পড়তে শেখার গল্প
বর্ণমালা লিখন-পদ্ধতিতে মানুষ তার সমস্ত জটিলতায় মুখের ভাষা এবং অব্যক্ত চিন্তাভাবনা টুকে রাখতে পারে। এটি আমাদের অপ্রকাশিত সব মহৎ চিন্তা তৈরি ও প্রকাশে সক্ষম করে তোলে।
আমরা যখন কোনো বই পড়তে বসি কিংবা পত্রপত্রিকার পাতা উল্টাই, অথবা মোবাইলে কোনো মেসেজ পড়ি — কখনো কি আমরা ভেবেছি যে আমাদের পড়ার ক্ষমতা কতটা বিস্ময়কর? কেন, কোন ভাবে পৃষ্ঠার বা স্ক্রিনের উপরের ছোটো ছোটো সারিবদ্ধ লাইনগুলো বিস্ময়করভাবে শব্দ বা বাক্য তৈরি করে জীবন্ত হয়ে ওঠে? কিভাবে আমাদের মস্তিষ্ক এই সক্ষমতা অর্জন করল?
বই পড়া ও পড়ানোর ইচ্ছা থেকে আমাকে অনেক ধরনের বই পড়তে হয়ছে। সেসব বই থেকে নির্যাসিত কিছু তথ্য আজ এখানে লেখার চেষ্টা করছি। মানব ইতিহাস, বিবর্তন ও মনোবিজ্ঞানের আলোকে মানুষের প্রথম পড়তে শেখার মজার গল্প, কিভাবে পাঠাভ্যাস আমাদের মস্তিষ্কের পুনর্গঠনে কাজ করে, এবং কেন কিছু মানুষ পড়া শিখতে গিয়ে অসুবিধায় পড়ে?
মানুষ হিসাবে পাঠের সক্ষমতা আমাদের বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং মানুষ যখন লিখতে শুরু করেছিল তখন আমাদের মস্তিষ্ক পাঠ-সক্ষমতা অর্জনের জন্য নিজেকে নতুন ভাবে তৈরি করে তোলা শুরু করে। মানুষের পঠনপাঠনের ইতিহাস অনেক প্রাচীন এবং জটিল। তবে এটুকু নিশ্চিত যে আমাদের মস্তিষ্ক তখনই পড়তে শিখেছে যখন আমরা লিখতে শিখেছি।
অবশ্য মানুষ প্রথম কবে লিখতে শুরু করেছে সেটা ইতিহাসে সুনির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে বোঝা যায় যে কোনো নির্দিষ্ট ভাষার শব্দ বিভিন্ন বর্ণ দিয়ে লিখে প্রকাশ করার জন্য বর্ণমালা আবিষ্কারের বহু আগেই মানুষ চিহ্ন এঁকে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ধারণ করত।
প্রাচীন উদাহরণগুলির অন্যতম একটি দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লম্বোস গুহায় পাওয়া যায়। সেখানে নৃতাত্ত্বিকরা কতগুলো ক্রসটানা দাগ খোদিত পাথর আবিষ্কার করেন যা মনে করা হয় আশি হাজার বছর পুরাতন। এক্ষেত্রে খোদিত দাগের অর্থ উদ্ধার করা না গেলেও মানব সভ্যতার শুরুর দিকে অর্থনৈতিক বিনিময় টুকে রাখার জন্য অনুরূপ চিহ্ন-খোদিত পাথর, মাটির দলা, শামুক প্রভৃতি ব্যবহার করত। তাই এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, ব্লম্বোস গুহায় আবিষ্কৃত পাথরের গায়ের দাগগুলো উদ্দেশ্যহীনভাবে আঁচড়ানো নয়, এর অর্থ আছে।
বিমূর্ত প্রতীক ব্যবহার করে কোনো বিষয়কে উপস্থাপন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ধারণ করে রাখার এই বুদ্ধিমত্তা ছিল মানব সভ্যতার বৈপ্লবিক আবিষ্কার। এতটাই বৈপ্লবিক যে এর ফলে আমাদের মস্তিষ্কের বড়ো ধরনের পরিবর্তন আসে।
আমাদের মস্তিষ্ক কোটি কোটি স্নায়ু কোষ ও নিউরন দিয়ে গঠিত। আমরা সেগুলো কিভাবে ব্যবহার করি তার উপর ভিত্তি করে এই নিউরনের রয়েছে নিজেদের পুনর্বিন্যাস ও নতুন সক্ষমতা তৈরির বিস্ময়কর ক্ষমতা। বিজ্ঞানীরা এই অনন্যসাধারণ ক্ষমতার নাম দিয়েছেন ‘neural plasticity’।
