'বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই/ মাগো আমার শোলোক বলা কাজলা দিদি কই?' অপার সারল্যে মোড়া গায়িকা প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অরুন্তুদ কণ্ঠে যে কবির গ্রামিক ছড়াটি সুবেদী সংগীত হয়ে আজও শ্রোতাকে আমর্ম আপ্লুত করে সেই কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী মহোদয়ের উল্লেখ এখানে নেহাতই কাকতালীয় নয়, বরং উপর্যুক্ত গ্রন্থাগারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাজেন্দ্রনারায়ণ ছিলেন কবির জেঠতুতো দাদা। যৌক্তিক কারণেই এই জমিদার পরিবারের সামান্য পরিচয় তুলে ধরা দরকার।
পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার হোগলবেড়িয়া (পূর্বতন করিমপুর) থানার অন্তর্গত যমশেরপুর গ্রাম সাধারণ্যে বাগচী যমশেরপুর নামেই উচ্চারিত কেননা বাগচীরা ছিলেন সেখানকার জমিদার। উপর্যুক্ত ছড়াকার কিংবা কবি এই বাগচী বংশেরই কৃতী সন্তান। এই বংশের পূর্বেতিহাস থেকে জানা যায় যে ঢাকার মানিকগঞ্জ থেকে একাদশ শতকে যমশেরপুরে আসেন রামভদ্র বাগচী( ১০৩১- ১১১৮)। কাছাকাছি সুন্দলপুরের মৈত্র পরিবারে তার বিবাহ হয়। এই রামভদ্রের সপ্তম পুরুষ রামনৃসিংহের সময় থেকেই বাগচীদের উত্থান শুরু হয়। তার পাঁচ ছেলের মধ্যে রামেশ্বর( বড়) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কানুনগো ছিলেন। পরের ভাই রামগঙ্গা নসীপুরের দেবীসিংহের দেওয়ান ছিলেন আর তিনিই ছিলেন জমিদারির স্রষ্টা। যার নামাঙ্কিত এই লাইব্রেরি সেই রাজেন্দ্রনারায়ণ(১২৬৯-১৩১৯ বঙ্গাব্দ) ছিলেন রামগঙ্গার নাতি।তিনি অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। রাজেন্দ্রনারায়ণের পরের ভাই ছিলেন যোগেন্দ্রনারায়ণ যিনি ১৮৮০ সাল নাগাদ মুর্শিদাবাদের লালগোলায় ওকালতি করতেন। এই বিদ্যোৎসাহী মানুষটি তৎকালিক বহরমপুরের সাংস্কৃতিক বিকাশের সঙ্গে আত্মিকভাবে যুক্ত ছিলেন আর তিনিই উল্লিখিত গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠা করেন বিংশ শতকের প্রথম দশকের শেষদিকে।
যাই হোক, করিমপুরের তৎকালিক বাসিন্দা হিসাবে অকৃত দায় থেকে ১৯৯০ সাল নাগাদ এই গ্রন্থাগার দেখতে গিয়েছিলাম আর প্রত্যক্ষ করেছিলাম তার নির্বেদ ভগ্নদশা। কিছুদিন আগে খোঁজ নিয়ে জেনেছি তার অস্তিত্ব এখন অবস্কররূপ। নিশ্চিহ্ন।
কালের ধূমলিম গর্ভারালে আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির মতো হারিয়ে গেলেও যে অক্ষর- সম্পদ সেখানে মজুত ছিল তার পরিচয় লজ্জারুণ ঐকাত্ম্যে পেশ করা আমার কর্তব্য বলেই মনে করি। বেবাক, অবিকার পাঠক অন্তত জানুক আমরা কী হারাই অক্লেশে!
