকনারের ঘটনাও তাই।
কাফকা তাঁর অঙ্কন সম্পর্কে বলেছিলেন, “আমার আঁকা মানুষের গঠনগুলোতে স্থানের অনুপাত নেই, তাদের নিজস্ব কোনো দিগন্ত নেই। যে প্রেক্ষাপট থেকে তাদের আমি আঁকতে চাইছি, ধরতে চাইছি, সেটা কাগজের বাইরে পেন্সিলের অধারালো অংশে আমার মধ্যে বিরাজমান।” হয়ত কাফকা লেখকের মস্তিষ্কে বিরাজমান চিন্তাকে ছাপার মাধ্যমে বিশ্বস্তভাবে প্রকাশ করার বিফলতার কথা বলতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে পাঠক যখন লেখাটি পড়েন তখন তিনি কি তাঁর মনে চরিত্রটিকে যথার্থভাবে কল্পনা করতে পারেন? পাঠকও কি গল্পটিকে আঁকতে পারেন না? সেই আঁকায় কি পাঠকের পাঠ-আনন্দের মাত্রা বাড়তে পারে? ধরুন হাসান আজিজুল হকের “আত্মজা ও একটি করবী গাছের” প্রথম প্যারার একটি লাইন – “ওদিকে বড় গঞ্জের রাস্তার মোড়ে রাহাত খানের কড়ির টিনের চাল হিম ঝকঝক করে।” হিম অর্থে শীতকাল, আর টিনের চালের রাতে ঝকঝক করার একটাই উপায় – চাঁদের আলো তার ওপর পড়ছে। তখন আমি ফিরে যাই প্রথম লাইনে – “এখন নির্দয় শীতকাল, ঠাণ্ডা নামছে হিম, চাঁদ ফুটে আছে নারকেল গাছের মাথায়।” এরপরে লেখক একটা শেয়ালের মুরগী চুরি করে পালানোর কাহিনি বর্ণনা করেন। তারপর আরো হিম নামে, তখনো ইনাম, ফেকু, সুহাসের আবির্ভাব হয়নি, কিন্তু প্রথম প্যারার চিত্রকল্প আমার মনে শঙ্কা জাগায়, মনে পড়ে ১৯৭১ সনে, এক প্রত্যন্ত গ্রামে, রাতের আঁধারে একটি পাকা দালানের ওপর ওঠে ডাকাতের আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করা। ডাকাত আসত প্রতি রাতে, টর্চের আলো ফেলত দেয়ালের বাইরের বনে, ঝকঝক করত গাছের পাতা সেই আলোয়, শেষ পর্যন্ত তাদের হাত থেকে আমরা রক্ষা পাইনি। আজিজুল হকের গল্পশেষে আমি নিজেকে সেই বয়স্ক লোকটিই ভাবি যে কিনা বসে আছে ভাঙা চেয়ারে – অপেক্ষা করছে তিন ডাকাতের, ইনাম, সুহাস, ফেকুর। এই গল্পটিতে লেখক রাতের গায়ের পথকে যেভাবে মূর্ত করেছেন এই তিনটি ছিঁচকে পকেটমারের চেহারার সেরকম বর্ণনা দেননি, শুধু বলেছেন ফেকুর বাঘের মতো চেহারা।
বাঘের মতো চেহারাটা যে কী সেটা আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও সৃজনশীলতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে নিতে হবে। টিনের চালে চাঁদের ঝলক, প্রতিফলন আপনি ও আমি ভিন্ন মানুষ হলেও মোটা দাগে একইভাবে কল্পনা করা যায়, কিন্তু বাঘের মতো চেহারা আপনি ও আমি যে খুবই পৃথকভাবে মানসপটে মূর্ত করব তা বলার অপেক্ষা রাখে না, আর এই বিমূর্ততাই গল্পকে করে তোলে পাঠযোগ্য।
বই পড়ার সময় আমরা আলাদা করে প্রতিটি শব্দ পড়ি না, বরং বাক্যগুলি যেন বইয়ের পাতা বা কম্প্যুটারের পর্দা থেকে স্বতঃউৎসারিত হয়ে আমাদের চোখের পর্দায় প্রবেশ করে, আমাদের মস্তিষ্ক খুব জটিল উপায়ে তার অর্থ উদ্ধার করে। সেই অর্থ-উদ্ধারের আমি আর পড়ার-আমির মধ্যে কোনো বিভেদ নেই, মস্তিষ্ক থেকে উদ্ভূত বিমুর্ত চেতনা নিজেকে পর্যবেক্ষণ করে না – পর্যবেক্ষণ, অর্থ-নির্ধারণ, পর্যবেক্ষক – এই তিনটি ক্রিয়া ও সত্তা একই আধারে মিশ্রিত। এই অর্থ-উদ্ধারের প্রক্রিয়ায় কি আমরা ঘটনার চিত্ররূপ দিই? আমি দিই, কিন্তু অনেক পাঠকই বলবেন তাঁদের চিত্ররূপের দরকার নেই, তাঁরা পাঠের বিমূর্ততায় ঘটনা বিবরণ বা লেখকের বোধটিকে আত্মস্থ করতে সক্ষম। রবীন্দ্রনাথের ‘স্ত্রীর পত্র’ পড়ছি, আপনি বলবেন মৃণাল শ্বশুরবাড়ির প্রতিকূলতা যেভাবে বর্ণনা করেছে তার জন্য চিত্ররূপের প্রয়োজন নেই। আমি বলব, নিশ্চয় আছে, বিন্দু নামে মেয়েটি