যখন মানুষ প্রথম পড়তে শিখল তখন তাদের মস্তিষ্কের নতুন ধরনের স্নায়বিক পথ তৈরি হলো যা তাদের দ্রুত গতিতে জটিল সব প্রতীক সনাক্ত এবং অর্থ উদ্ধারে সাহায্য করল।
একবার ভাবুন ছোটবেলায় পড়া শেখার বিষয়টি, তাহলে আপনি সেই রূপান্তরের কাজটি কতটা শক্তিশালী হতে পারে তা অনুধাবন করে বিস্মিত হবেন। মুদ্রিত এই অদ্ভুত চিহ্নগুলি পাঠের দক্ষতা এতটাই স্বতস্ফূর্ত হয়ে উঠে যে সামনের শব্দগুলি পড়তে হয় না, মস্তিস্ক এমনি বুঝে ফেলে।
স্নায়ুবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, আমরা যখন অক্ষরের মতো অপরিচিত চিত্রের দিকে তাকাই, তখন আমরা কেবল আমাদের মস্তিষ্কের পিছনে অবস্থিত ভিজুয়াল অঞ্চলের একটি সামান্য অংশ সক্রিয় করি। তবে আমরা যখন আমাদের পরিচিত বর্ণগুলো দেখি, তখন আমাদের মস্তিষ্কের সক্রিয়তা প্রায় তিনগুণ বেড়ে যায়। এটি কেবলমাত্র আমাদের চাক্ষুষ ক্ষেত্রগুলিকেই সক্রিয় করে তোলে না, মস্তিষ্কের যে অংশ ভাষাশিক্ষা, শ্রবণশক্তি এবং বিমূর্ত ধারণার জন্য বিশেষভাবে নিয়িজিত সেই অংশকে আরো কার্যকরী করে তোলে।
আমাদের পূর্বপুরুষরা পড়তে শেখার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মস্তিষ্কে প্রথম তৈরি হওয়া অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নতুন সংযোগটি হল মস্তিষ্কের পেছনের অংশ — angular gyrus — যেটি মানুষের যোগাযোগের কাজে এবং মস্তিষ্কের যে অঞ্চলগুলো বস্তুর পরিচিতি নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয় তাদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরিতে নিয়োজিত। এই নিউরোনাল ব্রেকথ্রুটি প্রথম দিককার কয়েকটি জটিল লিখন-পদ্ধতির ভিত্তি।
প্রথম বর্ণমালা আবিষ্কার
আমরা জানি যে বিশ্বের মানব ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন অঞ্চলে লেখার কৌশল উদ্ভাবিত হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুটি লিখন-ব্যবস্থা হলো সুমেরীয় কিউনিফর্ম — কীলক বা ছোট্ট তীরের মতো সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে লিখন-পদ্ধতি যা দেখতে অনেকটা পাখির পায়ের ছাপের মতো দেখায় — এবং মিশরীয় চিত্রলিখন-পদ্ধতি বা হায়ারোগ্লিফ। এ’দুটি লিখন-পদ্ধতি ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বে মেসোপটেমিয়া (বর্তমানের ইরাক) এবং প্রাচীন মিশরে একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে উদ্ভাবিত হয়েছিল।
উভয় পদ্ধতি প্রশাসনিক এবং হিসাবের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হত। শুরুতে সেগুলো ছিল চিত্রানুকৃতি অর্থাৎ প্রতীকগুলি প্রায়শই তাদের উপস্থাপিত জিনিসের অনুরূপ হতো। যেমন ‘বাড়ি’ মিশরীয় হায়ারোগ্লিফ অক্ষরটি উপর থেকে প্রাচীন মিশরীয় বাড়ির মতো আঁকা হতো — যেন দেবতারা সেটি দেখতে পান। এই চিত্রগুলি দ্রুত বোঝার জন্য আমাদের মস্তিষ্ককে ভিজ্যুয়াল ও ভিজ্যুয়াল সংক্রান্ত অঞ্চলগুলি — অর্থাৎ ভাষা প্রক্রিয়াকরণের সাথে জড়িত অঞ্চলের সঙ্গে উচ্চতর চিন্তায় নিয়োজিত সম্মুখ লোবের (frontal lobes) নতুন যোগাযোগ তৈরি করতে