রসুইঘরের রোয়াক যেন জীবনানন্দ দাশের কবিতা
'এই গ্রন্থ নিছক রান্নাবান্নার বই নয়। আরও অতিরিক্ত যা আছে, তা মন ভরিয়ে দেয়।' এসব নিয়েই বই। হ্যাঁ, মানুষে মানুষে ভালোবাসা ছিল স্মৃতির বালিকাবেলায়।
রন্ধন শিল্প করে কন্যা কাগজে ভরিয়া
রসাল করিল তায় গল্পের ভাজ দিয়া
আমাকে উপরোক্ত দুই পদ রচনা করতে হলো। কারণ আমি সবে একটি বই পড়ে শেষ করেছি। বইটি পড়েছি খুবই যত্নে। পড়তে পড়তে মনে পড়ছিল আমার নিজের দাদিমার কথা। একান্নবর্তী পরিবারে তিনি ছিলেন প্রধান শেফ। তাঁর কথার কোন নড়াচড়া হতো না। মা-চাচি উনার কাছ থেকেই শিখেছিলেন রান্নার কলা। আমি মাছের কাঁটা বাছতে পারতাম না বলে উনি আমাকে ইলিশ মাছের কাঁটা যত্নে বেছে দিতেন। দাদির হাতের খিচুড়ি আর ইলিশ ভাঁজা ছিল আমার প্রিয়।
এইসব মনে পড়ছে তাঁর দায় নেবেন স্মৃতি ভদ্র ও তাঁর রচিত বই 'রসুই ঘরের রোয়াক'। অমর মিত্র বলেছেন, 'এই গ্রন্থ নিছক রান্নাবান্নার বই নয়। আরও অতিরিক্ত যা আছে, তা মন ভরিয়ে দেয়।' আমারও মন ভরেছে তাই আজ কিছু বলার প্রয়োজনবোধ করছি।
এমন একটি বই রচনায় ধৈর্য ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন স্মৃতি ভদ্র । কতখানি উৎসাহ এবং নিষ্ঠা থাকলে একাজ করা সম্ভব তা বইটির প্রতিটি পৃষ্ঠা সাক্ষী। বাংলার রন্ধনশিল্পকে তিনি গল্পের আকার দিয়েছেন। শেষের কবিতার অমিতের মুখ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যেমন বলিয়েছিলেন যে, "আমের মাঝখানটাতে থাকে আঁঠি, সেটা মিষ্টিও নয়, নরমও নয়, খাদ্যও নয় , কিন্তু ঐ শক্তটাই সমস্ত আমের আশ্রয়, ওইটেতেই সে আকার পায়।" তেমনি রসুইঘরের রোয়াকের গল্পগুলি আমের আঁঠির মতো বইটিকে আকার দিয়েছে।
রসুইঘরের রোয়াক যেন জীবনানন্দ দাশের কবিতা। যার ছোঁয়ায় রয়েছে ধান, সরষে তিলের মতো উপাদেয় উপকরণ।
নরম ধানের গন্ধ- কলমীর ঘ্রাণ,
হাঁসের পালব,, শর, পুকুরের জল, চাঁদা সরপুঁটিদের
মৃদু ঘ্রাণ, কিশোরীর চাল-ধোয়া ভিজে হাত- শীত হাতখান,
কিশোরের পায়ে-দলা মুথাঘাস,- লাল-লাল বটের ফলের
ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতা- এরি মাঝে বাংলার প্রাণ
যেকোন রান্নার প্রাণই হলো কসা। রান্না ঠিক মতো না কসলে সেটা সুস্বাদু হয় না। এটা যারা ভালো রাঁধতে পারেন তারা বেশ ভালো বোঝেন। স্মৃতি ভদ্র কেমন রাঁধুনি আমি জানি না তবে উনি বইটি যেমন করে কসেছেন তেমন অনেক বাঘা গ্রন্থকারও পারবেন কি না সন্দেহ। এখানেই স্মৃতির কৃতিত্ব।
বইটির শেষে একটি পরিভাষা থাকলে মন্দ হতো না। তবু রবীন্দ্রনাথ তাঁর পরিত্রাণ-এ লিখেছেন, 'মহাদেব বুকের মধ্যে রেখেছেন অন্নপূর্ণাকে', আমি রসুইঘরের রোয়াককে রাখলাম আমার পড়া সেরা বইয়ের তালিকায়।