সেখানে যে ছটি বড় আলমারি ছিল তার দুটি ছিল একদম ফাঁকা অর্থাৎ তখন থেকেই নামতে লেগেছিল অবহেলিত ধস। বাকি চারটিতে যা ছিল তার বেশিরভাগই সাহিত্যপুস্তক আর ইংরেজিতে লেখা ইতিহাস - বই। মোটামুটি কিছু বিরলপ্রাপ্ত তথা অধুনালুপ্ত বইয়ের কিছু তালিকা দিই : ব্রিটানিকার নবম সংস্করণের পাঁচটি খণ্ড, পাঁচ খণ্ডে ' Wood's Natural History, Tod's Annals of Rajasthan, মেকলের History of England, কার্লাইলের French Revolution, Frederick the Great ( 36 volumes), Cromwell's Letters and Speeches, জি জি রোমানেসের Darwin & After Darwin(1895), তলস্তয়ের The Divine and the Human, Juliette Dronet's Love - Letters to Victor Hugo - Louis Guimband, হার্বার্ট স্পেন্সারের Autobiography(2 volumes), পিয়ের লোতির Disenchanted, Montaigne's Essays - translated by Charles Cotton, Japan - Aspects and Destinies - W P Watson(1904), The Natural History and Antiquities of Selborne- Gilbert White (1887), The Power of Dante - Grandgent, Wonderful Nests- J G Wood(1887), Harvy's Trip to India - W J Wilkins, History of Civilization in England - Henry Thomas Buckle (3 vol.), Utopia - Thomas Moore(1908), Pelham or Adventures of a Gentleman - Lord Lytton, The Deluge - A historical novel of Poland, Sweden & Russia - Sienkiewicz (1898), The Choice of Books- F Harrison (1907), Plato's Crito & Phaedo(1888)- Dialogue of Socrates before his death, The Origin of Thought and Speech (myth) - M Moncalm, An Essay on Human Understanding - John Locke, ওয়েভারলি, ডিকেন্সের উপন্যাস, মেটারলিঙ্কের নাটক, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর কাব্যগুচ্ছ,এমনকি বাগচী বংশের ডাক্তার জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ বাগচীর ' ম্যালেরিয়া ' নামক একটি প্রয়োজনীয় গ্রন্থ।
১৯০৬ সালে প্রকাশিত মন্মথনাথ দত্ত অনূদিত ' যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা'র মূল টেক্সট, ফিটজেরাল্ডের ' রুবাইয়াত -ই - ওমরখৈয়াম (১৯১০) ইত্যাদিও ছিল। এ ছাড়া রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ' ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ', সতীশচন্দ্র রায়ের ' শ্রী শ্রী পদকল্পতরু ' আর বিশেষভাবে উল্লেখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক তথা ইতিহাসবিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ' প্রাচীন মুদ্রা ' ও ' বাংলার ইতিহাস ' বইদুটি। প্রথম বইটির এক জায়গায় লেখা : ' জ্ঞান বাগচী মহাশয়ের করকমলে অর্পিত ' আর নিচে রাখালদাসের সই। মহাভারতের মূল গ্রন্থটিও উক্ত গ্রন্থাগারের অমল সম্পদ হিসাবে ছিল।
আজ এই প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে ভাবছি, আমাদের আজকের প্রজন্মের পাঠকের কতজন এইসব বইয়ের নাম শুনেছে! আমি নিজেও তো জানতাম না তেমন। আমাদের সামনে এখন আলোলঢঙে সংকীর্তিত করার ফোপরা বিষয়ের অভাব নেই। অভাব শুধু সেই প্রভবিষ্ণু ভাবের যার ঐকান্তিক ছোঁয়া পেলে সংরক্ষিত হতে পারে হীরকখণ্ডময় অক্ষর - সম্পদ, আমরা যা হেলাফেলায় ঠুনকো যুক্তি দেখিয়ে ধ্বংস হতে দিই ; অথচ বাগাড়ম্বর করি এই বলে যে বইয়ের মতো বন্ধু আর নেই। কবির বংশধরদের কেউই হয়তো এ নিয়ে ভাবিত হননি তেমন করে, কিংবা হয়েছিলেন কি!? জানি না তা।