সম্পাদকীয়
মানুষ বড়ো অদ্ভুত জীব। তাকে নীতিকথা শোনাও, সে মনোযোগ দেবে না। জীবনযাপন সম্বন্ধে হিতোপদেশ দাও, তাতে তার মন বসবে না। কিন্তু সেই নীতিকথা আর জীবনের উপদেশের মর্মার্থ নিয়ে কিছু মানুষের জীবন নিয়ে গল্প বলো, তাহলে সে তন্ময় হয়ে শুনবে, সেইসব কাল্পনিক মানব-মানবীর সুখে হাসবে, দুঃখে চোখের জলে বুক ভাসাবে। যদিও সে জানে সবই বানানো মিছে গল্প।
এই কারণে আমরা যারা বই পাগল, তাদের পঠন পাঠনে গল্প-কাহিনি বা কথাসাহিত্য এতখানি জায়গা জুড়ে থাকে। তবে তারপরও স্বভাব ও রুচি অনুযায়ী আমাদের বইপড়ায় রকমফের রয়েছে, সেকথাও অনস্বীকার্য।
সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় সালমান রুশদীর একটা নিবন্ধে লেখক তার নিজের কথাসাহিত্য পাঠ ও পছন্দের এক চিত্তাকর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। এই রচনায় রুশদীর নিজের কথাসাহিত্য কেন বারবার বাস্তবতার সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছে, তার উৎস সম্বন্ধেও অনেকটা আভাস পাই।
আমরা সচরাচর বলে থাকি সঙ্গীত কোন ভৌগলিক সীমানার ধার ধারে না। কথাটা খানিকটা অন্যভাবে কথাসাহিত্যের ব্যাপারেও যে প্রযোজ্য – সেটা রুশদীর এই রচনাতে ফুটে উঠেছে। কথাসাহিত্য সীমানা অতিক্রম করতে করতে বহুরূপীর মতো তার রূপ বদলায় – এক দেশের গল্প আরেক দেশে যায়, সেখানে তার রূপান্তর ঘটে, তারপর আবারো আরেক দেশে গিয়ে সেটা অন্য রূপ নেয়। গল্প-কাহিনির এই বিশ্বপরিক্রমায় একটি বড়ো মানবিক সত্য আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে – ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের মানব গোষ্ঠী তার জীবনচর্যা আচার-আচরণ আর সাংস্কৃতিক পরিচয়ে যতই আলাদা হোক না কেন, মানুষের মন সুখ-দুঃখ-বেদনা-হাসি-কান্নায় যেভাবে আন্দোলিত হয়, সেটা কীভাবে যেন প্রতিটি মানুষকে একটি বৈশ্বিক মানব পরিবারের অংশ করে, পরস্পরের সাথে মমতা ও ভালোবাসার বিনিসুতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। কথাসাহিত্য এই বিনিসুতার মালাটি রচনা করে।
রুশদীর রচনায় তার পঠন-পাঠনে সাহিত্যের বিশ্বপরিক্রমার আভাস পাই। সেই সাথে এই কথাটিও সত্য যে তন্নিষ্ঠ পাঠক পৃথিবীর যেখানেই থাকুন না কেন, তিনি তলস্তয়-এর আনা কারেনিনার দুঃখে কাতর হন, মার্কেজের কর্নেলের বেদনায় তার মন খারপ হয়, আরব্য উপন্যাসের শাহারজাদীর সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তায় অভিভূত হন, রামায়ণে সীতার অন্যায় অপমানে রাগে-দুঃখে ব্যথিত হন।
রুশদীর এই রচনাটি বিশ্বের কথাসাহিত্য সম্বন্ধে আমাদের পাঠকদের মনে নানা নতুন ভাবনা উষ্কে দেবে, কথাসাহিত্যকে আরেকটু নতুন আঙ্গিকে দেখতে উদ্বুদ্ধ করবে বলে আমাদের ধারণা। এইজন্য এবারের সংখ্যায় এই লেখাটি পাঠকদের কাছে নিবেদন করা হলো।