দেশে স্কুল কলেজের সংখ্যা যতই বাড়ুক যদি লাইব্রেরির সংখ্যা না বাড়ে তাহলে সেদেশে মননশীল জনগোষ্ঠীর জন্ম হয় না। অপ্রিয় বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে জনসংখ্যার অনুপাতে কখনোই লাইব্রেরি ছিল না। বরং যে কয়টি ছিল তাও বিলুপ্তির পথে। লাইব্রেরির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে এই দেশের নীতি নির্ধারক থেকে সাধারণ মানুষ কারোরই মাথাব্যথা নেই। কারণ অনেকের ভ্রান্ত ধারণা লাইব্রেরিতে পাঠ্য বই তেমন থাকে না। যেগুলো থাকে সে বইগুলো পড়ে কোন সার্টিফিকেট অর্জন করা যায় না। সেগুলো নেহাত আউট বই। অনেকেই বোঝেন না যে পৃথিবীর সকল আউটবই হলো মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করার অন্যতম প্রধান উপাদান। সেই বিষয়ে আমাদের চরম উদাসীনতার ফসল মননশীলতার অপুষ্টিতে ভুগতে থাকা একটা বিশাল জনগোষ্ঠী।
মোটা দাগে বলতে গেলে লাইব্রেরি দু রকমের। একটা থেকে পয়সা দিয়ে বই কেনা যায়। অন্যটাতে বিনে পয়সায় বই পড়া যায়। পয়সা দিয়ে বই কেনা লাইব্রেরির সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটেছিল স্কুলে পড়ার সময়। ক্লাস ফাইভে কি সিক্সে বাবা আমাকে বইয়ের দোকান চিনিয়েছিল প্রথম। চট্টগ্রাম নিউমার্কেটের দোতলায় সিঁড়ির পাশেই এল শেপের বড়সড় একটা দোকান ছিল। সেই দোকানে কয়েকটা অনুজ্জ্বল টিউবলাইটের আলোয় কিছু বই কেমন একটা ঝিমধরা ঘ্রাণ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো কাঠের তাকগুলোতে। ছাদ পর্যন্ত বিস্তৃত সেই তাকগুলোর মাত্র তিন চার তাক আমার নাগালে। তার মধ্যেই আমার এডভেঞ্চারের রাজ্য। ওই দোকানটি আমার ভীষণ প্রিয় ছিল। যদি আমাকে নস্টালজিক স্মৃতির কোন প্রতিযোগিতা করতে বলা হয়, তাহলে আমি সেই দোকানটির কথাই বলবো সবার আগে। আমার ছেলেবেলার সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতিগুলো থির হয়ে আছে সেখানে। দোকানটার নাম ছিল বইঘর। বইঘর বাংলাদেশের একটি সমৃদ্ধ প্রকাশনা হিসেবেও সুপরিচিত ছিল সত্তর আশি দশকে।
সেই দোকানটিতে অদ্ভুত একটা নীরবতা কাজ করতো। যেরকম নীরবতা থাকে প্রাচীন উপাসনালায়গুলোতে, ঠিক সেরকম নীরব প্রাচীনগন্ধী এক নীরবতার আশ্রয় ছিল বইঘরে। আমি সেই নীরবতাকে ভালোবাসতাম। কৈশোরে বা তারুণ্যের সূচনায় যতবার নিউমার্কেটে গিয়েছি অবশ্যই বইঘরে একবার পা দিয়েছি। বই না কিনলেও বইয়ের ঘ্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছি। বইঘর থেকে কেনা প্রথম দুটো বই, আমার স্কুলের এক সহপাঠি পড়তে নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। আমার সেই প্রথম কোন বই হারানো। বন্ধুটি বই ফেরত দিচ্ছে দেবে করতে করতে একসময় স্কুলই ছেড়ে চলে যায়। আমি শোকটা ভুলতে পারিনি বহুকাল। তারো প্রায় দুই যুগ পর একদিন সেই বন্ধুটির সাথে রাস্তায় দেখা। দুজনে হাত মিলিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করতে করতে আমার মনে পড়ে গেল সেই বই দুটোর কথা। ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করি, বইদুটো এখনো আছে কিনা। কিন্তু জিজ্ঞেস করা হলো না। এখন আমার হাজার বইয়ের মেলা, তবু শৈশবের সেই বই দুটোর শোক ভুলতে পারি না।
সত্যিকার অর্থে বই কেনার নেশায় পেয়ে বসেছিল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে। কিন্তু সেই সময়টা ছিল কঠিন। সামর্থ্য ছিল না নতুন বই কেনার। বই কেনা প্রায় বিলাসিতা তখন। তাই খুঁজে খুঁজে পুরোনো এডিশানের বই কিনতাম সস্তায়। বইয়ের এই ব্যাপারটা খুব ভালো লাগতো। বর্তমানমূল্য বলে কিছু ছিল না। যে দামে প্রকাশিত, সেই দামেই বইটা কেনা যেতো। মনে আছে ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত ৫ টাকা দামের বই একই দামে কিনেছিলাম কারেণ্ট বুক সেন্টার থেকে ১৯৮৮ সালে।
'বইঘর' ছাড়াও তখন যাওয়া শুরু করেছি নিউমার্কেটের আশেপাশের আরো কয়েকটা দোকানে। কারেণ্ট বুক সেন্টার তাদের অন্যতম। ‘নিউজফ্রন্ট’ নামের একটা দোকান ছিল একতলায়। বিজ্ঞানের বইসহ বিদেশ থেকে প্রকাশিত বইপত্র পত্রিকা পাওয়া যেত। রিডার্স ডাইজেস্টের দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকতাম কিন্তু উচ্চমূল্যের জন্য কিনতে পারতাম না। ভাবতাম যদি কোনদিন বড়লোক হই তবে অবশ্যই রিডার্স ডাইজেস্ট পত্রিকাটির প্রত্যেকটা সংখ্যা কিনে ফেলবো। 'নিউজফ্রন্ট’' বাদে আরো দুটি দোকান 'মনীষা', আর 'উজালা'য় মাঝে মধ্যে উঁকি দিতাম। 'কারেন্ট বুক সেন্টার' ছিল নিউমার্কেটের রাস্তার উল্টোদিকে জলসা সিনেমার নিচে। আন্দরকিল্লা মূলত পাঠ্যবইয়ের আড়ত, তবু ওখানেও কয়েকটা ভালো দোকান খুঁজে পেয়েছিলাম। 'কথাকলি' ছিল অন্যতম। ছোট্ট দোকানটিতে মজার সব বই। কালজয়ী উপন্যাস থেকে গুরুগম্ভীর তত্ত্বের বই সবকিছু ছিল। তারপর খোঁজ পাই 'বুক সিন্ডিকেট' নামে প্রাচীন একটা দোকান। জামে মসজিদের উল্টোদিকে দোতলায়। সেখানেও বিরল কিছু বই পাওয়া যায়।
সেই সময় বইপড়ার তৃষ্ণা এত বেশি ছিল যে চাইলে প্রতিদিন মাঝারি সাইজের দুটো বই গিলে ফেলতে পারতাম। কিন্তু সময়টা এমন ছিল দুই মাসে একটা বই কেনার সামর্থ্যও হতো না। বই পড়ার সাধ ও সাধ্যের মধ্যেকার এই ব্যবধান ঘোচানোর কাজটা করেছিল পাবলিক লাইব্রেরি। আসলে কারো পক্ষেই পছন্দের সব বই কিনে ফেলা সম্ভব নয়। টাকা থাকলেও বাসায় অত বই রাখার জায়গা হবে না। তাই পাবলিক লাইব্রেরির দরকার হয় প্রতিটি নগরে শহরে পাড়া মহল্লায়। আমাদের পাড়া মহল্লায় কোন লাইব্রেরি ছিল না। শহরে কয়েকটি পাবলিক লাইব্রেরি ছিল সেগুলোই ভরসা। তার বাইরে স্কুল কলেজের লাইব্রেরিগুলো হতে পারে পাঠকের আশ্রয়।