হয়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই দুটি লিখন-পদ্ধতি আরও জটিল এবং বিমূর্ত হয়ে ওঠে। মিশরীয় সভ্যতার শেষ দিকে হায়ারোগ্লিফের সংখ্যা দ্রুত প্রায় ৭০০ থেকে বেড়ে কয়েক হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এখনো কিছু হায়ারোগ্লিফ একই সঙ্গে শব্দ এবং সেই শব্দের প্রথম সিলেবলের প্রতিনিধিত্ব করে। এই জটিলতার কারণে এই প্রাচীন লিপিগুলি আয়ত্তে আনতে বেশ কয়েক বছর সময় লেগেছিল —যতদিন না প্রাচীন গ্রীকরা আবিষ্কার করতে পারলেন যে লেখালেখির প্রক্রিয়াটা আসলে এ-বি-সি’র মতো সহজ।
৭৫০ খ্রিস্টপূর্বের দিকে প্রাচীন গ্রীকরা আবিষ্কার করেছিল যে তাদের ভাষা সীমিত সংখ্যক শব্দে বিভক্ত হতে পারে এবং প্রতিটি শব্দ একটি অক্ষর দ্বারা প্রকাশ করা যেতে পারে। তারা সম্ভবত ফিনিশীয়দের ব্যঞ্জনবর্ণ-ভিত্তিক লিপি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল, তবে তারা এক্ষেত্রে আরও একধাপ এগিয়ে গেছে। গ্রীক বর্ণমালা-পদ্ধতিটি ছিল প্রথম লিখন-পদ্ধতি যা শব্দ বা অক্ষরের প্রতিনিধিত্বকারী চিহ্নগুলিকে মিশিয়ে না ফেলেই সংক্ষিপ্ত সংখ্যক বর্ণ থেকে শব্দ সাযুজ্যের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করেছিল। এর ফলে গ্রীকরা সহজেই মুখের ভাষার সব ধরনের রূপ লিপিবদ্ধ করতে পেরেছিল।
এই পদ্ধতির অনেক সুবিধা ছিল। প্রথমত বর্ণমালার সংখ্যা ছিল কম, অধিকাংশ মানুষ তাদের ভাষায় ব্যবহৃত সকল শব্দ ২৬টির চেয়ে কম সংখ্যক বর্ণমালা ব্যবহার করে প্রকাশ করতে পারত। এর ফলে আমাদের মস্তিষ্কের শক্তি এবং প্রচেষ্টার কষ্ট কমে আসে। সঙ্গে এই ব্যবস্থা আরো একটি সুবিধা বয়ে আনে — বর্ণমালা ব্যবহার করে লিখন-পদ্ধতি অনেক বেশি সহজ এবং বিভিন্ন ধরনের শতশত অথবা হাজার হাজার চিহ্ন ব্যবহার করে লিপিপদ্ধতির চেয়ে অনেক দ্রুত শেখা যায়।
সবচেয়ে সুবিধার কথা হলো, বর্ণমালা লিখন-পদ্ধতিতে মানুষ তার সমস্ত জটিলতায় মুখের ভাষা এবং অব্যক্ত চিন্তাভাবনা টুকে রাখতে পারে। এটি আমাদের অপ্রকাশিত সব মহৎ চিন্তা তৈরি ও প্রকাশে সক্ষম করে তোলে।
যে কারণে গ্রীকরা এই সময়ে — ৭০০ থেকে ৬০০ খ্রীষ্টপূর্বে — শিল্প, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান এবং রাজনীতিতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন করতে পেরেছে। এই বর্ণমালা লিখন-পদ্ধতিকে আমার লাল-সালাম (ধন্যবাদ)। আমরা আজও সেই গৌরবগাথা পড়তে পারছি।
শিশুদের পঠনপাঠন
অধিকাংশ পাঠ-বিশেষজ্ঞরা যদি কোনো একটি বিষয়ে একমত হন তা হল — শিশুদের কাছে পড়ার ক্ষেত্রে সঠিক সময় বলে কিছু নেই। কোনো শব্দ বোঝার অনেক আগেই শিশুদের মস্তিষ্ক সেটা পড়ার মতো দুরূহ কাজের জন্য প্রস্তুত নিজেকে করে তুলতে শুরু করে। মাত্র ৬ মাস বয়সেই অক্ষরের মতো ছোট ছোট চিহ্নগুলি সনাক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় ভিজ্যুয়াল সিস্টেম শিশুদের পুরোপুরি সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৮ মাস বয়সেই শিশুরা বুঝতে পারে যে তাদের চারপাশের প্রত্যেকটি জিনিসের নিজস্ব নাম রয়েছে।
