কেমন করে গল্পকার হলেন সৈয়দ শামসুল হক?
‘ধুয়ে দিলেন জরুরি রকমে; সভাশেষে তখনকার ঢাকার যাবৎ প্রতিষ্ঠিত কবি ও লেখকেরা
সৈয়দ শামসুল হক পুরো সময়টা জুড়েই কাব্যচর্চা করেছেন। তিনি দেশ এবং কাল সম্পর্কিত এবং নানামাত্রিক জাতীয়তাবাদী লেখায় ব্যস্ত থাকেন আশির দশক থেকে। এই সময়ে মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষা, আত্মপরিচয়ের বিভিন্ন সমস্যার প্রশ্ন তার সাহিত্যে বেশি প্রভাব ফেলেছে। প্রেম-কাম এবং নারীপ্রিয়তা সাধারণত তার কবিতায় প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে। গল্পও লিখেছেন বিস্তর। আমরা তাঁর মুখেই শুনবো কেমন করে গল্পকার হয়ে উঠলেন সৈয়দ শামসুল হক?
গল্প লিখছি আজ অনেক বছর হয়ে এল, প্রথম বছরের মাথাতেই গল্প লেখার ইতি ঘটে যেত যদি না আমার প্রথম গল্পে প্রকাশক একদিন এক দুঃখের সন্ধ্যায় আমার কাঁধে স্নেহের হাত না রাখতেন; ব্যক্তিটি প্রয়াত ফজলে লোহানী, অগত্যা নামে এক অসাধারণ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, তাঁর কাগজে আমার প্রথম গল্পটি ছাপা হয় এবং গল্পটি ষোলোআনা আমার ছিল না- প্রবোধকুমার সান্যালের ‘ক্ষয়' নামে একটি গল্পকে অদলবদল করে, চরিত্রগুলোর মুসলমান নাম রেখে তৈরি করেছিলাম লেখাটি; লোহানী পরে সেই হাফচুরি ধরতে পেরেও আমাকে বঞ্চিত করেন নি তাঁর সাহচর্য এবং প্রশ্রয় থেকে- ততদিনে আমার দ্বিতীয় গল্প লেখা হয়ে গেছে, একেবারে আমার তৈরি গল্প, কারো কাছে হাত পাতি নি, ডাকাতি করি নি, আপন-কল্পনায় তাকে রচনা করেছি এবং এক সন্ধ্যায় গল্পটি পড়ে উঠেছি পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের পাক্ষিক বৈঠকে, সে বৈঠক হতো পাটুয়াটুলিতে ‘সওগাত' প্রেসে, গল্পটির নাম ছিল শেষের কবিতার পরের কবিতা এবং বড় আশা ছিল এই এক গল্প আমাকে সাহিত্য সংসারে ঘর দেবে, কিন্তু না, আমার কপালে ছিল সীমাহীন দুঃখ- খালেদ চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, আব্দুল গনি হাজারী, এবং আতোয়ার রহমান আমাকে যাকে বলে ‘ধুয়ে দিলেন জরুরি রকমে; সভাশেষে তখনকার ঢাকার যাবৎ প্রতিষ্ঠিত কবি ও লেখকেরা একে অপরের হাত ধরে, গলা ধরে, হাসতে হাসতে নেমে পড়লেন পথে, কেউ আমার দিকে একটিবারও ফিরে দেখলেন না, আমি সজল চোখে দাঁড়িয়ে রইলাম, মূঢ় এবং একাকী, প্রেসের সমুখে ডালিম গাছটির নিচে; হঠাৎ আমার পিঠে হাত- ফজলে লোহানী, চোখের পানির জন্যে তাঁর মুখখানি ভালো করে দেখতে পেলাম না, কেবল শুনলাম তিনি বলছেন, ঐ যে ওদের দেখছ, একদিন ওরা থাকবে না, তুমি থাকবে।' আমি থাকব কিনা দূরের কথা, আছি কিনা, ভাবি; এখন যে-গল্প লিখি তাকে আর গল্পও বলি না, বলি- গল্প-প্রবন্ধ, এখন কেবল সম্ভবপরতাই নয়, তার সঙ্গে আরো ধরতে চাই একটি স্বপ্নরোপিত কৃষিক্ষেত; এই বইয়ের কোনো একটি রচনাতেও যদি তা হয়ে থাকে তা হলে জানব- কুড়িগ্রামের গণিকে আমি অতিক্রম করতে পেরেছি।
লেখক আনিসুল হক বলেন, ‘তিনি যদি অন্য সব বাদ দিয়ে দুটো বই লিখতেন ‘পরানের গহীন ভেতর’ এবং ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’ তাহলে এ দুটো বই তাকে অমর করে রাখত। তিনি যদি শুধু তার কাব্যনাট্যগুলো লিখতেন ‘নুরলদিনের সারাজীবন’ এবং ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ তাহলেও আমরা চিরদিনের জন্য তাকে বাংলা সাহিত্যে স্মরণ করতে বাধ্য থাকতাম।