আড্ডা নামক জিনিসটির সঙ্গে বাঙালি মাত্রেরই একটা আত্মিক যোগাযোগ রয়েছে সে কথা নতুন করে না বললেও চলে। আড্ডার রকমফের আছে।
বাঙালির কাছে আড্ডা মানে গা-হাত-পা ঢেলে, ছড়িয়ে, নাওয়াখাওয়া ভুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকা। তবেই না নির্ভেজাল আড্ডা। আড্ডার মতো এমন অর্থঘন এবং যথার্থ শব্দ আর অন্য কোনো ভাষায় আছে কি না আমাদের জানা নেই। আড্ডার গাড্ডায় যিনি জীবনে একবার না পড়েছেন তার পক্ষে এর মজাটা টের পাওয়া খুবই কঠিন।
আড্ডার জন্য প্রয়োজন মেজাজের। আবার শুধু মেজাজ হলেই অন্তহীনভাবে সচল, সরব ও বেদম বাকশক্তি। দাম ফুরোলেই কিন্তু... সম্ভবত আর বিশদ করার প্রয়োজন নেই।
কারো পরম মিত্র ও বান্ধব, আবার কারুর গায়ে নু বিছুটি-বাংলাদেশের প্রথিতযশা কবি শহীদ কাদরী বেশ কয়েক বছর ধরে প্রবাসজীবন যাপন করছেন। এক সময় ছিলেন ইউরোপে, তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন হয়ে এখন কিডনিহীন অবস্থায় নিউইয়র্কে আস্তানা নিয়েছেন। নতুন করে বাংলাদেশের মেয়ে স্বাতীকে ঘরণী করে। ভার্মন্টে কিডনি সংস্থাপনের তালিকায় দিন গুনছেন। শহীদ সম্পর্কে বহু উড়ো খবর শোনা যায় প্রায়ই। সত্য-মিথ্যা বলা মুশকিল হলেও জাতিসংঘে কর্মরত আমাদের হাসান ফেরদৌস আর তার স্ত্রী রানুদের বাড়িতে মাঝে মাঝে জম্পেশ আড্ডা বসে। সেখানে শহীদের প্রবল উপস্থিতি। আর শহীদ যেখানে সেখানে তুমুল তর্ক-বিতর্ক হবে না তা কী করে হয়। সেই সঙ্গে যদি মার্কিন মুলুকের একটি কলেজে অধ্যাপনারত অনুজপ্রতিম বন্ধু আবেদিন কাদের উপস্থিত থাকে তাহলে তো সোনায় সোহাগা। দারুণ পড়ুয়া আবেদিন কাদের একটি পত্রিকাও চালান।
তবে শহীদ কাদরী যে ঢাকায় নেই বা শহীদবিহীন ঢাকা শহর- এটা দেখছি শহীদের শত্রুমিত্ৰ সবার কাছেই সমান আক্ষেপ ও বেদনার। নানা সময়ে বরং বিভিন্ন প্রসঙ্গে অনেককেই বলতে শুনেছি, ‘আহা! শহীদ যদি থাকত এখন, বেশ হত।’
এই একটি বাক্য দিয়েই বোঝা যায় শহীদের মিত্র এবং শত্রুরা কতটা ‘মিস’ করছে শহীদকে।
যে কোনো বিষয়ে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে যেতে শহীদের ক্ষমতা ছিল এক কথায় দ্বিতীয়রহিত।
ব্যক্তিগতভাবে শহীদের সঙ্গে আমার চাক্ষুষ পরিচয় হয়েছিল প্রায় দুযুগেরও অধিককাল আগে।
আধুনিক শহুরে এবং মুক্তমনের মানুষ বলতে যা বোঝায়, শহীদ ছিল সেন্ট পার্সেন্ট ঠিক তাই। কেন জানি না বা বলতে পারব না, শহরের বাইরের কোনো পরিবেশে শহীদকে কেমন যেন ঠিক মানাত না। আমি অনেকবার মিলিয়ে দেখতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছি। শহীদের ভরাট কণ্ঠস্বর, সুচারু বাগবৈদগ্ধ্য, প্রখর উপস্থিতবুদ্ধি ও রসবোধ, বিদ্যুৎচমকের মতো তীব্ৰ শ্লেষ, অব্যৰ্থ লক্ষ্যভেদী ও ক্ষুরধার বাক্যবাণ সহজেই কাউকে ধরাশায়ী করার জন্য ছিল যথেষ্ট।
আমাদের সাহিত্যের অঙ্গনে শহীদের অনুপস্থিতি সত্যি এ সময়ের একটি বিরাট ঘটনা। এ প্রসঙ্গের অবতারণা এ কারণেই করলাম যে, আমাদের এই ক্ষুদ্রমতি দেশে সচরাচর এ ধরনের মনোভাব দেখা যায় না।
শহীদ মানেই ঢাকার অগুণতি ক্যাফে, রেস্তোরাঁ, চায়ের দোকানে অখণ্ড ও নির্ভেজাল আড্ডা আর আড্ডা, সদলবলে অ্যাসফল্টের রাস্তা, অলিগলি ভেঙে উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরে বেড়ানো দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। কি অমাবস্যা, কি জ্যোৎস্নালোকিত রাত, শহীদের কাছে সবই সমান। বিশেষ করে রাত যত গভীরতর হত ততই যেন আরো জমজমাট আর চাঙা হয়ে উঠত সবকিছু।
