লাইব্রেরি নিয়ে লিখেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ
কী অদৃশ্য জাদুবলে গৃহকর্তা বইয়ের অসমঞ্জস পাঁজা থেকে নিমেষে কাঙ্ক্ষিত বইটি বার করে আনেন—তা আশ্চর্য লাগত প্রথম-প্রথম। যত দূর মনে পড়ে, শমীকদার (বন্দ্যোপাধ্যায়) বাড়িতেই এই বইয়ের গোলকধাঁধাটা
‘লাইব্রেরি' বলতে বহুদিন ধরে কেন যেন বুঝতাম যে একটা বইয়ের শিরদাঁড়ায় অক্ষর-নম্বর মেশানো একটা গোলচে চাকতি। মাসিমণি দক্ষিণী-তে গান শিখতে যেত। আর ফেরার পথে নানা বাংলা গল্প-উপন্যাসের বই নিয়ে আসত। মাসিমণির পড়া হয়ে গেলে সেটা আবার আসত মায়ের কাছে। মাসিমণি ও মা—দুই বোন মিলেমিশে বইটা শেষ করত।
সেই থেকে লাইব্রেরি বস্তুটা আমার কাছে একটা টিকিট-আঁটা বইয়ের ঘর। লাইব্রেরি যে ব্যক্তিগতও হতে পারে, এই বোধ বা চেতনা আমার অনেক পরে হয়েছে। ভুল বললাম, ব্যক্তিগত পুস্তক-সংগ্রহকে যে কারও নিজস্ব লাইব্রেরি বলা যায়, সেটা হজম করতে অনেক সময় লেগেছে।
ওখানে টিকিট-আঁটা বই নেই, বেশির ভাগ সময় গোছানোও নেই, কিন্তু কী অদৃশ্য জাদুবলে গৃহকর্তা বইয়ের অসমঞ্জস পাঁজা থেকে নিমেষে কাঙ্ক্ষিত বইটি বার করে আনেন—তা আশ্চর্য লাগত প্রথম-প্রথম। যত দূর মনে পড়ে, শমীকদার (বন্দ্যোপাধ্যায়) বাড়িতেই এই বইয়ের গোলকধাঁধাটা প্রথম প্রত্যক্ষ করি।
তখন সদ্য স্কুল পার হয়ে কলেজে ঢুকেছি। শমীকদার একবাড়ি বই দেখে কীরকম আশ্চর্য লাগত।
তারপর একসময় অভ্যেস হয়ে গেল। শমীকদার বাড়িতে এখন আর খুব নিয়মিত যাওয়া হয় না। মাঝে-মাঝে শঙ্খদার (ঘোষ) বাড়ি গেলে, ওই পুস্তক- পরিবৃতির ওমটা পাই।
বইয়ের গাদা বা পাঁজা যে দেখতে কত সুন্দর, সত্যিই এই দু'টো বাড়িতে না- গেলে বুঝতে পারতাম না।
সেই সঙ্গে চিত্র-পরিচালক হিসেবে এটাও শেখা হত না, যে, তেমন পরিবার হলে বইয়ের থেকে সুন্দর আর কিছুকে মানায় না, একটা পরিবেশের অন্তরঙ্গতা আর সংস্কৃতির যুগ্ম-অভিঘাত সৃষ্টি করতে।
দুই
আর পাঁচটা বাঙালি মধ্যবিত্তর বাড়িতে যেমন রবীন্দ্র-শরৎ-বঙ্কিম রচনাবলি থাকে, আমাদের বাড়িতেও তেমন ছিল। বাঁধানো ‘দেশ’বাবার সংগ্রহ, ঠাকুর্দার কাছ থেকে কতকগুলো বাঁধানো ‘প্রবাসী’ এসে ঠাঁই পেয়েছিল।
চিত্রকলার কিছু বই ছিল। আর মন্দির-স্থাপত্য ও ভাস্কর্য নিয়ে বাবার বিশেষ আগ্রহ ছিল বলে অনেক সেরকম বই ছিল। ছিল মিউজিয়াম ক্যাটালগ-ও। নিয়মিত বই কেনার সংগতি বাবার একার চাকরিতে কুলিয়ে ওঠেনি। তবুও বইমেলার একটা নিয়মিত পাড়ি প্লাস্টিকের প্যাকেটে করে কতকগুলো নতুন বই আমদানি করত প্রতি বছর আমাদের বাড়ির বুককেস-এ।
একটু উপার্জন করতে শুরু করার পর আমি বই কিনতে আরম্ভ করি। কোনও বিশেষ আগ্রহ থেকে নয়, কোনও বিশেষ বিষয়প্রীতি থেকে নয়। শুরু হয়েছিল বিশ্ব-সিনেমা সংক্রান্ত বই দিয়ে। এখন সেটা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যে কত বিষয়কে টেনে এনেছে হাতের নাগালে, জানি না।
একটা সাধারণ প্রশ্নের সম্মুখীন হই প্রায়ই :
—এত বই তোমার? পড়েছ?
অবলীলায় বলি,
-না। আংশিক পড়েছি। কিছু বই উল্টে দেখেছি। অনেকগুলো বহুবার পড়েছি। কিন্তু কবে কোন বইটা পড়তে ইচ্ছে করবে, জানি না।
বাবা-মা দু'জনেই চলে যাওয়ার পর যখন সত্যিই নিঃসঙ্গ হলাম, কোথা থেকে যেন প্লাইউডের বুককেসগুলো আশ্বাসবাণী পাঠাতে লাগল দলে দলে।
তারপর, একদিন দেখলাম—যাক, এরা অন্তত আমাকে কখনও নিঃসঙ্গ করে যাবে না।