পরবর্তী বছরগুলোতে শিশুদের উপলব্ধি, মনোযোগ এবং ধারণাগত ব্যবস্থাগুলো অবিশ্বাস্য গতিতে বিকশিত হয়। এ কারণে এই সময়ে বাচ্চাদের পড়ে শোনানো তাদের মস্তিষ্কে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। যখন ছোট বাচ্চাদের পড়ে শোনানো হয় তখন তাদের নিজস্ব ভাষাগত কাঠামোটি আরও পরিশীলিত হয়ে ওঠে।
এর প্রভাব অসংখ্য গবেষণায় তুলে ধরা হয়েছে। তার মধ্যে একটি গবেষণায় পঠনবিষয়ক গবেষক ভিক্টোরিয়া পারসেল-গেটস পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন যাদের দু'বছর ধরে সপ্তাহে কমপক্ষে পাঁচবার বই পড়ে শোনানো হয়েছিল, এবং তাদের তুলনা করেছেন এমন শিশুদের সাথে যাদের বেশি বই পড়ে শোনানো হয়নি। যখন তাদের ৫ম জন্মদিনে তাদের কাছে এই পাঠ অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাওয়া হয় তখন যে সকল শিশুকে প্রায়ই পড়ে শোনানো হয়েছে তারা দীর্ঘ বাক্যাংশ, তুলনামূলক জটিল বাক্য এবং বিশেষত ‘সাহিত্যিক’ পরিভাষা যেমন, ‘একদা কোনো এক সময়ে’ ব্যবহার করে কথা বলে। দুর্ভাগ্যক্রমে, বিপরীত প্রভাবটিও লক্ষণীয়। যে সব শিশু ভাষাগত বিবেচনায় পিছিয়ে থাকা পরিবার থেকে আসে, এবং যাদের খুব কম বই পড়ে শোনানো হয়েছিল, তারা কখনও কখনও তাদের সমবয়সীদের চেয়ে ৩ কোটি ২০ লক্ষ কম শব্দ জেনেছে। ফলে, তাদের শব্দভাণ্ডার খুবই সীমিত এবং পড়তে শেখায় তাদের অনেক কষ্ট করতে হয়।
তাছাড়া শিশুরা খুব ছোট থাকতেই বইয়ের পৃষ্ঠায় মুদ্রিত বিভিন্ন ডিজাইন বা ছবির সঙ্গের লেখা এবং গল্পের সঙ্গে মিলিয়ে শিখলে পরবর্তী সময়ে পড়া শেখার কাজটি তাদের জন্য সহজ হয়ে ওঠে। প্রথমত শিশুরা আবিষ্কার করে যে একটি শব্দের সঙ্গে একটি চিহ্নের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। এরপর তারা বুঝে নেয়, প্রতিটা বর্ণের একটা নাম আছে, উদাহরণস্বরূপ ‘ম’ বর্ণটি, এবং যে শব্দকে তা উপস্থাপন করে, যেমন ‘মা’! যেসব শিশুকে প্রায়ই পড়িয়ে শোনানো হয়, আনুষ্ঠানিক পাঠশিক্ষার অনেক আগেই তাদের মস্তিষ্কে ভিজ্যুয়াল অঞ্চলের সঙ্গে ভাষাগত অঞ্চলের সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করে। শুধু তাই নয়। একটি ছোট বাচ্চাকে ড্রাগন, ধনুক এবং রাজকুমারের গল্প পড়ে শোনানোর ফলে সে অন্য ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বকে দেখতে এবং অন্যের অনুভূতিগুলি বুঝতে শেখে। অন্যভাবে বলা যায় যে বই তাদের সংবেদনশীল হতে শেখায়। তাই আমার অনুরোধ অনেক ছোট বয়স থেকেই আপনার সন্তানকে পড়ে শোনান।
পড়তে শেখার শেষ নেই
পাঠক্ষমতা এবং বিশ্ব সম্পর্কে বাস্তব জীবনের জ্ঞান বাড়ার সাথে সাথে শিশুরা তাদের পঠনপাঠন থেকে টেক্সটের আরও অনেক সম্ভাবনা উন্মোচন করে। মস্তিষ্কের বাঁ পাশের অক্ষর-ডিকোডিং পথগুলি আরও কার্যকর হয়ে উঠলে, লিম্বিক সিস্টেম — আমাদের মস্তিষ্কের আবেগ সঞ্চালনের জন্য নিবেদিত অঞ্চলটি — পাঠ-প্রক্রিয়াতে আরো বেশি জড়িয়ে পড়ে। এইভাবে নবীন পাঠকরা উপহাস, রূপক এবং নানারকম দৃষ্টিকোণ সম্পর্কে বুঝতে শেখে; তারা যা পড়ছে সেটা তাদের নিজস্ব গল্প ও চারপাশের বিশ্বের সাথে মিলিয়ে পাঠ করতে পারে। এই ধরনের পরিণত পাঠক একটি শব্দ পড়তে আধ সেকেন্ডেরও কম সময় নেয়। এবং এই ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যেই অনেক কিছু ঘটে যায়। প্রথম ১০০ মিলিসেকেন্ডে আমাদের মস্তিষ্ক পঠিত শব্দের প্রতি সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে অন্যান্য জ্ঞানীয় ক্রিয়াকলাপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ভিজ্যুয়াল সিস্টেমটি পঠিত অক্ষরগুলি গ্রহণ করে এবং সংশ্লিষ্ট তথ্য বিশেষায়িত নিউরোনাল পথগুলি থেকে রিডিং মেমরির অন্যান্য অংশগুলিতে প্রেরণ করে। আমাদের সক্রিয় স্মৃতি আমাদের মস্তিষ্কে যতক্ষণ প্রয়োজন ততক্ষণ ভিজ্যুয়াল তথ্য ধারণ করে, ততক্ষণে আমাদের অ্যাসোসিয়েশন মেমোরি চাক্ষুষ চিহ্নগুলির সম্পর্কে যা কিছু জানে তা পুনরুদ্ধার করে। পরবর্তী ১০০ মিলিসেকেন্ডে আমাদের মস্তিষ্ক অক্ষরগুলিকে তারা যে ধ্বনির প্রতিনিধিত্ব করে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরিতে এবং তাদের একত্রিত করে একটি অর্থবহ শব্দ গঠনে ব্যস্ত থাকে। এবং সবশেষে পরবর্তী ৩০০ মিলিসেকেন্ডে আমাদের মস্তিষ্ক ঐ শব্দ সম্পর্কে যা কিছু জানে সেগুলি পুনরুদ্ধার করে ঐ প্রেক্ষাপটে এটির অর্থ, সঙ্গে এর অন্যান্য সম্ভাব্য অর্থ এবং শব্দটি সম্পর্কে আমাদের আর যা যা জ্ঞান থাকতে পারে সেটি তৈরি জোগাড় করে। আমরা যত বেশি পড়ি, তত দ্রুত ডিকোডিং সম্পন্ন করতে পারে, এবং পাঠ-প্রক্রিয়ার শেষ পর্যায়ে আমাদের একটু বেশি সময় দিতে হয় — শব্দটি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করায়। আমাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা যে বই পড়ি তার সঙ্গে সম্পূরক জ্ঞান এবং জীবনের অভিজ্ঞতা যোগ করতে পারি। তাই পঠনপাঠনের প্রশ্নে আমাদের শেখার কোনো শেষ নেই।
পাঠ-বিকলত্ব (ডিসলেক্সিয়া)
লেওনার্দো দা ভিঞ্চি, টমাস এডিসন এবং অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের মধ্যে মিল কী? তাঁরা সকলেই পাঠ-ব্যাধিতে (ডিসলেক্সিক) ভুগেছিলেন। ‘শব্দ-অন্ধত্ব’ হিসাবে পরিচিত এই অদ্ভুত সমস্যাটি ১৮৭০ সালে প্রথম সনাক্ত করেন জার্মান গবেষক অ্যাডলফ কসমল, পরে বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেতে কিছুটা সময় লেগে যায়। এটির দেরিতে আবিষ্কার এবং এর এখনও সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত কোনো সংজ্ঞা না থাকার কারণ পাঠ-ব্যাধি (ডিসলেক্সিয়া) অনেক ধরনের হয়ে থাকে। ইংরেজি ভাষায় পাওয়া তিনটি প্রচলিত সাব টাইপ হলো: অক্ষর এবং শব্দ মেলানোর সমস্যা, পাঠের সাবলীলতা নিয়ে সমস্যা এবং উল্লিখিত দুটি সমস্যা একসঙ্গে থাকা। তবুও, পড়ার অসুবিধা আছে এমন প্রায় ১০শতাংশ মানুষকে এই শ্রেণির যে কোনও একটিতে নিশ্চিতভাবে ফেলা যায় না।
একইভাবে, গত একশ বছরের গবেষণার দিকে তাকালে দেখা যায়, মস্তিষ্কে ডিসলেক্সিয়ার বিভিন্ন সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।