নবাবপুর রোড ধরে তখন যতগুলো জমজমাট আড্ডার আসরের জন্য যত গুণাবলির প্রয়োজন সেগুলোর সব কটাই শহীদের মধ্যে অধিক ছাড়া কম ছিল না। যার ফলে যেখানেই শহীদ কাদরী সেখানেই অন্তহীন আড্ডা আর আড্ডা। চায়ের পেয়ালায় তুমুল ঝড়। তা সে শতজীর্ণ চায়ের দোকানেই হোক, চাই শহীদের নিজের কিংবা অন্য যে কারো আস্তানা থেকে আস্তাবল যাই হোক না কেন, এ ব্যাপারে শহীদের কোনো বাছবিচার নেই। কবি বলে শহীদ যে শুধু কবিদের সঙ্গেই আড্ডা দিত মোটেই তা নয়। শহীদের আড্ডার পরিমণ্ডলে বহু বিচিত্র চরিত্রের সমাবেশ ঘটত। তবে কবি ও কবিতা যে শহীদের কাছে পরম উপাদেয়। ও মুখরোচক প্রসঙ্গ ছিল সে তো বলাইবাহুল্য।
শহীদকে নিয়ে অজস্র চুটকি, বহু রসিকতা, অনেক কৌতুক প্রচলিত আছে বাজারে। সংখ্যার দিক থেকে সেগুলো এতই প্রতুল ও কৌতুহলোদ্দীপক যে, কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি! শহীদকে নিয়ে বহু গল্প তার বন্ধুদের মুখে মুখে ঘোরে, প্রায় নিত্য এবং প্রিয় প্রসঙ্গের মতো।
এমন একটা সময় ছিল যখন শহীদ কাদরীর দিন শুরু হত বেলা বারোটার পর থেকে। সদ্য ঘুমভাঙা চোখেমুখে জলের ছিটে দিল কি না দিল, ভরদুপুরে রোদ মাথায় নিয়ে শহীদ বেরিয়ে পড়ত আড্ডার সন্ধানে। ওয়ারি পাড়ার কোনো চা-দোকানের মধ্যাহ্নকালীন আড্ডা সেরে শেষ বিকেলের পড়ন্ত রোদ ঝিরঝিরে হাওয়া শরীরে মেখে শহীদ এগোল বাংলাবাজারের দিকে। বিউটি বোর্ডিং কিংবা গোবিন্দধাম ছিল তার গন্তব্যস্থল। রাত নটা-দশটার দিকে আবার নবাবপুরের কোনো হোটেল কিংবা রেস্তোরাঁ। রাত বারোটার পর ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের টি-স্টল। সেখান থেকে ভোর চারটে কি পাঁচটার দিকে এলোমেলো ইতিউতি হাঁটতে হাঁটতে- ততক্ষণে চা দোকানগুলোর উনুনে আঁচ দেয়া শুরু হয়ে গেছে, জিলিপি ভাজার আয়োজন চলছে। ঝাপসা ফিকে অন্ধকারে জেগে উঠত দু-একজন মানুষ। ঝাড়ুদার-ঝাড়ুদারণীরা নেমে পড়েছে রাস্তায়। শহীদ গরম গরম জিলিপিসহযোগে দোকানের প্রথম কাপ চা (গত রাতের শেষ কাপ চাও শহীদই পান করেছিল) খেয়ে সিদ্দিকবাজারের ঘরে ফিরে একটানা ঘুম লাগাত দুপুর বারোটা অব্দি। ফের দুপুর বারোটা থেকে শুরু হত। এভাবে শহীদ কাটিয়েছে তার প্রথম যৌবনের অনেকগুলো বছর তার ভাইয়া শাহেদ কাদরীর সস্নেহ প্রশ্রয়ে।
আড্ডা-অন্তপ্রাণ শহীদের মায়ের মৃত্যুর পর বোন নাজিফা চালাত সংসার।
শহীদ কাদরী সর্বতোভাবে একজন খাঁটি কবি। শহীদ এমন কবিদের দলে যারা অত্যন্ত কম লেখেন কিন্তু তাদের প্রতিটি রচনাই সমানভাবে উল্লেখযোগ্য এবং পাঠকসমাজে আদৃত হয়। সংখ্যার দিক থেকে এত কম লিখেছেন যে বিশ্বাসই হতে চায় না তারা কী করে একজন মালার্মে কিংবা টেড হিউজেস হতে পেরেছেন। কাব্য-অনুরাগীরা কিন্তু আগ্রহ এবং ব্যাকুলতার সঙ্গে প্রতীক্ষায় থাকেন তাঁদের প্রতিটি নতুন রচনার জন্য। কেননা সেগুলোই পাঠকের কাছে এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতার উপহারস্বরূপ। বিগত পনেরো বছরে শহীদের মাত্র তিনটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে। সব মিলিয়ে তার কবিতার সংখ্যা হয়তো শতাধিকও হবে না। ব্যক্তিগত জীবনে শহীদ অত্যন্ত মার্জিত, সুরসিক এবং বন্ধুবৎসল অতিশয় কোমলহৃদয়। ক্ষুরধার, রসালো তির্যক বাক্যবাণে শহীদের পটুত্ব অসাধারণ কিন্তু সেটা নির্ভেজাল ও মলিনতাহীন।
শহীদের কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে শহুরে মানুষ নাগরিক মানসের প্রতিচ্ছবি, তাদের সমস্যাজর্জরিত জটিল জীবন, ভাবাবেগ, আতঙ্ক, অনিশ্চয়তাবোধ, ক্ৰোধ, হিংসা, হতাশা কৃত্রিমতা; কখনো বহিরাশ্রয়ী প্রতীকের গভীরতায়, কখনো তীক্ষ্ম উপমায় রূপকল্পে। বিংশ শতাব্দীর কবিতার সর্বাঙ্গে বিস্ময়কর নিপুণতার সঙ্গে সংহত করে তোলেন। তার প্রতিটি কবিতাই বুদ্ধিদীপ্ত ও ঝকঝকে। তার ভাষা অত্যন্ত ঋজু সংকেতময় এবং তীব্ৰ গতিসম্পন্ন। ত্ৰিশোত্তর বাংলা কবিতার নিরক্ত ধমনীতে শহীদ নতুন রক্তোচ্ছ্বাস এনে দিয়েছেন। স্বোপার্জিত মুদ্রা অঙ্কিত করেছেন তার কাব্যপ্রতিমায়। প্রেমের কবিতায় শহীদ একটি ব্যাপক প্রেমানুভূতিকে পরতে পরতে মেলে ধরে তার মধ্যে সঞ্চারিত করেন শাশ্বত রহস্যের আর্তি আকুতি। যেমন ‘তোমার বিহ্বল হ্রদ ছাড়া আর কোনো স্নানও জানি না, কিংবা যেখানে ‘সোনালি কিচেনে তুমি। বসন্তের প্রথম দিনেই হত্যা করেছিলে আমাকে তোমার নিপুন নিরিখে’ অথবা ‘যে রুটিতে ঝরে না। ঝর্ণার মতো মেশে না তোমার/স্তনের লবণ’। বিশ শতকের বিশ্ব কবিতার মতো শহীদের কবিতাও চূর্ণবিচূর্ণ, আর্ত, গোপনাভিসারী ও একান্ত নিজস্ব। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’র সুন্দর প্রচ্ছদচিত্রটি এঁকেছেন শহীদের রূপসী এবং বিদুষী স্ত্রী নাজমুন্নেসা ওরফে পিয়ারী। যিনি এখন প্রাক্তনী। আর কবি গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন ‘পিয়ারীকে। উৎসর্গপত্রের উজ্জ্বল পঙক্তি দুটি তুলে দিচ্ছি : ‘গানগুলো যেন পোষা হরিণের পাল/তোমার চরণচিহ্নের অভিসারী।’ মধুর দাম্পত্য ছবি নয় কি? আরেকটা গোপন খবর, বিজ্ঞানের অধ্যাপিকা হলেও নাজমুন্নেসা ছবি আঁকা ও কবিতা লেখাতেও বিশেষ পারদর্শিণী।
শহীদ পাবলো নেরুদা, ওকতাভিও পাস, সেফেরিসের কিছু কবিতার চমৎকার তরতাজা তরজমা করেছিলেন বাংলায়। কবিতা ও সাহিত্যবিষয়ক আলোচনায় শহীদ ইতোমধ্যেই লব্ধপ্রতিষ্ঠা। দৈনিক সংবাদপত্রের রবিবাসরীয়তে নিয়মিত ফিচার লিখে শহীদ প্রমাণ করছেন তার গদ্যশৈলী তার কবিতার মতোই অননুকরণীয়। ইংরেজি রচনাতেও শহীদ অত্যন্ত সাবলীল। কিছু বাংলা কবিতার ইংরেজি অনুবাদও করেছিলেন এক সময়।
শহীদের মতো প্রকৃত খাদ্যরসিক আমি বস্তুত জীবনে খুব কমই দেখেছি। ভালো খাবারের প্রতি তার এক ধরনের দুর্মর টান ছিল। দানাদার কী জিনিস এবং দানাদার খাওয়ার ভিতর কী অনির্বচনীয় স্বাদ সুখ ও তৃপ্তি পাওয়া যায় সেটা আমি শহীদের অভিব্যক্তি থেকেই বুঝেছিলাম।
মুহূর্তের মধ্যে অসম্ভব ভালো গালগল্প বানানোর একটা আশ্চর্য এবং সহজাত ক্ষমতা ছিল শহীদের। এ ব্যাপরে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটি সরস এবং উপাদেয় গল্পের জন্য প্রকৃত তথ্য কখনো বাধার বিন্ধ্যাচল হয়ে দাঁড়াতে পারেনি শহীদের সামনে। প্রয়োজনে কাটছাঁট বা সংযোজন, পরিবর্ধনের এক নিপুণ শিল্পী ছিল শহীদ।
তার অধীত বিদ্যাবুদ্ধি পড়াশোনার পরিধি ছিল বিশাল, বিচিত্র ও ব্যাপক। কিন্তু তাই বলে অযথা পাণ্ডিত্যের ভরে শহীদকে কখনো ন্যূব্জ হতে দেখিনি। শহীদ তার পড়াশোনাকে ব্যবহার করত খাপখোলা বাঁকা তরবারির মতো।
আর ছিল শহীদের সেই প্ৰায় কিংবদন্তিখ্যাত অট্টহাসি। হাসি না বলে হাস্য বললে বোধ হয় কিছুটা মানানসই হয়। এই হাসি দিয়ে যে শহীদ কত রথী-মহারথীকে কুপোকাত করেছে, কত অসার দম্ভের ফাঁপা বেলুনকে মুহুর্তে চুপসে দিয়েছে তার হিসেব-নিকেশ নেই।
কিন্তু এই যে এতকিছু যে শহীদকে নিয়ে অর্থাৎ তুখোড় আড্ডাবাজ শহীদ, বাকপটু শহীদ, বিশালবপু শহীদ, পণ্ডিত শহীদ তার সব পরিচয়কে ছাপিয়ে শহীদের ভিতর যে এক সরল, অভিমানী ও অমলিন শিশু এবং সর্বোপরি একজন বড়-মাপের কবি লুকিয়ে রয়েছে- তার মধ্যে কিন্তু কোথাও একরত্তি খাদ মেশানো নেই।
আমার মতে শহীদবিহীন ঢাকা শহরকে আগের তুলনায় অনেক নিষ্প্রভ দেখায়। শহীদের স্বেচ্ছা নির্বাসনের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা শহর আঙুল গলানো অজস্রতা।
তিন মহাসমুদ্রের অপর পার থেকে শহীদের সেই প্ৰচণ্ড উদ্দাম অট্টহাসি কবে এসে আবার ঢাকায় পৌছবে, সেই অপেক্ষায় দিন গুনি।
শহীদের সঙ্গে সেই অর্থে কেউ কোনোদিন আমার আনুষ্ঠানিক আলাপ-পরিচয় করিয়ে দেয়নি। দুৰ্গমতো বিউটি বোর্ডিংয়ের ছায়াচ্ছন্ন স্যাঁৎস্যাঁতে ঘর, হাত ঘুরতে ঘুরতে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত নেতিয়ে আসা কবিতা পত্রিকা আর তাতে সদ্যপ্রকাশিত একটি অনবদ্য কবিতা, তার মধ্যে বা শেষে যদ্দুর মনে পড়ে ‘প্রাঙ্গণের তরুণ কুকুর’ বলে একটি উজ্জ্বল পঙ্ক্তি নিয়ে বিতর্কের ফেনা, প্যাকেটের পর প্যাকেট তরতাজা স্বাদের ক্যাপস্টান শলাকার বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ, মাঝে মাঝে নাতিশীতোষ্ণ বিচিত্র বাদামি চায়ে চুমুক- এই নিয়ে সেই প্রাকদুপুর গড়িয়ে অপরাহ্ণ, অপরাহ্ণ গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত, গভীর রাত অবধি একটানা, ফাঁক-ফোকরে কত জন যে এল-গেল তার হিসেব কে রাখে। দায় কার।