যে দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে গেল তা আমি চিত্রিত করে ভালভাবে হৃদয়ঙ্গম করছি, কিন্তু কিছু জায়গায়, যেমন মৃণাল কোথায় বসে, কীভাবে চিঠিটা লিখছে সেখানে আমি আটকে গেছি। মৃণাল পুরী গেছেন বুঝলাম, কিন্তু আমার মানসপটে মৃণালের চতুর্দিকের আবহাওয়া সৃষ্টির প্রয়োজন। ১৯১০ সনে একা নারী পুরীতে কোথায় থাকতে পারে? পরিচিত জনের বাড়ি, মন্দিরের অতিথিশালায়? রবীন্দ্রনাথ তা লেখেন নি। আবার মৃণাল বা মৃণালিনী রূপসী ছিলেন, তা মৃণাল নিজেই লিখছেন, কিন্তু ঠিক কীরকম দেখতে ছিলেন তা আমাদের কল্পনা করে নিতে হবে (রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর নামও ছিল মৃণালিনী, ১৯০২ সনে ২৯ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন)।
পাঠক বলবেন, মৃণালের পত্রটি বিন্দু নামে মেয়েটির মৃত্যুতে মৃণালের কষ্টের ক্যাথারসিস, সেই ক্যাথারসিসের চিত্ররূপ নিশ্চয় দেয়া সম্ভব নয়। না, সেটা সম্ভব নয়, কিন্তু সেই বোধটির আত্মীকরণের জন্য মৃণালের মুখাবয়বটিকে আমার কল্পনা করে নিতে হবে, মৃণালের চোখ, চাহনি, চিবুক, কপোলের কম্পন। শুধুমাত্র তখনি আমার পাঠ পূর্ণাঙ্গ হবে। আপনি হয়ত এর সাথে একমত হবেন না, এই ব্যাপারে জন স্টাইনবেককে আপনি সঙ্গে পাবেন। স্টাইনবেক তাঁর Sweet Thursday উপন্যাসের পূর্বকথায় ম্যাক নামে এক চরিত্রকে দিয়ে বলাচ্ছেন – “বইয়ের মধ্যে আমি অনেক কথোপকথন পছন্দ করি, আর আমি পছন্দ করি না যখন কেউ আমাকে বলে যে লোকটা কথা বলছে সে কীরকম দেখতে। সে কীরকম দেখতে সেটা আমি বার করতে চাই সে কীভাবে কথা বলছে তার থেকে।”
কিন্তু ম্যাক শেষ পর্যন্ত কথক কীরকম দেখতে তা বার করতে চায়। শেষ পর্যন্ত ফেকুর বাঘের মতো চেহারা কীরকম হতে পারে তা আমরা কল্পনা করতে চাই।
আর্ট সমালোচক Peter Mendelsund তার What we see when we read বইয়ে লিখছেন, “আমি যদি আপনাকে বলি আনা কারেনিনাকে বর্ণনা করুন, আপনি হয়তো তাঁর সৌন্দর্যের কথা বলবেন। আপনি যদি খুব মনোযোগের সঙ্গে পড়েন তো হয়তো তাঁর ঘন ‘আঁখিপল্লবের’ কথা বলবেন, তাঁর ওজন, অথবা হয়তো তাঁর হাল্কা নরম গোঁফের (হ্যাঁ – এটি আছে সেখানে) কথা। ‘আনার কাঁধ, জমাট চুল আর আধো-নিমীলিত চোখ’-এর ওপর ম্যাথিউ আরনল্ড মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু আনা কারেনিনা কীরকম দেখতে ছিলেন? আপনি হয়তো অনুভব করছেন আপনি চরিত্রটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত (চমৎকার ভাবে বর্ণিত চরিত্র পড়ে মানুষ বলতে পছন্দ করে – এমন যেন আমি তাঁকে চিনি), কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আপনি সেই ব্যক্তিটিকে চিত্রিত করতে পারছেন। কিছুই নির্দিষ্ট নয়, কিছুই নিখুঁত নয়।”
পাঠকের জীবনে এমন ঘটনা বহুবার হয়েছে যখন কারোর সম্বন্ধে অনেকবার শুনেছেন, তার পর প্রথমবার দেখে ভেবেছেন, “আমি তাঁকে অন্যভাবে কল্পনা করেছিলাম।” মুকুল দত্তের কথায় কিশোর কুমার গেয়েছিলেন (লতা মঙ্গেশকর নাকি সুর দিয়েছেন) -
“.. তারে আমি চোখে দেখেনি
তার অনেক গল্প শুনেছি
গল্প শুনে তারে আমি অল্প অল্প ভালবেসেছি।”
দস্তয়েভস্কির ইডিয়ট পড়ে নাস্তাসিয়া ফিলিপভনাকে ভালবাসলাম, কিন্তু যতবার তাঁকে চলচ্চিত্রে দেখলাম তাঁকে যেন পছন্দ হলো না। পাঠকের পাঠের জগৎ একান্ত নিজস্ব, সেখানে শুধুমাত্রই তিনিই অভিনেতাদের নির্বাচন করবেন। তাই গল্পে বর্ণিত চরিত্ররাই শুধু প্রটাগনিস্ট নয়, পাঠকও প্রটাগনিস্ট, পাঠকও এই পড়ার প্রক্রিয়ায় জয়ী।