প্রথমটি হল পঠনপাঠনের সাথে জড়িত মস্তিষ্কের মৌলিক কাঠামোতে এক ধরনের ত্রুটি — উদাহরণস্বরূপ দৃষ্টি এবং শ্রুতি ব্যবস্থা। মিঃ এক্স নামক ফরাসি ব্যবসায়ীকে স্টাডি করার পরে কসমল এই তত্ত্বটি প্রস্তাব করেছিলেন। দুটি স্ট্রোকের কারণে — প্রথম স্ট্রোকে তার ভিজ্যুয়াল সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দ্বিতীয় স্ট্রোকে মস্তিষ্কের যে অংশটি ভিজ্যুয়াল সিস্টেম থেকে ভাষা অঞ্চলে তথ্য সরবরাহ করে সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয় — এরপর মিঃ এক্স পড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।
ডিসলেক্সিয়ার দ্বিতীয় সম্ভাব্য কারণ পড়ার জন্য মস্তিষ্কের প্রয়োজনীয় প্রসেসিং গতি অর্জনের অক্ষমতা। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য তাদের দৃষ্টি, শ্রুতি ও মোটর সিস্টেমের মধ্যে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে ‘সময়ের ব্যবধান’ তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ, ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা ভিন্নভিন্ন রঙ এবং তার সঙ্গে মিলিয়ে বস্তুর নামকরণের কাজটি অনেক ধীর গতিতে করে থাকেন। এই যোগাযোগের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার অন্যতম একটি কারণ হতে পারে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে যথাযথ সংযোগের অভাব। উনবিংশ শতকে স্নায়ুবিশারদ কার্ল ওয়ার্নিকে ডিসলেক্সিয়াকে একটি বিচ্ছিন্নতা সিনড্রোম হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন যা ভিজ্যুয়াল-ভার্বাল বা ভিজ্যুয়াল-অডিটরি সিস্টেমের সমন্বয়কে বিঘ্নিত করে। এই সম্ভাব্য ত্রুটি বলতে বোঝায় যে, ডিসলেক্সিয়া আক্রান্ত মস্তিষ্ককে পঠনপাঠনের বিভিন্ন উপায় বের করতে হয়। আধুনিক ব্রেন ইমেজিং দ্বারা বোঝা যায় যে ডিসলেক্সিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিরা পড়ার জন্য স্বাভাবিক ব্যক্তিদের চেয়ে মস্তিষ্কের আলাদা সার্কিট্রি ব্যবহার করেন বলে মনে হয়।
ডিসলেক্সিয়া আসলে কোনও ‘পাঠ-ব্যাধি’ নয়। কারণ প্রকৃতপক্ষে মানুষের মস্তিষ্কের কখনোই পড়ার কথা ছিল না। ডিসলেক্সিয়ার আলাদা প্রবাহ মানুষের অন্যান্য দক্ষতাকে প্রভাবিত করে। শুধুমাত্র দা ভিঞ্চি, এডিসন এবং আইনস্টাইনই ইতিহাসে ডিসলেক্সিক প্রতিভা ছিলেন না। স্পেনীয় স্থপতি অ্যান্তোনি গাওদি-ও রয়েছেন যিনি বারসেলনায় তাঁর ডিজাইনকৃত পরাবাস্তব, রঙিন ভবনগুলোর জন্য বিখ্যাত। আরো অনেকের মধ্য থেকে বলা যায় পপ চিত্রশিল্পী অ্যান্ডি ওয়ারহল, অভিনেতা জনি ডেপ এবং বিনিয়োগ ব্যবসায়ী চার্লস শোয়াবের নাম।
১৯৬০ এবং ৭০-এর দশকে অগ্রগণ্য স্নায়ুবিশারদ নরম্যান জেশউইন্ড আবিষ্কার করেছেন যে, ডিসলেক্সিয়া প্রায়শই অস্বাভাবিক কথাবার্তা এবং স্নায়ুর মোটর প্যাটার্নের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এর কারণ হলো ডিসলেক্সিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাদের মস্তিষ্কের দুটি গোলার্ধকে আরও সুষমভাবে ব্যবহার করে। বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে তথাকথিত প্লানাম টেম্পোরাল—ভাষা প্রক্রিয়াজাতকরণের সাথে জড়িত মস্তিষ্কের একটি অঞ্চল — ডানদিকের চেয়ে বাম গোলার্ধে বড়। তবে ডিসলেক্সিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্ল্যানাম টেম্পোরাল উভয় গোলার্ধে একই আকারের। ডিসলেক্সিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিরা অন্যান্য বিভিন্ন কাজে ডান ব্রেইন সার্কিটকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।