আবার এই শহীদই আমার এক বিমনা মাতুল কাম্বার আলীর আলুবাজারের অফিসে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল স্বাধীনতা-পূর্ব ও পরবর্তীকালে যথাক্রমে টাঙ্গাইলের রফিক আজাদ-এর সঙ্গে পরে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত দুর্ধর্ষ কথাশিল্পী মাহমুদুল হকের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছিল শহীদ মারফৎ। তারপর কত ঘটনা বিপদে বলতে গেলে সহজে ফুরোবার নয়।
বিউটি বোর্ডিং ছাড়া শহীদের আরেকটি আড্ডাস্থলের মধ্যে ছিল অদূরে মোড়ের মাথায় গোবিন্দের চায়ের দোকান। সেখানে নিয়মিত আসতেন পাড়ি দেয়া ব্রিটিশ চ্যানেল সাঁতারু ব্রজেন দাস, সুকুমার, আরিফ, প্ৰভু মানে খালেদ চৌধুরীসহ আরো কৃতিবিদ্য মহাজনরা, যাদের অনেকেই আজ পরলোকে কিংবা শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে। এরা প্ৰত্যেকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে একেকজন বিশারদ।
শহীদের সঙ্গে আমার যতবারই দেখা হত- প্ৰবাসজীবনের ফাঁকে ফাঁকে। আমি ছিলাম আজন্ম প্রবাসী। আজ এ শহর তো কাল ওশহরে। আজ এ বেলা নারিন্দা তো অন্যবেলা তেজকুনিপাড়া। তবে সেদিনের নারিন্দা আর শহর ঢাকার তেজকুনিপাড়ার দূরত্ব বা অবস্থান দিয়ে আজকে ঐ জায়গা দুটি নির্ণয় করতে গেলে বিপদে পড়ারই সমূহ সম্ভাবনা। একদা জেলা শহর ঢাকা আর আজকের রাজধানী শহর ঢাকার বিস্তর ফারাক। যেমন সেদিনকার শ্ৰীশদাস লেন নিবাসী তরুণ কবি যশোপ্ৰার্থী শহীদ কাদরী আর হাল সাকিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য বস্টননিবাসী স্থিতিজাঢ্য শহীদ কাদরীর মধ্যে যোজন প্রমাণ যতটা দূরত্ব। কথাবার্তায় শহীদের হয়তো ভরাট কণ্ঠের কারণেই দারুণ একটা সম্মোহনী শক্তি ছিল। তা সে খুব সিরিয়াস কথার বেলাতেই হোক, চাই হালকা মেজাজের চটুল কথাবার্তাই হোক।
মাঝে শহীদ এক কৃষ্ণাঙ্গিণীর সঙ্গে যতটা শোনা যায় এক দুর্বিষহ জীবনযাপনের পর তার মৃত্যু হলে শহীদ প্রত্যুৎপন্নমতি বাঙালি ললনার সেবাশুশ্রূষায় দিন কাটাচ্ছেন নিউইয়র্কে।
শহীদের সাথে ঢাকার বাইরে আমার প্রথম দেখা হলো বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। তখন আমি একাই চট্টগ্রাম শাসন করছি। থাকি স্নেহশীল ধনাঢ্য মামা-মামীর কেয়ার অফে। হঠাৎ কী এক খেয়ালে বলা নেই কওয়া নেই, হুট করে সে আশ্রয় ছেড়ে মগ হার্মাদ পাড়ায় চোর-ডাকাত-খুনিদের আড্ডায় জুটে গেছি। স্বাধীনচেতা জীবনযাপন। কাউকে তোয়াক্কা করতে হয় না। ঠিক এ সময় হঠাৎ একদিন এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে শহীদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তাও আবার সেই ঢাকার বাইরে। প্রথম বেশ কিছুক্ষণ অনেক কিছু মেলাতে পারছিলাম না। শহীদের পরনে স্যুট-টাই, হাতে একটা ব্রিফকেস জাতীয় চামড়ার ব্যাগ। মুখজুড়ে অপ্ৰস্তুত কিন্তু আপাত স্বস্তির হাসি।
ক্রমশ জানা গেল শহীদ একটা দেশী ওষুধ কোম্পানিতে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি নিয়েছে। এখন থেকে চাটগাঁতেই থাকতে হবে। স্বভাবতই আমাদের দুজনের আহ্লাদের সীমা-পরিসীমা রইল না। যথারীতি সেই দুরন্ত দুপুরেই আগ্রাবাদের কাছাকাছি শহীদের আস্তানায় পৌঁছানো গেল। কোনো এক পরিচিতজনের যোগাযোগে ওখানে থাকবার অস্থায়ী আস্তানা জুটেছে। একটা ছেমড়া চাকরও রয়েছে। এর মধ্যে শহীদ তার স্বভাবসুলভ ওই ছোকরার সঙ্গে বেশ জমিয়ে নিয়েছে। ছেলেটি কথা বলে হিজড়েদের মতো কণ্ঠে ও ভঙ্গি