আমার প্রথম লাইব্রেরি অভিজ্ঞতা হয়েছিল হাইস্কুলে ওঠার পর। দৃশ্যটা এখনো আমার চোখে ভাসছে। যেদিন আগ্রাবাদ সরকারী কলোনী স্কুলের দক্ষিণ কোনার ছোট্ট লাইব্রেরি ঘরটা খুলে দেওয়া হলো। সেদিন আমার জগতে নতুন একটা পৃথিবী যুক্ত হলো। তখন আমি ক্লাস সেভেনে উঠেছি। লাইব্রেরি কার্ডে প্রথম যে বইটির নাম লিখলাম সেটা এখনো মনে আছে। একটা ক্লাসিক বই ছিল। নাম 'থ্রি মাস্কেটিয়ার্স'। কার্ডে নাম লিখে যত্নের সাথে বইটা যখন হাতে নেই, সেই অনুভুতির স্মৃতিচারণ এখনো রোমাঞ্চ জাগায়। তালাবদ্ধ বইয়ের আলমারি থেকে বের করা একেকটা বই যখন হাতে আসতো মনে হতো একেকটা এডভেঞ্চার অভিজ্ঞতায় ঢুকে পড়ছি। যে কোন স্কুলে একটা লাইব্রেরি থাকা কত জরুরি সেটা আমি মর্মে মর্মে অনুভব করি।
একটা সময় আমার প্রিয় জায়গা ছিল চট্টগ্রামের পাবলিক লাইব্রেরি। আশি নব্বই দশকের ছাত্রজীবনের অনেকগুলো দুপুর কেটেছে লাইব্রেরিতে। শুনে মনে হতে পারে খুব ভালো ছাত্র ছিলাম। আসলে একেবারেই উল্টো। আমার একাডেমিক বইয়ের একটা পাতাও কোনদিন আমি উল্টাইনি লাইব্রেরিতে। ওখানে যেতাম শুধু আনন্দ পাঠের জন্য, আউট বইয়ের খোঁজে, যে বইগুলোতে পৃথিবীর আলো হাওয়া ভেসে বেড়ায় সেই বইয়ের সমুদ্রে স্নান করার জন্য যেতাম।
চট্টগ্রামে মোট চারটা লাইব্রেরি ছিল। তিনটা শহরে এবং একটা বাইরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১. চট্টগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরি(তখন এটা ছিল মুসলিম হলের ভেতরে, পরে নতুন ভবনে আসে),
২. চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি(এটা ছিল তখন আর্টস ফ্যাকাল্টির সামনের এডমিন বিল্ডিং এ,
বর্তমান অবস্থায় এসেছে নব্বই সালের পরে পাহাড়ের পাদদেশে),
৩. বৃটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি (তখন এটা ছিল লালদিঘির দক্ষিণ পাড়ে)।
৪. মিউনিসিপ্যাল পাবলিক লাইব্রেরি ( লালদীঘির পাড়ে বৃটিশ কাউন্সিলের ওপর তলায়)
এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন মিউনিসিপ্যাল পাবলিক লাইব্রেরি। শহরের অনেকে এটার খোঁজ জানতো না প্রচারের অভাবে। এই লাইব্রেরিতে উপনিবেশ আমলের অনেক বই পত্রিকাও দেখেছিলাম একসময়। প্রাচীন একটা দালান। আবছা অন্ধকার ধোঁয়াশা ঢাকা একটা ঘর। টিমটিমে আলো জ্বলছে সিলিং থেকে। লম্বা টেবিল ঘরের মাঝখানে। সারিবদ্ধ চেয়ার। সারি সারি বইয়ের তাক দেয়াল জুড়ে। ঘরজুড়ে অতি প্রাচীন একটা গন্ধ। যেন টাইম মেশিনে চড়ে হঠাৎ করে উনিশ শতকে চলে এসেছি। ঐ তো ওদিকে বঙ্কিম, রামমোহন, বিদ্যাসাগর। তার পাশেই তরুণ রবীন্দ্রনাথ কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বিদ্রোহী নজরুল যুদ্ধের ময়দানে বসে কবিতা লিখছেন, জীবনানন্দ দাশ আনমনে হেঁটে যাচ্ছেন গোল পুকুরের পাশ দিয়ে। এঁরা সব আমার চেনা। কিন্তু লাইব্রেরিটার সময় ছিল মাত্র কয়েক ঘন্টা। পড়ার সুযোগ হতো না বেশি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে খুব বেশি সময় কাটাবার সুযোগ ছিল না। ক্লাসের ফাঁকে যতটুকু অবকাশ মিলতো ততটুকুই। বৃটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে শুধু ইংরেজি বই মিলতো। তখনো ইংরেজি আউট বইয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়নি। একাডেমিক পড়াশোনার কাজের কোন বইয়ের সন্ধানে গেলে শীতাতপ আবহাওয়ায় কিছুক্ষণ শরীর জুড়ানোই তখন আসল কথা ছিল।
সেদিক থেকে চট্টগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরি ছিল আমাদের উপযুক্ত জায়গা। ওটা ছিল আমাদের আড্ডা দেবার প্রিয় জায়গা। আমরা কয়েক বন্ধু নিয়মিত আড্ডার অংশ হিসেবে ওই জায়গাটা পছন্দ করতাম। আড্ডাটা হতো লাইব্রেরি চত্বরে। আড্ডার আগে বই পড়ার পর্ব শেষ করা হতো। যে যার পছন্দমত বই পত্রিকা বেছে নিয়ে নিজস্ব শব্দের জগতে ডুবে যেতাম।
লাইব্রেরিতে ঢোকার পর আমার পৃথিবীটা বদলে যেতো অথবা আমি নতুন একটা জগতে ঢুকে পড়তাম। যেখানে সময়ের তাড়া নেই। যেখানে পৃথিবীর স্বার্থপর কোন ভাবনা নেই। যেখানে বৈষয়িক জীবনের কোন উত্তাপ নেই। বিশাল হলঘর জুড়ে শুধু বই আর বই। সবাই চুপচাপ পড়ছে। কোন হৈ হল্লা চিৎকার চেচামেচি নেই। এই পরিবেশটা চিন্তার জগতকে বহুদূর প্রসারিত করে। মননশীলতার ভিত্তি তৈরি করে। নতুন নতুন বিষয় জানার আগ্রহ সৃষ্টি করে। আর কিছু না হোক নাগরিক কোলাহল থেকে দূরে একসাথে অনেকগুলো বই নিয়ে বসার যে আনন্দ সেটা লাইব্রেরি ছাড়া আর কোথায় আছে?
সারা দুপুর বিকেল কাটিয়ে সন্ধ্যের মুখে মুখে লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে আমরা কজন খোলা চত্বরে উন্মুক্ত বাগানে যখন গল্প করতে বসতাম, তখন আমাদের ঝুলি থেকে নানান গল্প বের হয়ে আসতো। আমরা যেন সদ্য নোঙর করা কোন সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিক। আমাদের চোখ থেকে নানান বিচিত্র অভিজ্ঞতার রঙ দ্যুতি ছড়াতো। বর্তমানের পাবলিক লাইব্রেরিবিহীন এই শহরে সেই সন্ধ্যার স্মৃতিগুলো এখনো সযত্নে জমা আছে।