ডান-মস্তিষ্কের এই আধিপত্য ডিসলেক্সিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের বৃহত্তর ভিজ্যুয়াল প্যাটার্ন স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিভা আছে বলে মনে করা হয়। তার নিজের নৈমিত্তিক পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি বুঝতে পারেন যে, ডিসলেক্সিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিরা ডিজাইন, রেডিওলজি বা উচ্চ ফিনান্সের মতো ক্ষেত্রগুলির দিকে ঝুঁকছেন, যেখানে বৃহত্তর প্যাটার্নগুলো চিহ্নিত এবং ব্যাখ্যা করার দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও ডিসলেক্সিয়া আজ একটি স্বীকৃত অবস্থা, আমরা এখনও ডিসলেক্সিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের অন্যান্য দক্ষতা বিকাশের জন্য সঠিক সহযোগিতা নিশ্চিত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছি না। ডিসলেক্সিয়া আক্রান্ত শিশুদের এখনও সেটা নির্ণয় করতে দেরি হয়ে যায়, বা কখনো নির্ণয় করা হয় না; তাদের সঙ্গী এবং শিক্ষকরা তাদের পিছিয়ে রাখে। ফলে সমাজ কিছু আশ্চর্য প্রতিভা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ কারণেই কোনো শিশুর পঠনপাঠনের সুপ্ত সমস্যাকে গুরুত্ব দেওয়া এবং সেটা দ্রুত কাটিয়ে ওঠায় তাৎক্ষণিক ও নিবিড় হস্তক্ষেপ নিশ্চিত করা প্রত্যেক পিতা-মাতা এবং শিক্ষকদের দায়িত্ব। প্রাচীন গ্রীকরা যখন প্রথম লেখা শুরু করেছিল, তখন সবাই তাতে খুশি ছিল না। প্রাচীন গ্রীসে বসবাসকারী বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিসের সময় লেখালেখি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তিনি এই নতুন প্রযুক্তিটিকে একেবারে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে, লেখালেখির বিষয়টি মানবচিন্তাকে আরও জটিল করে তুলবে, আমাদের স্মৃতিশক্তিকে দূষিত করবে এবং সমস্ত লিখিত তথ্যকে সত্য মনে করে মানুষ বোকা বনে যাবে। মজার ব্যাপার হলো, সমালোচকেরা আজ ইন্টারনেট সম্পর্কে প্রায় সেই একইরকম সমালোচনা করে যাচ্ছেন।
এর ফলে আমাদের মনে এই প্রশ্নটি জাগে যে ডিজিটাল যুগে আমাদের পাঠ-মস্তিষ্কের কী হবে যখন আমাদের আঙুলের ডগায় প্রচুর পরিমাণে তথ্য রয়েছে এবং টেক্সট আগের চেয়ে আরও গতিশীল ও পরিবর্তনশীল? প্রযুক্তি কি আমাদের মস্তিষ্কের নতুন নতুন বৈশিষ্ট্যগুলি উন্মোচন করবে? নাকি উল্টো এটি কিছু কিছু দক্ষতা আমাদের ভুলিয়ে দেবে যা এটি তৈরিতে সহায়তা করেছিল? অতিরিক্ত আতঙ্কপ্রবণ হওয়ার কোনও কারণ নেই। শুধু মনে রাখবেন, সক্রেটিস লেখা নিয়ে কতটা সংশয়ী ছিলেন এবং আজ তাঁর উদ্বেগ কীভাবে হাস্যরসে পরিণত হয়েছে!