করে। ঘরের ভিতর কোনো আসবাবপত্রের বালাই নেই। কয়েকটি দৈনিক কাগজের ওপর একটি সরু বিছানা। তার ওপর বেশ ক’টি স্টিফেন স্পেন্ডার সম্পাদিত ‘এনকাউন্টার’ পত্রিকা, এডওয়ার্ড এমসনের ‘সেভেন টাইপস অব অ্যাম্বিগুইট’, আর. পি. ব্ল্যাকমুরের ‘ওয়েল রট আর্ন প্রভৃতি পেলিক্যানের বই। ডালা খোলা স্যুটকেসে কিছু জামা-কাপড়। প্রথমেই ছেমড়াকে ডেকে শহীদ চায়ের আদেশ করল। চা এল। ঘরময় পোড়া সিগ্রেটের টুকরো ছড়ানো-ছিটানো। ছোকরাটি এবার তার আদি ও অকৃত্রিম বিলম্বিত কথনভঙ্গিতে বলতে লাগিল- ‘হেই মিয়াভাই এত সিগারেট খাইবার পারেন, এমুনডা আমি আর দেখি নাই।’ শহীদ ওকে নিয়ে দারুণ রঙ্গরসে মেতে উঠল। এক সময় আচমকা এক ধমক লাগিয়ে বলে উঠল : ‘ঐ হালা, আরো ঠিক কইরা কথা কইবার পার না। রংবাজি করবার জায়গা পাও না হালায়।’ আসল শহীদ অবলীলায় যে কারো সঙ্গে প্রয়োজনমতো এক্কেবারে সাধারণ স্ল্যাং ব্যবহার করে মোটা দাগের রঙ্গ-রসিকতায় মেতে উঠতে খুব দড় ছিল।
কিছুদিনের মধ্যেই শহীদের বিচিত্র সব অবাঙালি বান্ধবের সমাবেশ ঘটতে লাগল। একজন হ্যাট মাথায় দীর্ঘদেহী কোনো ডিটেকটিভ বই থেকে উঠে আসা এ. কে. এম. মাসওয়ানি। ইংরেজি সাপ্তাহিক দ্য ক্রনিকল-এর সম্পাদক। চৌকো চোয়াল মুখাবয়বে নানান অভিজ্ঞতার ছাপ ও প্রতি বছর রসের জন্য খেজুর গাছের খাঁজকাটা অনেক ঋতুর প্রহার। মাদরি জবান উর্দু হলেও ইংরেজিতেও বেশ সড়গড়। সস্তার সিগ্রেট ফোকেন। হাসিটি সর্বদাই দ্ব্যৰ্থবোধক। আরেকজন আজ আর তেমনভাবে মনে না থাকলেও মোটা ফ্রেমের চশমাপরা জনৈক হৈদ্রাবাদি, ফজল জাতীয় নাম, বেশ গুরুগম্ভীর চালের হলেও মুখ খুললেই কেমন যেন বোকা বোকা, আর সেই টকটকে গা গোলাপি রঙের কবি সিরাজি সাহাব, গায়ে কুচকুচে কালো শেরওয়ানি, পান-চর্চিত মুখে ভারি মধুর হাসি, সব সময় পাঠানদের ওপর বেখাপ্পাভাবে রেগো টঙ হয়ে আছেন, যা তাকে আদৌ মানায় না; তো সিরাজি সাহাব যখন কবিতা কপচাতে শুরু করতেন সে এক দৃশ্য বটে। সামান্য স্যাম্পল ‘উচ্ছলতি হ্যায়, মছলতি হ্যায়, বিলকতি হ্যায়, চমকতি হ্যায় তেরি জুম্মে শাওয়া’ এরকম অন্তত নাগাড়ে অনধিক সাত কি আট মিনিটের শব্দনির্ঝর অর্থাৎ স্তনবন্দনার নান্দীপাঠ।
আর অন্যদিকে আমার সুবাদে যোগাযোগ ঘটল সুচরিত চৌধুরীর সঙ্গে। সুচরিতের আড্ডার বাঁধাধরা গণ্ডি সময় ছিল সকাল নটা কি দশটার পরে নন্দনকাননস্থ টিলার ওপর সুচরিতের নিজস্ব ডেরা ‘নিভৃত নিলয়’ থেকে নেমে স্থানী প্রতিভাদের প্রধান আড্ডালয় চা-মিষ্টির দোকান বোস ব্রাদার্স অবধি। বাঁশি নিয়ে সুচরিতের নিভৃতসাধনার পাশাপাশি চলত সাহিত্যচর্চার অবিরাম তাঁত। পাশে ছিল একটা সেলুন। একবার নাকি কবি জসীমউদ্দীন এসেছিলেন খেউরি হতে, উপস্থিত ছিলেন কবিয়াল রমেশ শীল। মহা উৎসাহী হয়ে তিনি নিজের হাতে খুর কাঁচি হাতে তুলে নিলেন। কবির দাড়ি কামানো যার তার কৰ্ম্ম নয়। এসব গল্প সুচরিতের মুখে শোনা।
কেউ একতরফা বলে পার পেয়ে যাবে এ ব্যাপারটা শহীদের ধাতে একেবারেই সইত না। শহীদ মানেই দীর্ঘ বিতর্ক উত্তেজিত কথোপকথন। তবে শুরুতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মতো তান বিস্তার, তারপর ধীরে ধীরে সমে ওঠানামা। বিকেলটা ছিল মাসওয়ানি সাহেবের সাপ্তাহিক ‘দ্য ক্রনিকল’ অফিসে, বিকেল মানে কী, সেই সন্ধ্যা রাত পেরিয়ে গভীর থেকে গভীরতর রাত অবধি এ রেস্তোরাঁ থেকে ও রেস্তোরাঁ পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানো ফাঁক-ফোঁকরে খাদ্য গ্রহন, মদ্য পান সবই চলত। এক সময় আমরা, মানে আমি আর শহীদ, মাসওয়ানি সাহেবের ভাড়া করা রেল-এলাকায় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দু-কামরার এক বেড়ার ঘরের মেঝেতে সুজনি পেতে রাত কাবারের অবশিষ্ট সময়টুকু পার করে দিতাম। মাসওয়ানি সাহেবের অতীত আমাদের, অন্তত আমার কাছে খানিকটা রহস্যাবৃত হলেও তখন তিনি ফরিদপুরের এক নিম্নবর্ণের শঙ্খিনী নারীর সঙ্গে ঘর করছেন। মুন্না নামে তাদের একটি শিশুপুত্র হুমহাম করে ঝাঁপাঝাঁপি করে বেড়াত। আর ঐ রাতের শেষপ্রহরে বেড়ার ফুটো ছিল আমাদের কাছে নীল ছবির প্রদর্শনী ঘর। ঘরে ঢুকেই মাসওয়ানি সাহেব জামা-কাপড় খুলে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে হাতে টেনে নিতেন প্যারি ম্যাসন কিংবা সিমেনঁর কোনো বই। আর তার সাধনসঙ্গিনী লতানো পল্লবিনী মুন্না-মা মাসওয়ানি সাহেবের মধ্যপ্রদেশের ওপর কাঁইচি মারার ভঙ্গিতে বসে ঘোড়ায় চড়ার আনন্দ উপভোগ করতেন সম্ভবত। পাশে ঘুমন্ত তুলতুলে মুন্না বেটা কখনো ঘুমের ঘোরে হেসে উঠত। এরপর নিরন্ধ্র অন্ধকার।
আবার নতুন দিনের শুরু হত। চাটগাঁয় শহীদের সঙ্গে আরো ঢের ঢের স্মৃতি জড়িত। রেলওয়ে কলোনির এক বাড়ি, নন্দনকাননে সাংবাদিক আতিকুল আলমের বাড়িতে কিছুকাল বসবাস যে কোনো অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীকেও হার মানাতে সক্ষম।
মাঝখানে দীর্ঘ অদর্শন। তখন আমি গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলারে কাজ করতে করতে কলকাতায় প্রথমে অস্থায়ী, কিছুকাল বাদে স্থায়ীভাবে নোঙর ফেলেছি। ক্রমশ কলকাতা শহরও আমার হাতের তালু হয়ে উঠল। জওহরলাল নেহরু প্ৰয়াত হয়েছেন। নেহেরুর পর কে, এই নিয়ে প্রবল ডামাডোল। বুদ্ধদেব বসু, প্রতিভা বসু তাদের দীর্ঘ প্ৰবাস মার্কিন দেশ থেকে ফিরে এসেছেন। তাঁরা ২০২ রাসবিহারি এভিনিউ’র ফ্ল্যাটবাড়ি ছেড়ে শহরের শেষপ্রান্তে গড়িয়া ছাড়িয়ে নাকতলায় গিয়ে নতুন বাড়িতে উঠেছেন। ছোটখাটো হলেও বেশ দেখতে বাড়িটি। তাদের একমাত্র পুত্ৰ শুদ্ধশীল বসু। অর্থাৎ আমার বন্ধু। অকালপ্রয়াত পাপ্পার সুবাদে ওই নাকতলার বাড়িতে নিয়মিত যাওয়া-আসার সময় একদিন দেড়তলার মেজানিন ফ্লোরে উঠতে গিয়ে দেখি কাঠের সিঁড়ির গোড়ায় পড়ে আছে চৌকোণা তিনটি বই। শামসুর রাহমানের ‘নিরালোক দিব্যরথ’, আল মাহমুদের ‘কালের কলস’ আর শহীদের ‘উত্তরাধিকার’। বু. বললেন, কে যেন দিয়ে গেছে বইগুলো। বহুদিন পর তৎকালীন পূর্ববাংলার কোনো বই দেখে স্বভাবতই আমার যথেষ্ট উল্লসিত হওয়ার কারণ তো ছিলই, তার ওপর কবিদের তিনজনই যে আমার চেনা। শামসুর রাহমানের প্রথম বই ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ আমি ঢাকা থাকতেই দেখে এসেছিলাম। আর দ্বিতীয় গ্রন্থ ঝিমধরানো তীব্র হলুদ রঙের মলাটঅলা বই ‘রৌদ্র করোটিতে’ দয়াপরবশত কবি স্বয়ং কার হাত দিয়ে যেন আমার জন্য উপহার পাঠিয়েছিলেন। শুরু থেকেই আমি শামসুর রাহমানের অনুরক্ত পাঠক। অন্য দুজনের বই দুটি তাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। একমাত্র শামসুর রাহমান ছাড়া অন্য দুটি বইয়ের অনেক কবিতাই আমার আগেই পড়া ছিল। তবু দুমলাটের মোড়কে সেগুলো নতুন করে দেখার ও পড়ার আনন্দ ছিল আলাদা। এরপর মুক্তিযুদ্ধের সময় আকস্মিকভাবে একদিন এক বিলম্বিত সকাল পেরুনো দুপুরে কলকাতায় ট্রামে দেখা হলো আল মাহমুদের সঙ্গে। তারপর দীর্ঘ ন’মাসের বিপন্ন, ঝড়ো, উৎকণ্ঠভরা বিতর্কিত জীবনের কথা অন্যত্র বলা যাবে।
স্বাধীনতার পর মৈত্রীমেলা উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে কলকাতা গেলেন অনেক কবি-সাহিত্যিক। এদের মধ্যে শামসুর রাহমান ও শহীদ কাদরীকে পেয়ে আমার আনন্দের সীমা রইল না। ওদের সঙ্গে সে যাত্রায় আল মাহমুদও অবশ্যই ছিলেন। বিজয়ীর হাসি তার মুখে। কলকাতায় থাকাকালীন কোনো জমজমাট আড্ডার আসরে, তা সে কফি হাউস, পানশালা, রক বা কোনো বিদগ্ধজনের ড্রইংরুমে যেখানেই হোক না, শহীদকে আমার মনে পড়ত। মনে হত কলকাতাই শহীদের উপযুক্ত জায়গা। কারণ অযথা অঢেল সময় ব্যয়ের সঙ্গে উত্তপ্ত কড়া-মিঠে-ঝাল মশলাদার কথার খই ফোটাতে শহীদের জুড়ি আমি কমই দেখেছি।