সূচিপত্রে উঁকি দিলেই বইটি পড়তে ইচ্ছে করবেই করবে…
সূচিপত্র খেজুর গুড়ের চা, তেমন কিছু নয় # ১৯ তিল কুমড়ো, খুব সাধারণ একটি নিরামিষ পদ # ২১ চালে-ডালে, খোসাসুদ্ধ মাসকলাই ডালের নরম খিচুড়ি # ২৩ কুমড়ো বেশ্বরী, সরষে বাটায় চালকুমড়ো # 27 কচুর পুরপুরি, কাবিল কচুর ডাটা আর চিংড়ি মাছের বড়ার ঘণ্ট # ৩০ পালং শাকের শুক্তো, মুগের ডাল আর আদা দিয়ে পালং শাকের তরকারি # ৩৪ মুগের রসপুলি, মুগডাল আর নারিকেল দিয়ে বানানো গুড়ের রসপুলি # ৩৮ মানকচুর ধোঁকা, বুটের ডাল আর সেদ্ধ মানকচুর বড়ার রসা # ৪২ আতপ মোচা, আতপ চাল দিয়ে মোচার ঘণ্ট # ৪৬ পটোল পাতুরি, সরষে বাটায় পটোল # ৫১ জালি কলাই, মৌরি-ফোড়ন আর আদা বাটায় চালকুমড়ো দিয়ে মাষকলাইয়ের ডাল # ৫৪ ঝিঙের তিল বাটুরি, তিল-সরষে বাটা আর চাপড়া দিয়ে ঝিঙের তরকারি # ৫৮ লাউয়ের জলবড়া, মটরডাল আর লাউ মিশিয়ে বানানো কোফতার রসা # ৬২ শিম সরষে, সরষে বাটা দিয়ে শিমের চচ্চড়ি # ৬৭ পটোল বিরন, পটোল দিয়ে তুলসীমালা চালের পোলাও # ৭২ শোল-আলুর রসা, শোল মাছ আর শীতের নতুন আলুর রসা # ৭৭ মৌরি--বাঁধাকপি, মৌরি আর আদা বাটা দিয়ে ছোলার ডাল মেশানো বাঁধাকপির সাদা ঘণ্ট # ৮৩ বউখুদ, ভাঙা চাল বা খুদের পোলাও # ৮৯ বড়ার পায়েস, কলার বড়া, নারকেল আর কুশরের গুড় দিয়ে ঘন দুধের পায়েস # ৯৪ পাতুরি বড়া, বাঁধাকপির পাতায় সরষে কাচকির বড়া # ১০০ জয়দানা পায়েস, হাতে কাটা সেমাইয়ের পায়েস # ১০৭ সবজি বিরন, কাউনের চাল আর সবজি দিয়ে রান্না করা পোলাও # ১১২ হাঁস-ওলের সালুন, ওলকচু দিয়ে হাঁসের মাংসের ঝোল # ১১৮ ইলিশ শুক্তো, রাঁধুনি আর আদা বাটায় ইলিশের সাদা সবজির ঝোল # ১২৩ মরিচ পোড়া ঝোল, শুকনো মরিচ আর রাঁধুনি ফোড়নে মাছের পাতলা ঝোল # ১২৯ তিলের ক্ষীরশা আর সরা পিঠে। সাদা তিল আর নারিকেলের পুর সঙ্গে সরায় ভাজা সাদা চিতই পিঠা # ১৩৪ শাক ঘণ্ট, মুলা শাকের সঙ্গে চিংড়িমাছ, বেগুন আর আম-কাসুন্দির ঘণ্ট # ১৪১ মটরদানার পায়েশ, ক্ষীর আর ঝিঙের শাইল আতপের পায়েশ # ১৪৮ নারিকেল মাখা জালি কুমড়ো, নারিকেল আর জালি কুমড়োর ঘণ্ট # ১৫৪ চিতল মাছের রসা, ছোট আলু দিয়ে চিতল মাছের ঝোল # ১৬০ আম-বেগুন, সরষে বাটায় কাঁচা আম আর বেগুন # ১৬৬ চিতল মাছের কোরা, কাঁটা ছাড়ানো চিতল মাছের লাল রসা # ১৭১ ঝিঙে বাসন্তী, তিল আর সরষে বাটায় ঝিঙে-মিষ্টিকুমড়ো # ১৭৮ চাল, বাঁধাকপি, আতপ চাল আর ঘি ফোড়নে বাঁধাকপির ঘণ্ট # ১৮৪ কই-মৌরি, মৌরি আর কাঁচামরিচ বাটায় কই মাছ # ১৯০ দৈলা পিঠা, চালের গুড়া আর গুড় দিয়ে বানানো পিঠা # ১৯৬ দোমাছা, বেলে মাছ আর ছোট চিংড়ি দিয়ে শাক চচ্চড়ি # ২০২ পুঁই-ইলিশ, পুঁইশাক ও ইলিশ মাছের তেলঝোল # ২০৯ পাতা বড়া, লাউপাতায় চিংড়ির বড়া # ২১৫