ইন্টারনেটের মাধ্যমে তৈরি হওয়া নয়া পঠনরীতি যে করেই হোক আসবেই। আমরা যেহেতু নতুন একটি যুগে চলে এসেছি, পড়তে শেখার মাধ্যমে আমরা — প্রজাতি এবং ব্যক্তি হিসাবে — কী অর্জন করেছি তা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়ার মধ্যে ক্ষতির কিছু নেই; বরঞ্চ সেই সম্পদগুলি ভবিষ্যতে আমাদের ধারণ করার চেষ্টা করা উচিত। লেখার ফলে আমরা আমাদের কথা এবং অব্যক্ত চিন্তা সংরক্ষণ করে রাখতে পারি এবং এটি সময় এবং স্থানকে অতিক্রম করে যায়। এর ফলে আমরা সম্পূর্ণ নতুন উপায়ে অন্যদের চিন্তাভাবনা এবং অভিজ্ঞতার কথা জানতে পারি।
আমাদের আগের দিনের পঠনপাঠনের জন্য সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ হল সময়, যা আমাদের ধরে রাখা উচিত। আমাদের ডিজিটাল যুগে এসে সময়কে খুব দুর্লভ সম্পদ বলে মনে হয়। কিন্তু সময়ই পার্থক্য করে দেয় কোনো টেক্সট হাল্কাভাবে পড়া এবং সেটাকে অতিক্রম করে আমাদের নিজস্ব ধারণা, অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানের সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত করার মধ্যে।
ডিসলেক্সিয়া দ্বারা আক্রান্ত হোক বা না-হোক, প্রতিটি শিশুকে পড়ার নানা দিক উন্মোচনের জন্য সঠিক নির্দেশনা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ও ব্যক্তিগত বিকাশের জন্য এর সমস্ত শক্তিশালী অভিব্যক্তি নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। পঠনপাঠন মানুষের সহজাত নয়। আমাদের প্রজাতিকে লেখার কৌশলগত বিকাশ ঘটাতে — আজকের পর্যায়ে সেটাকে আমরা যেভাবে পেয়েছি — অনেক বছর সময় লেগেছিল, এবং তা আত্মস্থ করতে আমাদের মস্তিষ্ককে বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এজন্য পড়তে শেখা এখনও শিশুদের জন্য দীর্ঘ এবং কখনও কখনও কঠিন প্রক্রিয়া — বিশেষত তারা যদি ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত হয়। তবে পঠনপাঠন আমাদের মস্তিষ্ক, চিন্তাভাবনা এবং আমাদের সংস্কৃতি পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে, তাই প্রত্যেক মানুষের এটি শেখার সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য আমাদের সাধ্যের মধ্যে যা কিছু আছে তা করা উচিত।
যা যা আমাকে পড়তে হয়েছে
A History of Reading, Alberto Manguel
Curiosity, Alberto Manguel
Reader, Come Home: The Reading Brain in a Digital World, Maryanne Wolf
How to Read Literature,Terry Eagleton
The Sixth Extinction: An Unnatural History, Elizabeth Kolbert
Overcoming Dyslexia: A New and Complete Science-Based Program for Reading Problems at Any Level, Sally E. Shaywitz
ABC of Reading, Ezra Pound
For the Love of Books: Stories of Literary Lives, Banned Books, Author Feuds, Extraordinary Characters, and More, Graham Tarrant
Wikipedia
রিটন খান
আলফারেটা, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র