সুদীর্ঘ ন’মাস মুক্তিসংগ্রামের শেষে একদিকে যেমন বিজয়ী বীরদের শত্রুমুক্ত স্বদেশে ফেরা, অন্যদিকে দুঃখ রজনী শেষে বহুদিন সম্পর্কহীন দুই সহোদরপ্রতিম প্রতিবেশীর আসা-যাওয়া শুরু হতেই কলকাতা থেকে ঢাকায় গেলেন কবি-সাহিত্যিকদের এক বিরাট ঝাঁক। তার মধ্যে ছিলেন আমার নিকটজন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ। ফিরে যাওয়ার পর তাদের মুখে শুনলাম শহীদের গৃহী হবার খবর। নীরেনদা তো শহীদের স্ত্রী পিয়ারী সম্পর্কে এক কথায় উচ্ছসিত। মরি রি! যেমন রূপসী তেমনই বিদুষী। শহীদ ওর গাৰ্হস্থ্য আশ্রমে ওদের আদরআপ্যায়ন করেছে হার্দ্য উষ্ণতায়। নীরেনদার গল্প শুনে মনে হলো এ আমার চেনা শহীদ কাদরী হতে পারে না। এর বছর-তিনেক আগে একবার যখন হিন্দুস্থান-পাকিস্তানের সঙ্গে বলতে গেলে মুখ-দেখাদেখি বন্ধ, সেই সময় আমাদের পরম বান্ধব জীবনানন্দপ্রেমী গবেষক মার্কিন নাগরিক ডি. এইচ. লরেন্সের মতো দেখতে ক্লিনটন বুথ সিলি অর্থাৎ আমাদের ক্লিন্ট সাহেব বহু কাঠখড় পুড়িয়ে হিল্লি-দিল্লি তদ্বির-ধরনা দিয়ে ঢাকা ভ্রমণের অনুমতি জোগাড় করে স্থলপথ বনগাঁ সীমান্ত দিয়ে ঢাকায় গিয়েছিল। বুদ্ধদেব বসু পরিমণ্ডলের আমরা অনেকেই ক্লিন্টকে বনগাঁও পর্যন্ত এগিয়ে দেয়ার উছিলায় রসনায় পদ্মার ইলিশের স্বাদ নিয়ে কলকাতায় ফিরে গিয়েছিলাম জিপে করে।
যদিও ক্লিন্ট এর বহু বছর আগে পিস কোরের ভলান্টিয়ার হিসেবে বেশ ক’বছর বরিশাল কাটিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঢাকা শহর তেমন রপ্ত ছিল না। তবুও ঢাকায় গিয়ে কোথায় থাকতে পারে, কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ওর কাজকর্মের সুবিধে হতে পারে এমন একটা ছক কেটে দিয়েছিলাম। আমিও দীর্ঘকাল দেশছাড়া। সুতরাং কে কোথায় আছে কেমন আছে, ঢাকা শহরই বা দৈর্ঘ্য-প্রস্থে কতটা বেড়েছে সঠিক জানি না। সে যাত্রায় ক্লিন্ট বোধ করি মাসতিনেক কাটিয়ে থাই এয়ারওয়েজে চেপে দিল্লি হয়ে কলকাতায় ফিরেছিল।
আমার সঙ্গে এক সকালে বুদ্ধদেব বসুর নাকতলা বাড়ির ব্রেকফাস্ট টেবিলে দেখা হতেই উচ্ছ্বসিতভাবে বাবু ক্লিন্ট ঢাকার গল্প শুরু করল। ক্লিন্ট বেশ তালেবার। আমার দেশের বাড়িতে গিয়ে আমার আম্মা-আব্বার সঙ্গে দেখা করে বাড়ির পুকুরে সাঁতার কেটে স্নান করে পুত্রের অবর্তমানে আমার মায়ের সস্নেহ পরিচর্যা, ঢাকায় বসবাসরত আমার ভাইবোনদের সঙ্গে থেকে একটা আত্মীয়তা মতো গড়ে ওঠার গল্প শোনাল। একে একে ঢাকার কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের মধ্যে শামসুর রাহমান নিঃসন্দেহে বড় কবি, রুচিবান, রূপবান; আল মাহমুদ বাংলাদেশের রূপ-রস-গন্ধমাখা মাটির কবি; আরও ঢের তরুন কবি প্রমুখ অনেকের কথা বলতে বলতে শহীদ সম্পর্কে আমার কৌতূহলের জবাবে বুদ্ধদেব, প্রতিভা বসুর সামনে নির্বিকারভাবে বলতে লাগল : শহীদ কাদরীই এদের মধ্যে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং। যেমন ভালো লেখা তেমন তার বাকবৈদগ্ধ রীতিমতো মুগ্ধ হবার মতো। তবে শহীদ ‘লেওড়া’ শব্দটির ব্যবহারে বেশ অকৃপণ। তার প্রতিটি কথাতেই ওই শব্দটির উচ্চারণ এতটাই প্রগাঢ়, গূঢ় এবং মরমী যে তা আর বলবার মতো নয়। বুদ্ধদেব, প্রতিভা বসু কতটা শুনেছিলেন বা আদৌ বুঝতে পেরেছিলেন কিনা জানি না, তবে আমি আর পাপ্পা কিছুটা অপ্রতুল হলেও প্রবল অট্টহাসিতে যে ফেটে পড়তে পড়তেও কী করে হেঁচকি তুলে নিজেদের সামলে নিয়েছিলাম তা ভাবতেও এখনো শিউরে উঠি।
একদিন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের তৎকালীন বাসস্থান গড়িয়াহাট ব্রিজের লাগোয়া তিনতলায় মৈত্রীমেলার অভ্যাগত কবি-সাহিত্যিকদের পানাহারের জমজমাট আসর। সবাই উপস্থিত। স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিযুদ্ধের ন’মাসে প্রসঙ্গ উঠল। শামসুর রাহমান, শহীদ ওই সময়টায় ঢাকাতেই এক অবর্ণনীয় অবস্থায় কাটিয়েছেন। শামসুর রাহমান সেই দুঃসময়ে রচিত ‘নিজ বাসভূমে’ গ্রন্থে সংকলিত বেশকিছু কবিতা পাঠিয়েছিলেন। কার মারফৎ যেন। ‘মজলুম আদীব’ অর্থাৎ ‘নির্যাতিত মানব’ এই ছদ্মনামে কবিতাগুলো পত্ৰস্থ হয়েছিল সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায়। শুনেছিলাম ওই ছদ্ম নামকরণ করেছিলেন শামসুর রাহমানের কতিবানুরাগী আবু সয়ীদ আইয়ুব স্বয়ং। এ ধরনের আড্ডায় যা হয়- কথাবার্তা প্ৰসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে যাচ্ছে আবার কখনো গোড়া থেকে মূলের দিকে বুড়িছোঁয়া প্রত্যাবর্তন মাঝে-মধ্যে দম ফাটা হাসি, হুল্লোড়। আসলে গোটা ব্যাপারটাই যে এক রকমের ছোঁয়াচে। সবাই সমস্বরে কথা বলছে। স্যুট-টাই পরিহিত চাঁদপনা মুখের আল মাহমুদ এঘর-ওঘর ঘুরে বেড়াচ্ছেন তদারকির ভঙ্গিতে, ফাঁকে ফাঁকে তৃষ্ণার্ত গলা ভিজিয়ে নিচ্ছেন তরল সোনালি আঙুররসে। এক সময় আল মাহমুদ ও শহীদ মুখোমুখি হতেই দুজনের মধ্যে খটাখটি লেগে গেল কী নিয়ে যেন। আসলে দুজনই বড় কবি তো! এই খটাখটি তো আবার পরমুহুর্তেই গলাগলি আর তাছাড়া দ্রব্যগুণের প্রভাব তো আছেই। দুজনেরই খানিকটা পেটে পড়েছে যে! যুদ্ধের ন’মাসে কলকাতায় আসা, না-আসা নিয়ে লেগেছিল। প্রথমদিকে শহীদ খুবই সংযতবাক। পরে আল মাহমুদ যখন বলে উঠল : ‘মিয়া, রেক্স-এ তোমার ঐ হাসিটা দেখেই সেদিন আমি বিপন্ন বোধ করে দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সে রাতেই আমি প্রথম ব্ৰাহ্মণবাড়িয়া চলে যাই। পরে বাড়ির লোকদের তাড়ায় আমাকে কলকাতায় চলে আসতে হয়েছিল। ... ‘আল মাহমুদের কথা শেষ হবার আগেই শহীদের কুশাগ্র ছোবল : ‘আরো মিয়া, তুমি এমনকি রবীন্দ্রনাথ হইয়া গেছিলা যে বালবাচ্চা, পরিবার-পরিজনকে সাপের মুখে ফালাইয়া নিজের জান বাঁচাইবার জন্য নিরাপদ আশ্রয়ে পালাইয়া গেছিলা?’
প্রত্যুত্তরে আল মাহমুদের অকাট্য যুক্তি। এদিক থাইকা যখন নীরেনদা মানে নীরেন চক্রবর্তী, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদের মতো কবিরা এখন কেমন আছেন, কোথায় আছেন জানতে ইচ্ছে করে বলে প্রকাশ্যে আকাশবাণীর অনুষ্ঠানে ব্যাকুলতা প্ৰকাশ করেন তখন পাকিস্তানি হানাদারদের অতর্কিত আক্রমণের আশঙ্কা থেকে মুক্ত হই কী করে। পরিবার-পরিজনরাই আমার জন্য তাদের নিজেদের বিপদাশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আমাদের যা হোক একটা কিছু হবে কিন্তু আমাদের চেয়ে আপনার জীবনের মূল্য অনেক। আপনি কলকাতা চলে যান...।
‘তাই তো বাধ্য হইয়া যাইতে হইছিল।’
শহীদ কাদরী যে আমাদের শহীদ কাদরী হয়ে উঠতে পেরেছেন তা সম্ভব হয়েছে ভাইয়া শাহেদ কাদরীর সস্নেহ প্রশ্রয়ের জন্য। শহীদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তরাধিকার’য়ের শেষ কবিতা ‘অগ্রজের উত্তর’ শিরোনাম কবিতাটিতে দুই ভাইয়ের সম্পর্কের উষ্ণ নিবিড়তা খুবই হৃদয়স্পর্শী। কবিতাটি এরকম :
‘না, শহীদ সে তো নেই : গোধূলিতে তাকে
কখনও বাসায় কেউ কোনোদিন পায়নি, পাবে না।
নিসর্গে তেমন বন নেই, তাহলে ভালোই হতো
অন্তত চোখের রোগ অযত্মে সারিয়ে তুলতো হরিৎ পত্রালি;
কিন্তু মধ্য রাত্রির সশব্দ কড়া তার রুক্ষ হাতের নড়ায়
(যেন দুঃসংবাদ নিতান্ত জরুরি) আমাকে অর্ধেক স্বপ্ন থেকে
দূর স্বপ্নে জাগিয়ে দিয়ে, তারপর যেন মর্মাহতের মতন
এমন চিৎকার করে ‘ভাই, ভাই, ভাই’ ব’লে ডাকে,
মনে পড়ে সেবার দার্জিলিঙের সে কি পিছন রাস্তার কথা,
একটি অচেনা লোক ওরকম ডেকে-ডেকে-ডেকে খসে পড়ে
গিয়েছিলো হাজার-হাজার ফিট নিচে।
সভয়ে দরোজা খুলি- এই ভাবে দেখা পাই তার- মাঝরাতে;
চাকুরিতে মন নেই, সর্বদাই রক্তনেত্র, শোকের পতাকা
মনে হয় ইচ্ছে করে উড়িয়েছে একরাশ চুলের বদলে।
... না, না, তার কথা আর নয়, সেই
বেরিয়েছে সকাল বেলায় সে তো- শহীদ কাদরী বাড়ি নেই।’
ভ্রাতৃপ্রেমের উজ্জ্বল নিদর্শন নয় কি?